১৮২৪-৩১ সাল সময়ে উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল এমন কিছু মানুষের দ্বারা যারা নিজেদের পাগল বলে আখ্যায়িত করতো। করম শাহ নামের এক সূফী এই পাগল সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন। জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে সাধারণ কৃষকদের সাথে নিয়ে পাগলদের এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনে বৃহত্তর সফলতা  না আসলেও বিদ্রোহের ফলে অনেক অন্যায্য কর ও জমিদারদের উৎপীড়ন অনেকটা কমে গিয়েছিল।

উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের জাতিগত পরিচয় ছিল বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বেশ আলাদা। গারো, হাজং, রাজবংশী, ডুলু ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী ছিল এ অঞ্চলের মূল বাসিন্দা। এক পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলমানদের আগমন ঘটলে অঞ্চলটি একটি মিশ্র জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এই জায়গা বিদ্রোহী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রাদায়ের নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছিল। পাগলপন্থীরা ছিল এমনই এক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়। করম শাহ নামের এক পাঠান বংশীয় সূফী ১৭৭৫ সাল থেকে সুসং পরগণার লেতারকান্দা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় বৈচিত্র‍্যপূর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাসের মিশেলে তিনি নতুন এক আদর্শের গোড়াপত্তন করেন। এই পাগল মতবাদ অনুসারে সবাই যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি তাই সব মানুষই সমান। কারো সাথে কারো কোন ভেদাভেদ নেই, সবাই ভাইভাই। তার এই মতবাদে প্রকৃতি পূজক, হিন্দু, মুসলিম সবাই আকৃষ্ট হয়। প্রচলিত অহিংস উপাদান নিয়ে গঠিত হয় এই পাগলপন্থী দলের যারা একে অপরকে ভাই বলে সম্বোধন করতো। করম শাহ নিজে ছিলেন একজন ইসলাম ধর্ম পালনকারী ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি ফুঁ দিয়ে রোগ সারাতে পারতেন বলে কথিত আছে।

১৮১৩ সালে করম শাহের মৃত্যু হলে তার পদে আসীন হন পুত্র টিপু শাহ পাগল। টিপু শাহ ছিলেন সম্মোহনী ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। তিনি শেরপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে উচকিত কণ্ঠে প্রতিবাদ করেন৷ ফলে তার পেছনে স্থানীয় কৃষকগোষ্ঠী ও পাগল সম্প্রদায় জড়ো হতে থাকে। টিপু ও তার মাতার নেতৃত্বে পাগলপন্থী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। টিপু ধীরে ধীরে এতোই জনপ্রিয় হয়ে পড়েন যে তার শক্তিমত্তা বিষয়ে তার অনুসারীদের মনে এক নিরংকুশ আস্থা তৈরি হয়। ১৮২০ সালের দিকে কোম্পানি সরকার টিপু শাহকে বিপজ্জনক চরিত্র হিসেবে সন্দেহের তালিকায় লিপিবদ্ধ করে। একই সময় শেরপুরে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অসন্তোষ অব্যাহত থাকে। টিপু শাহ এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে নিজে জমিদার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এসময় তার বিরুদ্ধে জমিদাররা অনেক ফৌজদারি মামলা দায়ের করে।

পাগলপন্থীদের বিদ্রোহের শুরু হয়েছিল ১৮২৪ সালের দিকে। বার্মায় যুদ্ধজনিত অতিরিক্ত কর আরোপ, চাঁদা, বেগার খাটা ইত্যাদি প্রথার জন্য প্রজারা জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এসময় প্রজারা জমিদারদের আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং টিপু শাহকে তাদের নেতা বলে স্বীকার করে। পাগলরা প্রচারণা চালায় যে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে, পাগল টিপু হবেন নতুন জমিদার যেখানে কোন অন্যায্য কর আরোপ করা হবে না, কৃষকদের অত্যাচার করা হবে না। কৃষকরা পাগলদের সমর্থন দেয়। হঠাৎ করে টিপুকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার।  দুইদিন পর তাকে মুক্ত করে দেয়া হলেও আবার গ্রেফতার দেখানো হয়। এরমধ্যে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক ও পাগল সম্প্রদায়ের আন্দোলন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। ৬ জানুয়ারি, ১৮২৫ সালে শেরপুর পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে রায়তরা জড়ো হওয়া শুরু করলে টিপুকে আবার বন্দী করা হয়, শেরপুর শহরে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।

ময়মনসিংহে ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন সংস্কার ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। ঐতিহাসিক ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন একটি ঘর আজো আছে। এলাকাবাসী যার নামকরণ করেছেন ‘বিবির ঘর’ হিসেবে।

