শের আলী

আন্দামানের আধুনিক ইতিহাসের শুরু ১৭৮৯ সালে, যখন ভাতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ কতৃক নিযুক্ত হয়ে আর্চিবল্ড ব্লেয়ার এই দ্বীপমালার একটি ভূতাত্বিক জরিপ সম্পাদন করেন। বৃটিশদের উদ্দেশ্য ছিল এখানে একটি ঘাটি ও উপনিবেশ স্থাপন করা, যাতে পূর্ব ভারতে আগমনরত জাহাজসমূহের জন্য এটি একটি যাত্রাবিরতি কেন্দ্র হতে পারে, বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর এবং ভারত মহাসাগরে বিচরনরত জলদস্যুদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রন আরোপ করা যায় এবং ভারতীয় ক্রিটিক্যাল বন্দীদের এখানে কারাদন্ড দেয়া যায়। তিনি সেই সম্ভাব্যতার অনুকূলে তার রিপোর্ট প্রদান করলে অনতিবিলম্বে ১৭৯০ সালে পোর্ট কর্ণওয়ালিশ নামে এখানে একটি বন্দর স্থাপন করা হয়, সেটিই এখন পোর্ট ব্লেয়ার, আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপুঞ্জের রাজধানী । এর আগে অবশ্য ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার এবং অষ্ট্রিরয়ানরা এখানে উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করে । তবে সে সব প্রচেষ্ট ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হয় । বিভিন্ন কারণে আন্দামানে বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টাও প্রথমবার ব্যর্থ হয় । পরে সিপাহী বিদ্রোহের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নতুন করে আবার উদ্যোগ নেয়া হয় । ১৮৯৩ সালে নির্মান করা হয় কুখ্যাত সেলুলার জেল, যেখানে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে নীত হয়েছেন অগনিত স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ।

লর্ড মায়ো

সেই আন্দামানই জন মানুষের কাছে কালাপানি ।ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন আকারের ২০৪টি দ্বীপ নিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। বড় দ্বীপটির দৈর্ঘ্য ৩৫৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৬০ কিলোমিটার । ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর বিদ্রোহীদের নৃশংসভাবে হত্যা করার পর যেসব বিদ্রোহী ফাঁসিকাষ্ঠ এড়াতে সমর্থ হয়েছেন, তাঁদের দূরবর্তী স্থানে বন্দী করার লক্ষ্যে ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশরা দ্বীপটি পুনর্দখল করে । কারাবন্দী ২০০ স্বাধীনতার সৈনিককে নিয়ে ১০ মার্চ ১৮৫৮ কুখ্যাত সুপারিনটেনডেন্ট জেবি ওয়াকার আন্দামান পৌঁছেন । “১৮৭২ সালে লর্ড মেয়ো যখন আন্দামান পরিদর্শনে যায় তখন সেখানে ভারতীয় বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭০০০ আর পুলিশের সংখ্যা ২০০।“(The Assassination of Lord Meyo by Hellen James) তাদের সবাই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি । বেশীরভাগ স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের সৈনিক । পায়ে শিকল পড়া অবস্থায় জোঁক ও সাপ-বিচ্ছু পরিপূর্ণ জলা ও জংলাভূমি পরিষ্কার করে পথঘাট তৈরি করাই ছিল এই কয়েদিদের দিন-রাতের কাজ । কাজে মন্থরতা দেখা দিলে তাঁদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো । চারদিকে অথৈ সাগর, পালানোরও কোন পথ নেই । তাসত্ত্বেও ১৮৬৮ সালের মার্চে ২৩৮ জন কয়েদি আন্দামান থেকে পালাতে চেষ্টা করেন । তাদের বেশীর ভাগের মৃত্যু হয় অনাহারে । আর যারা গ্রেপ্তার হয় সুপারিনটেনডেন্ট ওয়াকার নিজেই আদেশ দিয়ে তাদের হত্যা করে ।

১৮৬৯ সালে শের আলি খান নামে যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্য এক আসামীকে আন্দামানে পাঠান হয় । তখন তাঁর বয়স ২৫ বছর এবং উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি । শের আলীর আদি নিবাস উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যা বর্তমানে পাকিস্থানের অন্তর্গত । প্রথম জীবনে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে মাউন্ট পুলিসে কাজ করেন । পরে পেশওয়ারের কমিশনারের অধীনেও কাজ করেন । কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন এবং এক খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন । যদিও তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ বলে দাবী করেন । বিচারে প্রথমে তাঁকে ফাঁসীর আদেশ দেওয়া হয় । পরে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় । আন্দামানে ব্রিটিশ শাসনের ভয়ালরুপ তাঁকে বিচলিত করে তোলে । ইতিমধ্যে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যারা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের এখানে নির্বাসন দেওয়া হয় । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোহাম্মদ জাফর , ইয়াহিয়া আলী , মৌলবি আহমদুল্লা প্রমুখ । তাঁদের সংস্পর্শে এসে তাঁর মনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঘৃণার মনোভাব আরও তীব্রতর হয় । যদিও তিনি ছিলেন খুবই সরল , দয়ালু এবং ধর্ম ভীরু প্রকৃতির । জেলে মজুরি হিসাবে সামান্য যে পয়সা পেতেন তার সবটাই সহযোগী বন্দীদের মধ্যে বিলি করে দিতেন । এর ফলে বন্দীদের মধ্যে তিনি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন । অন্যদিকে দিন রাত একই চিন্তা , বিপদজনক নির্জন দ্বীপে নির্বাসন অবস্থায় অত্যাচারের বদলা কিভাবে নেওয়া যায় এবং দেশবাসীকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা যায় । ১৮৭২ সালে ৮ই ফেব্রুয়ারী সেই সুযোগ উপস্থিত হয় ।

ইতিমধ্যে ১৮৭১ সালে ভারতের প্রধান বিচারপতি অত্যাচারী নরম্যানকে জনৈক আবদুল্লা হত্যা করেন । নর্মান বহু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিশেষ করে ওহাবি আন্দোলনকারীদের মিথ্যা মামলায় কঠোর সাজা দেয় । তদানীন্তন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মেয়ো পরিকল্পনা নেয় কিভাবে এই তথাকথিত ওয়াহাবি আন্দোলনকারীদের নির্মূল করা যায় । ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকেই তারা মনে করত ভারতের মুসলিমরাই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু । “ By the end of September 1857, Delhi was a ghost town, entirely cleansed of Muslims, who were now increasingly viewed as the real enemy “ (C . Allen,”God’s Terrorists”) লর্ড মেয়োর উদ্দেশ্য ছিল প্রায় ২০০০০ হাজার ভারতীয় বন্দীদের কিভাবে আন্দামানের দুর্গম দ্বীপে নির্বাসনের ব্যবস্থা করা যায় ।

লর্ড মেয়োর পরিদর্শনের সংবাদ শুনে শের আলী খান তাঁর কর্তব্য স্থির করে ফেলেন অর্থাৎ যে ভাবেই হোক তাকে হত্যা করতে হবে । তিনি এটাও জানতেন তাঁকে দ্রুত আটক করা হবে এবং তাঁর মৃত্যু অবধারিত । তাই আগেই তাঁর হিন্দু মুসলিম সতীর্থদের কাছ থেকে বিদায় পর্ব সেরে নেন এবং তাঁর যে সামান্য অর্থ ছিল তা দিয়ে রুটি মিষ্টি খাওয়ান । নির্ধারিত পরিদর্শনের দিন সকাল থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন । কিন্তু সুযোগ পেলেন না । অবশেষে ভাইসরয় মাউন্ট হ্যারিয়েট থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে ফেরার সময় অন্ধকার নেমে আসে । সামনে আলো জ্বালিয়ে তাকে পথ দেখান হচ্ছে এবং চারিদিকে উচ্চপদস্ত কর্মচারীবৃন্দ আর সশস্ত্র বাহিনী । ঠিক পিছনে আন্দামানের সুপারিন্টেনডেন্ট ওয়াকার । উদ্দেশ্য জেটির ধারে ছোট নৌকায় চেপে তার জন্য নির্ধারিত জাহাজ গ্লাসগো তে চড়া । হঠাৎ ওয়াকার অন্যজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য পিছিয়ে পড়ে । সেই মুহূর্তে শের আলী খান বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের ছুরি দিয়ে ভাইসরয়ের পিঠে আঘাত করার সাথে সাথে ভাইসরয় লুটিয়ে পড়ে । তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় । কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ । ঐ আঘাতেই তার মৃত্যু হয় ।

ইতিমধ্যে শের আলী খানকে গ্রেপ্তার করা হয় । পরের দিন দ্রুততম বিচার সম্পন্ন হয় । বিচারের সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর সঙ্গে আর কেউ ছিল কি না । সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে জানায় তার এক মাত্র সঙ্গী ঈশ্বর এবং তাঁর ভাই অর্থাৎ Brother-in arms আব্দুল্লা যেভাবে প্রধানবিচারপতি নরম্যানকে হত্যা করেছে তার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই সে এ কাজ করেছে । প্রাণ ভিক্ষার জন্য কোন মার্জনা চায় নি । ১৮৭২ সালের ১১ই মার্চ ফাঁসির দিন ফাঁসির দড়িকে চুমু খেয়ে সেই দড়ি পড়ে নেন এবং ঈশ্বর ছাড়া কোন উপাস্য নাই এই কথা দুবার বলার পরই তাঁর শ্বাস রোধ হয়ে যায় । ব্রিটিশ সরকার এই ঘটনার কোন রাজনৈতিক রং দিতে চায় নি পাছে শের আলী খান শহীদের মর্যাদা পেয়ে যায় এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার প্রতীকে পরিণত না হয় । তাই সবকিছু অত্যন্ত গোপনে তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয় । শের আলী খান জানতেন, তাঁর দেশকে স্বাধীন করতে তাঁকে চরম মূল্য দিতেই হবে । তিনি তা-ই দিয়েছেন । তবে শের আলী খানের জন্য রচিত হয় না কোন শহিদ বেদি । একটা শুকনো ফুলও কোন দিন কেউ দেয় নি , এটাই সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ।