খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৫ সাল। মিশরের আমার্না শহরের দক্ষিণ অংশ। ‘রাজাদের প্রিয়’ এবং ‘শিল্পীদের শিল্পী’-খ্যাত মিশরের বিখ্যাত ভাস্কর থুতমোসের ভিলা। ভিলা না বলে একে থুতমোসের ভাস্কর্য তৈরীর কারখানা বললেই অধিক সঙ্গত মনে হবে। রাষ্ট্রের বিত্ত-বৈভব ও সম্রাটের ক্ষমতা প্রদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হচ্ছে সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের ভাস্কর্য তৈরী। আর এ কাজে থুতমোসের বিকল্প কেউ নেই। থুতমোস আজ বানাতে বসেছেন একজন অদ্ভূত সুন্দর নারীর আবক্ষমূর্তি। পাথর ঠুকে ঠুকে খুব যত্নসহকারে তৈরী করতে লাগলেন তার অবয়ব। আবক্ষমূর্তিটি তৈরী হয়ে গেলে থুতমোস নিজেই নিজের সৃষ্টি দেখে বিস্মিত হলেন। এটিই সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সৃষ্টি। আবক্ষমূর্তিটি যার চেহারার আদলে তৈরী হয়েছিলো, তিনি হলেন অষ্টাদশ মিশরীয় রাজবংশের দশম রাজা আখেনাতেনের অপরূপা স্ত্রী নেফারতিতি।
অষ্টাদশ মিশরীয় রাজবংশের প্রধান রাজা তৃতীয় আমেনহোটেপের ছেলে ছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন। ঐতিহাসিকেরা তাকে পৃথিবীর প্রথম একেশ্বরবাদের জনক বলেছেন, বিধর্মী রাজা বলেছেন, প্রথম ফ্যাসিস্ট বলেছেন; অথচ তাদেরর এই সম্রাটের কথা কোনো দিন জানবারই কথা ছিলো না। কারণ মিশরীয়রা এই বিধর্মী রাজা ও তার রাণী নেফারতিতিকে শুধু তাদের প্যাপিরাসের বংশলিপি থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয় নি, সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর রাজত্বের সমস্ত নিদর্শনগুলোও খুব যত্ন নিয়ে তারা ধ্বংস করে দিয়েছিলো।
আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কথা আমরা জানতে পারি ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস’ থেকে অনেক দূরে আধুনিক ‘আমার্না’ শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হবার পর। ১৯১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ লুডউইজ বর্চার্তের উদ্যোগে নেফারতিতির বিখ্যাত ‘বার্লিন বাস্ট’ সামনে আসার পর আমাদের মধ্যে প্রাচীন যুগের এই সুন্দরী রাণী নতুন এনিগমার জন্ম দেন। তুলনা শুরু হয়ে যায়, কে সবচেয়ে সুন্দরী –ক্লিওপেট্রা, নাকি নেফারতিতি?
মেঝের আবর্জনা ও ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে ৩০০০ বছর লুকিয়ে থাকা গোপন এক ইতিহাস উন্মোচিত হয় পৃথিবীবাসীর সামনে। উন্নত গ্রীবার অধিকারী রাণীর মুকুট পরিহিত এক অসাধারণ নারীর আবক্ষমূর্তি জানান দেয় মিশরের দাফনকৃত ইতিহাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে। নিখুঁতভাবে রং করা মুর্তিটির একটি চোখের মণি হারিয়ে গিয়েছিলো। তারপরও অসাধারণ সুন্দর তিনি। রাতারাতি এই বার্লিন বাস্ট পরিণত হয় প্রাচীন মিশরের আইকন ও সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্মে।
মিশরীয় ভাষায় ‘নেফারতিতি’ শব্দটির অর্থ হলো ‘সুন্দর কেউ এসেছে’। যে মিশরীয়রা অনেক ভালোবেসে তাদের ভাবী রাণীকে এতো সুন্দর নাম দিয়েছিলো, কয়েক বছর পর সেই মিশরীয়রাই ভয়ঙ্কর ক্রোধে তাকে ইতিহাস থেকে বিলুপ্তও করে দিয়েছিলো। ইতিহাস কিন্তু আখেনাতেন ও নেফারতিতিকে ভুলে যায় নি। আজকের মানুষেরা তাদের নিয়েই বরং বেশি আগ্রহী। আখেনাতেনের ছেলে তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পরও এই চর্চা এতোটুকু ম্লান হয়ে যায় নি।
