জগজ্জয়ী মসলিন । ঢাকার ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক সংযোজন। অনেক স্তুতি রচিত হয়েছে মসলিন নিয়ে । তারমধ্যে একটি স্তুতি গান সেকালের বাংলায় লোকের মুখে মুখে ফিরত।

হাতেতে লইলে শাড়ি মুইষ্টোতে মিলায়
মৃত্তিকাতে লইলে শাড়ি
পিঁপড়ায় লইয়া যায়।

অর্থাৎ যদি হাতের ভেতর শাড়িটা নেন তাহলে সেই শাড়ি মুঠোর মধ্যে ঢুকে যাবে। যদি শাড়িটা মাটিতে রাখেন, তবে তা পিঁপড়ায় নিয়ে যাবে। এই অসাধারণ লোক সঙ্গীত আমাদের মসলিনের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঢাকাই মসলিন পরিহিত অভিজাত নারী

মসলিন বয়ন কবে থেকে শুরু হয়েছিল সেই ইতিহাস আজও অজানা। ব্রিটিশ ইতিহাস পন্ডিতদের লেখা থেকে জানা যায় আসিরিয়া এবং ব্যাবিলনে ঢাকার মসলিন যশ খ্যাতি ছিল। প্রাচীন ব্যাবিলনের বস্ত্রের বর্ণনায় ঢাকার মসলিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। মিশরের পিরামিড গুলোতে যেসব মমি পাওয়া গেছে তাদের গায়ে যে বস্ত্র ছিল সেটা ছিল ঢাকাই মসলিন। প্রাচীন গ্রিসে মসলিন রপ্তানি হত। রোমের সুন্দরী ললনারা মসলিন কাপড়ের খুব ভক্ত ছিল। ইতালির ঐতিহাসিক প্লিনি এই মর্মে অভিযোগ করেছিলেন ,রোমান সুন্দরীরা মসলিন পড়ে তাদের দেহসৌষ্ঠব ফুটিয়ে তুলছেন, কামনা কাতর করে ছাড়ছেন পুরুষজাতিকে। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী জোসেফাইনও মসলিনের গুনগ্রাহী ছিলেন। পাশ্চাত্যের সুন্দরীরা মসলিনকে বলতো ” উভেন এয়ার”(Wooven Air) । কারণ, মসলিনের বিশেষত্ব ছিল রোদ্দুরে রাখলে মসলিন দিয়ে তৈরি বস্ত্রটি চোখেই পড়তো না।

ঢাকাই মসলিনের পোশাক পরা নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফিন বোনাপার্ত

ঢাকার ভাওয়ালের জঙ্গল বেষ্টিত কাপাসিয়া ছিল একসময় মসলিন তৈরির সেরা প্রাচীন কেন্দ্র। মধ্যযুগের সোনারগাঁ এবং তৎপরবর্তী কালে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও তাতখানা লেন মসলিন বয়নের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাতখানা লেন তল্লাটটি আমাদের হোসেনী দালান মহল্লায় অবস্থিত। সেকালে পদ্মা ,মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র বিধৌত ১৯৬০ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে মসলিন তৈরি হতো। ঢাকা ,সোনারগাঁ ,ডেমরা, ভিতবদ্ধি, বালিয়াপাড়া ,নাপাড়া ,বৈকলি, বাছাবক, চরপাড়া, বাশটোকি ,নবীগঞ্জ ,শাহপুর ,সিদ্ধিরগঞ্জ, জংগল বাড়ি,তিতাবাদি,ধামরাই ,কাঁচপুর মসলিন তৈরির কসবা ছিল।

পুরোনো যুগের মসলিনের থ্রেড কাউন্ট হতো ১২০০ পর্যন্ত, তবে সম্প্রতি ঢাকায় ৩০০ কাউন্ট পর্যন্ত মসলিন বানানো হয়েছে

তিতাবাদি ঢাকার কাপাশিয়ার অন্তর্গত লক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি গ্রাম । এখানে উৎকৃষ্ট ফুটী কার্পাস জন্মাতো । এই ফুটী কার্পাস দিয়েই ঢাকার মসলিনের সবচেয়ে মসৃণ ও সূক্ষ সুতা তৈরি হতো। এই সূক্ষ্ম সুতা প্রক্রিয়াজাত হতো বোয়াল মাছের দাঁতের সাহায্যে। বোয়াল মাছের দাঁত ছোট এবং ঘন সন্নিবিষ্ট বলে একে অতি সূক্ষ্ম চিরুনি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। কার্পাসের উপর বোয়াল মাছের চোয়ালের দাঁত খুব সন্তর্পনে চালিয়ে এমন ভাবে পরিষ্কার করা হতো যাতে তুলা নষ্ট না হয় এবং সাথে সাথে তুলার সাথে থাকা সব অপ্রয়োজনীয় অংশ বেরিয়ে যায়। মসলিনের সুতা এত সূক্ষ্ম ছিল যে একালে তা কল্পনাই করা যায় না। একমাত্র পূর্ণ যৌবনা মেয়েরাই তাদের চাপা ফুলের মত আঙ্গুল দিয়ে এই সুতা প্রস্তুত করতেন। রমনীর বয়স ২৫ পেরোলেই আর সুতা কাটতে পারতেন না। কারণ তখন সুতার সূক্ষ্মতা নষ্ট হয়ে যেত।

বোয়াল মাছের দাঁত

ছয়টি স্তরে মসলিনের কাপড় বোনা হতো

এক: সুতা নাটান, দুই: টানা হোতান, তিন: সানা বাধা , চার: নারদ বাধা, পাঁচ: বু বাধা, ছয়: কাপড় বুনা। মসলিনেরর সুতা বোনার প্রক্রিয়াটা ছিল যেন রোদে উর্ণনাভ বোনার মত। মানসিক অস্থিরতা থাকলে মসলিন বয়ন করা যেত না ।ভোর চারটা থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত মসলিন বয়নের উপযুক্ত সময় বলে গণ্য হতো। কারণ রোদ বেশি হলে সুতা আর নজরে আসতো না। কোন কোন মসলিনের সুতা বোনা হত শুধু শীতকালে , যেমন ,মলমল খাস।শীতের শিশির মলমল খাসের জন্য খুবই উপযুক্ত ছিল। মাকড়সার জালের চেয়েও সূক্ষ্ম এই সুতার এক তোলা বুনতে লাগতো ছ’মাস।

ফুটি কার্পাস থেকে সূতা তৈরি করা খুব কঠিন

১৭৫ হাত দীর্ঘ একটা সুতার ওজন ছিল এক রতি। এক কেজি সুতার নিম্নতম মূল্য ছিল ৬৪০ টাকা সে আমলের। মসলিন বোনার জন্য খুবই সাধারণ মানের তাঁত ব্যবহার করা হতো। আরো খুঁটিনাটি ৫০ টির মত ক্ষুদ্র দেশীয় যন্ত্রাংশও ছিল।বিদেশীরা ঢাকার মসলিন তাঁতিদের তাঁত দেখে অবাক হয়ে যেত। মসলিন তৈরি করার জন্য ইউরোপের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা তাদের দেশে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেও এক গজ মসলিন তৈরি করতে পারেনি। নির্দ্বিধায় বলা যায় ঢাকার মসলিন ছিল বিশ্বের নবম আশ্চর্যের একটি ।

মসলিন বুনতে তৈরি সরঞ্জাম, এদের অনেকগুলো এখনো বংশানুক্রমে জামদানি বুনতে ব্যবহার হয়ে থাকে; Image source: Drik/ Bengal Muslin

সৌভাগ্যবশত, আঠার এবং উনিশ শতকের ঢাকায় তৈরি বিভিন্ন প্রকারের মসলিনের কয়েকটি তালিকা পাওয়া যায় ,যেমন , মলমল খাস,ঝুনা, রঙ্গ,আব-ই-রওয়ান,সরকার-ই-আলী,খাসসা,শবনম,আলি-বালি,তন-জেব, তরনদাম,নয়ন-সুখ, বদন-খাস,সর-বনদ,সর-বুটি,কামিছ,ডোরিয়া, চার-কোনা ইত্যাদি। এসব নামের প্রত্যেকটি অর্থবোধক ছিল। যেমন আব-ই-রওয়ান মানে প্রবাহমান পানি। পানিতে রাখলে এই মসলিন বস্ত্র খুঁজেই পাওয়া যেত না। ৯ থেকে ১১ গজ একটি আব-ই-রওয়ান বস্ত্রের ওজন ছিল মাত্র ৫ তোলা। দাম ছিল ৪০০ টাকা । ঝুনা মলমল ছিল ইউরোপের নর্তকিদের প্রিয় বস্ত্র। নবাবরা সেকালে মোগল সম্রাটকে যে মসলিন উপহার দিতেন তার নাম ছিল সরকার-ই-আলী। 

ফুটি কার্পাসে

শবনম মসলিনের অর্থ ছিল সন্ধ্যার শিশির,আর তন-জেব মানে “দেহের অলংকার”। সরকন্দ ছিল শিরস্ত্রাণের কাপড়। সরবতি অর্থ জড়ানো সওগাত অর্থ উপহার প্রদানের মসলিন। বুটি তোলা মসলিনের নাম ছিল কাসিদা। আরব দেশে কাসিদা ব্যবহার করা হতো পাগড়ির সঙ্গে। সেকালের শাশ্বত ঢাকার এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ লুকিয়ে ছিল মসলিনের মাঝে। ইউরোপীয়রা মনে করত কস্মিনকালেও এটা মানুষের হাতের কাজ না ,এ নিশ্চয়ই ঢাকার মানুষরা পরীদের দিয়ে কারসাজি করে প্রস্তুত করায়। বাস্তবিক সেকালের ঢাকার পরীর মত উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়েরা মসলিন বয়ণ করতেন। শুধু তাঁত বোনার মুন্সীয়ানায় নয়, তাঁত চালানোর সময় তাদের দেহ সৌষ্ঠবে নটরাগিনী ভঙ্গি খেলা করত। তখন নটরাজ তার কৃপা বর্ষন করতেন,রচিত হত ঢাকার অমর অজেয় মসলিন উপাখ্যান।