তবে সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এই আন্দোলনকে আরো উস্কে দেয়। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন জায়গায় নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও দুর্গ গড়ে তুলে। টিপুর নামে তারা সুলতানী ও সিরনি নামক চাঁদা আদায় করার পাশাপাশি রাজস্বও আদায় করা শুরু করে। ১৮২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বিদ্রোহীরা শেরপুর শহরে আক্রমণ চালায়। একপর্যায়ে তারা জমিদারদের বাড়ি লুট করে দুইজন বরকন্দাজকে হত্যা করে এবং চারজনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। এক মাস পর এই বন্দীদেরও হত্যা করা হয়। বিদ্রোহের তোপে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট এক আদেশ বলে কিছু অতিরিক্ত কর সংগ্রহ স্থগিত ঘোষণা করেন। কিন্তু বিদ্রোহ দমনে এবার জমিদার বাহিনী ও সরকারি পুলিশ বাহিনীর সম্মিলিত অভিযান শুরু হয়। এই বাহিনী গড় জরিপা নামের এক দুর্গে আক্রমণ করে। এখানে উভয়পক্ষের  কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর সশস্ত্র বিদ্রোহ আরো তীব্র হয়। বিদ্রোহীরা নিজেদের সাথীদের জেল থেকে ছিনিয়ে আনতে অভিযান চালায়। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৮২৫ তারিখে ৮০ জন পুলিশ ও সিপাহি কৃষক নেতা রামচন্দ্রকে আটক করতে মাদারপুর গ্রামে অভিযান চালায়। শেরপুর আক্রমণের প্রাক্কালে রামচন্দ্র ও আরো ২৩ জন বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে হাজার হাজার বিদ্রোহী পুলিশদের ঘেরাও করে। এখানে একটি বড়সড় সংঘর্ষ হয়। ১৬ মার্চের মধ্যে ১৪ জন নিহত হয়। এর মধ্যে চারজন বিদ্রোহী ও বাকি নিহত ছিল জমিদার ও সরকারের পক্ষের লোক।

এরপর বিদ্রোহ একটি স্বস্তির পর্যায়ে আসে। সশস্ত্র বিদ্রোহ কমে আসে। তবে সশস্ত্র বিদ্রোহ না চললেও এসময় বিদ্রোহীরা চাঁদা তোলা অব্যাহত রাখে এবং জমিদারদের কর দেয়া থেকে বিরত থাকে। এসময় পাগলপন্থী বিদ্রোহীরা শেরপুরে সমান্তরালে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন গড়ে তুলে। ১৮৩৩ সালে ফের বিদ্রোহ চাঙ্গা হয়। এসময় বিদ্রোহের নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। জানকো পাথের ও দুবরাজ পাথের নামের দুই নেতার নেতৃত্বে এই পর্যায়ের বিদ্রোহ শুরু হয়। উত্তর পশ্চিম শেরপুরের বাটাজোড় গ্রামে জড়ো হয় জানকোরের বাহিনী আর দুবরাজের বাহিনী মিলিত হয় নালিতাবাড়ী গ্রামে। এসময় দুই বাহিনী জমিদারদের বাড়ি ও রাজস্ব অফিস লুটপাট করে। পুলিশের অস্ত্রাগার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহীদের তোপের মুখে জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনী পালিয়ে গিয়ে ময়মনসিংহ সদরে আশ্রয় নেয়। পাগল বিদ্রোহীরা নিজেদের শাসক হিসেবে ঘোষণা করে। সাময়িক সময়ের জন্য শেরপুরে কোম্পানির শাসনের পতন হয়।

কিন্তু ১ এপ্রিল আবার সরকারি বাহিনী শেরপুর পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। এদিকে পাগলদের চোরাগোপ্তা হামলা অব্যাহত থাকে। শেরপুরে ফের সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এপ্রিল মাসে বিদ্রোহীরা আবার শেরপুর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এসময় বিদ্রোহী রায়তরা পুরো শেরপুর পাহারা দিতে থাকে। ২৮ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সেনাদের একটা অংশ নালিতাবাড়ীর দিকে, আরেকটি অংশ বাটাজোড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এসময় প্রায় পাঁচ হাজার পাগল ও কৃষক বিদ্রোহী দেশীয় অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীকে পিছু হটায়। ৩ মে সেনাবাহিনী পালটা আক্রমণ চালালে বিদ্রোহীরা গারো পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এভাবে একের পর এক বিক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর  জানকো ও দুবরাজের সাথে বিদ্রোহে অংশ নেয়াদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনেকে সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৮৩৩ সালের ১৩ মে বিদ্রোহ চূড়ান্তভাবে শেষ হয়। জানকো ও দুবরাজ আত্মগোপনে চলে যান। ১৮৩৩ সালের পর বিদ্রোহ আর দেখা যায়নি।

এই বিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো টিপু শাহের নামে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও টিপু ও তার মাতা সবসময় সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে দূরে ছিলেন। তারা ছিলেন প্রতীকী নেতা মাত্র, টিপুকে বিদ্রোহীরা নেতা হিসেবে চেয়েছিল এবং তাকেই আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এমনকি টিপু যখন জেলে ছিলেন তখনও টিপুই ছিলেন তাদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের চেতনা। ২৫ বছর কারাগারে থাকার পর ১৮৫২ সালে কারাগারেই মৃত্যু হয় টিপু শাহের।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশ
নিম্নবর্গ, দ্রোহ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ
(১৭৬৩-১৯৫০), মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

পাগলপন্থী আন্দোলন – Bangla Pedia

বঙ্গদেশে বৃটিশ-বিরোধী সংগ্রাম ও পাগলপন্থী বিদ্রোহ