রহস্যময় নারী ছিলেন মিশরের রাজমহিষী নেফারতিতি। এক সম্ভ্রান্ত রাজপরিবারেই জন্ম তার। ছোটবেলায়ই আখেনাতেনের সাথে তার প্রেম হয় এবং মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিয়ে। আখেনাতেন ও নেফারতিতির ভালোবাসা জীবন্ত হয়ে আছে মন্দিরের দেয়াল ও স্থাপনাগুলোর মাঝে। সম্রাট তাকে শুধু স্ত্রীর মর্যাদাই দেন নি, দিয়েছেন রাষ্ট্রশাসনে অংশগ্রহণেরও অধিকার। সতেরো বছর একে অপরের পাশে থেকে শাসন করেছেন তারা। সম্রাটের পাশে সম্রাটের সমান আকৃতির সিংহাসনে বসে শক্ত হাতে রাজ্য শাসনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন নেফারতিতি। একজন ফারাও-এর মতোই মর্যাদাবান ও ক্ষমতাশালী ছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে সম্রাটের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ছিলো তার। মন্দিরের দেয়ালে সম্রাটের পাশে সম্রাজ্ঞীর ছবি সম্বলিত বিশাল আকারের ফ্রেসকো তৈরী করা হয়েছিলো, যেখানে যুদ্ধরথে চড়ে যুদ্ধরত রাণী তলোয়ার দিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করছেন এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের দিচ্ছেন নানা রকম পদক। এমন ধারার ফ্রেসকো এর আগে আর কোনো রাণীর জন্য তৈরী হয় নি মিশরে। শুধু তা-ই নয়, নিজস্ব মন্দিরও তৈরী হয়েছিলো তার জন্য এবং সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।
আখেনাতেন নিজেও ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের বাইরে পদার্পণের অসীম সাহস দেখিয়েছেন। স্ত্রীকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তিনি মিশরীয় নারীর অবস্থানকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজটি তিনি করেছেন সরাসরি ধর্মের উপর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
প্রাচীন মিশরের সম্রাটেরা বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আর সে জন্য বিভিন্ন মন্দিরগুলোতে উপাসনার নামে এক অবৈধ ব্যবসা পেতে বসেছিলো পুরোহিত সমাজ। এই অনাচার থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে সম্রাট হবার পরই প্রাচীন মিশরের চিরাচরিত ধর্মের ধারণাকে পরিবর্তন করে নতুন একটি একেশ্বরবাদী ধর্মের সূচনা করেন আখেনাতেন। মন্দিরের ক্ষমতাবান ও লোভী পুরোহিতগণকে উপেক্ষা করে ২০০০ বছরের প্রচলিত নিয়মকে এক নিমিষেই উল্টে দেন তিনি।
অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি এক ঈশ্বর সূর্যের উপাসনার প্রথা চালু করলেন। কারণ সূর্য হলো অপার শক্তির উৎস, তার অনুপস্থিতি মানেই পৃথিবীর সমাপ্তি। মন্দির স্থাপত্যেও নিয়ে আসা হলো সূর্যের উপাসনার চিত্র। নিজের ‘আখেনাতেন’ নামকরণটিও তিনি সূর্যদেবতার উপাসক হবার পরই করেছিলেন। ‘আতেন’ বা ‘এথেন’ ছিলো সূর্যদেবতারই নাম। আর ‘আখেনাতেন’ বলতে বোঝানো হতো ‘সূর্যের উপাসক’। এই নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রাণী নেফারতিতি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আগের রাজধানী থিবস (বর্তমান লুক্সর) ছিলো বহু ঈশ্বরবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি শহর। আখেনাতেনের প্রবর্তিত নতুন ধর্ম সেই জায়গায় জনপ্রিয়তা পায় নি বলে রাজধানী সরিয়ে তিনি আমার্নাতে নিয়ে যান। মিশরের নীলনদের পূর্ব তীরে প্রায় ২৫০ মাইল দূরের এক নতুন অঞ্চল ছিলো আমার্না। আমার্নায় তৈরী স্থাপত্যগুলো পূর্ববর্তী স্থাপত্য ও দেবমূর্তিগুলোর তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো। এটিই ছিলো আখেনাতেনের প্রবর্তিত ধর্মের বিশেষত্ব।
সম্রাট আখেনাতেন ও সম্রাজ্ঞী নেফারতিতির সঙ্গে তাদের কন্যা সন্তানদের মমতাময়ী দৃশ্যপট ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো হায়ারোগ্লিফিকে। আখেনাতেনের শাসনামলের আগে এই ধরনের পারিবারিক ছবির প্রাপ্তি একেবারেই বিরল ছিলো। তারা নিজেদেরকে খুব সাধারণভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। মূর্তিগুলোর দেহাবয়বেও আনা হয়েছিলো ব্যাপক পরিবর্তন।
আমার্নাতে সেই যুগে চিত্রে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিলো। নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরের ভাঁজগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হতো ভাস্কর্যতে। নাক, মুখ, ঘাড়, গ্রীবা, প্রসারিত পেট, চওড়া নিতম্ব ইত্যাদি ভীষণ মানবীয় রূপে তৈরী করা হতো। আর ছবিগুলোতে স্বামী, স্ত্রী, সন্তান সবাইকেই জনসম্মুখে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সাধারণ মানুষের কাছে পুরো পরিবারের এক আবেদন তৈরীর চেষ্টা ছিলো দৃশ্যমান, যেনো পারিবারিক প্রেক্ষাপটগুলোর প্রতি সাধারণ জনগণের নৈকট্য বৃদ্ধি পায়। এথেন বা সূর্যদেবতাকেন্দ্রিক একেশ্বরবাদের প্রচারের জন্য শিল্পের এই আমুল সমাচার করা হয়েছিলো।
তবে স্রোতের বিপরীতে হাঁটলে বিপদ তো আসবেই। বিত্তশালী সাম্রাজ্যের কোষাগারে সঞ্চিত অর্থ আখেনাতেন অকাতরে খরচ করতে লাগলেন নতুন রাজধানীকে সমৃদ্ধ করবার জন্য। নতুন মন্দির, নতুন স্থাপত্য, নতুন প্রাসাদ –এ সমস্ত করবার প্রয়াসে এক পর্যায়ে খালি হতে শুরু করলো রাজকোষ। এদিকে নতুন ধর্মকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলো না প্রাচীন মিশরের অধিকাংশ লোক। বহু দেবতায় বিশ্বাসী লোকেরা যারা বিভিন্ন ধরনের মূর্তি ও কবজ বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো, তাদের মধ্যে বিরক্তির উদ্ভব হলো। মন্দির-কেন্দ্রিক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলো। বিভিন্ন দেবতার মূর্তি খোদাই করার কাজ বন্ধ হয়ে গেলো। কাজ হারিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো লোকজন। এ ছাড়াও তাদের মনে ভীতির উদ্ভব হলো, স্বয়ং ফারাও যদি দেবতাদেরকে অস্বীকার করেন, তবে সাম্রাজ্যের অকল্যাণ কেউ ঠেকাতে পারবে না।
বহু দেবতার পূজা বন্ধ হওয়ায় ধর্মযাজকদের আয় কমে গেলো এবং ক্ষমতাও খর্ব হলো। এতে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হতে শুরু করলো তারা। এভাবে পুরোহিতদের নেতৃত্বে আখেনাতেন ও তার পরামর্শদাত্রী নেফারিতিতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে শুরু করলো মিশরবাসী। অন্য দিকে, নতুন রাজ্য ও নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অঙ্গরাজ্যগুলোর দুঃসময়ে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সম্রাট। সব মিলিয়ে বিপরীত স্রোতের সাথে চলাটা হয়ে উঠলো বিপদসঙ্কুল। আর ফলস্বরূপ, শত্রু তৈরী হতে লাগলো পদে পদে।
হয়তো এসব কারণেই মৃত্যুর কয়েক দিনের মাঝেই ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন আখেনাতেন ও নেফারতিতি। হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই মুছে দেয়া হলো তাদের অস্তিত্ব। নষ্ট করে দেয়া হলো দেয়ালচিত্র ও স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে। বিকৃত করা হলো ভাস্কর্যগুলোর চেহারা। স্মৃতির অতলে নিয়ে যাওয়া হলো তাদেরকে চিরদিনের জন্য। আতেন বা এথেনের উপাসনাও বন্ধ হয়ে গেলো এবং বহু ঈশ্বরবাদের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা হলো। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির সতেরো বছরের যৌথ শাসন শেষে তাদের মৃত্যুর পর মিশরের রাজধানী আবারো থিবসে স্থানান্তরিত করা হলো। আর আখেনাতেনের নতুন রাজধানী আমার্না একটি পরিত্যক্ত নগরী হয়ে প্রায় ৩০০০ বছরেরও বেশি সময়ের জন্য অন্ধকারে চলে গেলো।
তবে শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিলো নেফারতিতির সাথে? একুশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আখেনাতেনের মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে তিনি নেফারতিতিকে সহশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তাকে একটি নতুন নাম দেন। তবে আখেনাতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতি কি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেটি এক বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়। কারণ এটি নিশ্চিত যে, তিনি স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন এবং সেই উত্তাল সময়ে তিনি কি ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি।
