গৌড় নগরী ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যযুগের অন্যতম বৃহত্তম নগরী। এটি প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রাচীন এই গৌড় নগরী লক্ষণাবতী নামেও পরিচিত। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই দুর্গনগরীর অধিকাংশ এলাকা পড়েছে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলায় এবং কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। শহরটির অবস্থান ছিল গঙ্গানদীর পূর্ব পাড়ে, রাজমহল থেকে ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে এবং মালদার ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে। গৌড় নগরের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের বহু ইতিহাস। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে যে অংশটুকু পড়ে আছে প্রকৃতপক্ষে তার পুরোটাই ধ্বংসাবশেষ। গৌড় নগরীতে ফুলওয়ারি দুর্গ, বড় সোনা মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ, তাহখানা কমপ্লেক্স, লুকোচুরি দরওয়াজা, ছোট সাগর দীঘি, গুণমন্ত মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, কোতয়ালী ফটক সহ বেশ কিছু পুরনো নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আজকে আমরা বড় সোনা মসজিদ ও ছোট সোনা মসজিদ নিয়ে আলোচনা করবো।

বড় সোনা মসজিদ:

সুলতানি বাংলার রাজধানী গৌড়ের সর্ববৃহৎ মসজিদ বড় সোনা মসজিদ এবং এটি বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের চরম উৎকর্ষের নিদর্শন। মসজিদটি সাধারণত ‘বারোদুয়ারী’ বা বারো দরজা বিশিষ্ট মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদটি ইটের গাঁথুনির উপর পাথরের আস্তরণে নির্মিত। সামনের ভাগে রয়েছে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বিস্তৃত বারান্দা, ১১টি প্রবেশপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ১টি করে প্রবেশপথ।

উত্তর ও দক্ষিণ দিকে অতিরিক্ত তিনটি করে প্রবেশপথ সহ মসজিদটি তিন আইল বিশিষ্ট। আয়তাকার পুরু স্তম্ভের উপর বসানো আছে মোট ৪৪টি গম্বুজ। বর্তমানে শুধু বারান্দার উপরের গম্বুজগুলো এবং মসজিদের পার্শ্বদেয়াল টিকে আছে।

শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি ১৫২৩ সালে সুলতান নাসিরউদ্দিন  নুসরত শাহ এর নির্মাতা। আবার কারো কারো মতে, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে এটি নির্মিত বলে ধারনা করা হয়।

ছোট সোনা মসজিদ:

সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন বলা হয় ছোট সোনা মসজিদকে। গৌড়ের ফিরুজপুরের তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিন-পূর্বে বিশাল এক দিঘির দক্ষিণ পাড়ের পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে এই মসজিদটি অবস্থিত। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মুহম্মদ বিন আলী মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়।

ছোট সোনা মসজিদ ১৮০৮

শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখের অক্ষরগুলি মুছে গেছে। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের নাম উল্লেখ থাকায় মনে করা হয়, ছোট সোনা মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) কোনো এক সময় নির্মিত। মসজিদটিতে ১৫ টি গম্বুজ রয়েছে, তবে মাঝখানের ৩ টি বাংলার কুঁড়ে ঘরের মতো চৌচালা আকৃতির গম্বুজ। গম্বুজগুলোতে সোনার গিল্টির ব্যবহার করা হয়েছিল এবং দেখতে সোনালী ছিল  বলে এর নাম সোনা মসজিদ হয়েছে। ক্রাইটন ও কানিংহাম মসজিদটির ছাদের উপর পনেরোটি গম্বুজ ও খিলান ছাদের সবগুলিই গিল্টি করা দেখতে পান।

ছোট সোনা মসজিদের পেছনের অংশ

কিন্তু বর্তমানে গিল্টির কোনো চিহ্ন নেই। ইট ও পাথরে নির্মিত মসজিদটির বিভিন্ন অলংকরণ দিয়ে সজ্জিত। খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিভিন্ন বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালির নকশা মসজিদটিকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে। তাছাড়া, এর প্যানেলের কিনারগুলিতে লতাপাতার নকশা এবং শিকল ও ঘণ্টার মোটিফ অনুসরণে বিভিন্ন ধরনের ঝুলন্ত অলংকরণ করা হয়েছে।

ছোট সোনা মসজিদ, বাইরে থেকে

মসজিদের খিলানের স্প্যান্ড্রিল ও ফ্রেমের উপরের স্থানগুলি গোলাপের আকর্ষণীয় অলংকরণ করা হয়েছে। যদিও মসজিদটির পুরনো ও প্রকৃত সৌন্দর্য আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে ছোট সোনা মসজিদ বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত নিদর্শন।

তথ্যসূত্র:

১- Henry Creighton, Ruins of Gaur, London, 1817.

২- JH Ravenshaw, Gaur, Its Ruins and Inscriptions, London, 1878.

৩- M Abid Ali Khan, Memoirs of Gaur and Pandua, Calcutta, 1986.

৪- ‘Archaeological Reconnaissance at the City of Gaur: A Preliminary Report’ by Aniruddha Ray.

৫- উইকিপিডিয়া।

৬-বাংলাপিডিয়া।