ধারণা করা হয়, যেহেতু স্বামী জীবিত থাকতেই তাকে সহমর্যাদা দান করে গিয়েছেন, সেহেতু আখেনাতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতিই মিশরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী রাজা ও তার সৎ ছেলে তুতেনখামেনের রাজত্বের পথটিকে সহজ করবার জন্য কাজ করে গিয়েছেন। কারণ তুতেনখামেন একই সঙ্গে তার মেয়ে-জামাইও ছিলেন। তবে তুতেনখামেনের রাজত্বকে মসৃণ করার পেছনে তার এই রাজনৈতিক অবদানের জন্য তিনি কোনো কৃতিত্বই পান নি। আজ হতাশার সাথে বলতে হয়, প্রাচীন সময়ের এতো সমাদৃত ও প্রতাপশালী এই সম্রাজ্ঞীর সমাধি আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এই আকর্ষণীয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নেফারতিতি হাজার বছর ধরে আমাদেরকে মুগ্ধ করে রেখেছে। তবে যে রাজ্যের জন্য তিনি এতো কিছু করেছেন, সেখানে তার ঠাঁই হয়তো কোনোদিনই হয় নি। হয়তো তাকেও সইতে হয়েছে চরম অবজ্ঞা ও অবহেলা। ১৯১২ সালে খুঁজে পাওয়া আবক্ষমূর্তিটিরও স্থায়ী নিবাস হলো জার্মানিতে, মিশরে নয়।
একনায়ক হিটলারের মনকেও নরম করে দিয়েছিলো নেফারতিতির এই আবক্ষমূর্তিটি। যথার্থ মর্যাদায় একে সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘরও তৈরী করতে চেয়েছিলেন হিটলার। তিনি বলেছিলেন, জার্মানিতেই হবে রাণীর স্থায়ী আবাস এবং এখানকার সিংহাসনে বসেই রাজত্ব করবেন তিনি। কিন্তু তারপরই শুরু হয়ে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাদুঘরে অন্যান্য নিদর্শনের সাথে নেফারতিতির মূর্তিটির নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হলো। কখনো বাঙ্কারে, আবার কখনো লবণখনিতে স্থানান্তর করা হলো মিশরের নেফারতিতিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে হিটলার আর ছিলো না। তাই রাণীর জন্য আলাদা জাদুঘরও আর নির্মাণ করা হয় নি। আজও জার্মানির বার্লিনে নিউএস মিউজিয়ামেই রয়ে গেছে দুর্দান্ত প্রতাপশালী এক সম্রাজ্ঞীর আবক্ষমূর্তি। বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরও মিশর মূর্তিটি ফেরত পায় নি।
তিন সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকবার পর বিশ শতকের গোড়ার দিকে নেফারতিতির এই আবক্ষমূর্তির আবিষ্কার প্রাচীন মিশরের ধর্মচিন্তা, সৌন্দর্য ও ইতিহাস নিয়ে মানুষকে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি –এসব ধর্মের মতোই একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি প্রথম দেখেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে তার এই দর্শন আজও পৃথিবীর বুকে বিরাজ করছে। সকল একেশ্বরবাদীদেরই ৩০০০ বছরের প্রাচীন সেই সম্রাজ্ঞীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিৎ।
দুটি বিষয় এখানে ভীষণভাবে লক্ষণীয়। প্রাচীন সময়টাতে ইরান ও মিশরের মধ্যে ছিলো গাঢ় যোগাযোগ। প্রাচীনতম একেশ্বরবাদী ধর্ম বলতে আমরা জানতাম জরাথ্রুস্টবাদকে, যা জরাথ্রুস্টের মাধ্যমে ইরানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আর এরপর আরেকটি একেশ্বরবাদী ধর্মের সূত্রপাত ঘটে মূসার হাত ধরে। ধারণা করা হয়, জরাথ্রুস্টের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। আর মূসাও জন্মেছিলেন খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৩০০ বছর আগে। আজ তাই আমি একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চাই, আখেনাতেনের একেশ্বরবাদের সাথে তাদের কি কোনো যোগসূত্র ছিলো? আমার জিজ্ঞাসু মন বারে বারেই ইঙ্গিত দেয়, ইরানের জরাথ্রুস্ট এবং মিশরে জন্মগ্রহণ করা মূসা কি আখেনাতেন ও নেফারতিতির একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাস থেকেই অনুপ্রাণিত?
রেফারেন্স: