সেই মানুষটির নামে কোনো রাস্তা নেই কিউবায়, নেই কোনো মূর্তিও; তাতে কী যায় আসে? দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কোটি মানুষের মনে যে তাঁর নাম। ১৯৫৯ সালে পশ্চিম গোলার্ধে কমিউনিজমের সূত্রপাত হয়েছিল যাঁর হাত ধরে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সেই অগ্রদূতের নাম ফিদেল কাস্ত্রো। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর তিনিই একমাত্র রাষ্ট্রনেতা যিনি এত লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সারাজীবন জোয়ারের বিপরীতে সাঁতরে জয়ীর মুকুট পরেছিলেন; যিনি ধনতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে ১১ জন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আমেরিকাকে কিউবা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি ফিদেল কাস্ত্রো।
১৯২৬ সালের ১৩ই অগাস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ওরিয়েন্তে প্রদেশে বিরান শহরে স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক উদ্বাস্তু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজ। ফিদেলের বাবা ছিলেন স্পেন থেকে কিউবাতে আসা একজন ধনী আখ চাষী এবং চিনিকল মালিক অ্যাঙ্গেল মারিয়া বাতিস্তা কাস্ত্রো। তাঁর খামারের পরিচারিকা ছিলেন ফিদেলের মা লিনা রুৎজ গঞ্জালেস, ফিদেলের জন্মের পর যাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন অ্যাঙ্গেল। ভাই রাউল ও র্যামন ছাড়াও ফিদেল বড় হয়েছেন বোন অ্যাঞ্জেলা, এমা ও অগাস্টিনার সাহচর্যে।
ফিদেলের পড়াশোনা শুরু হয় প্রাইভেট জেসুইট বোর্ডিং স্কুলে। স্কুলে থাকতেই পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় খ্যাতি ছিল ফিদেলের। সব মিলিয়ে স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে হিসেবে আইনজীবী হয়ে সহজ-সরল দিন কাটানো তাঁর জন্য কঠিন ছিল না। কিন্তু ফিদেল বেছে নেন বন্ধুর পথ। স্কুলের পর সান্তিয়াগোর ডলোরস কলেজ এবং হাভানার বেলেন কলেজ পেরিয়ে কাস্ত্রো হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। ১৯৪০-এর দশকে সেখানেই ফিদেল জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। বাবা অ্যাঞ্জেল তখন মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করতেন। কিন্তু ফিদেল হাঁটলেন উল্টো পথে।
১৯৪৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকে তখনকার স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোকে উৎখাতের এক বিদ্রোহে অংশ নেন ফিদেল। তাতে ব্যর্থ হলেও দমে যাননি তিনি। সেবছরই নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ফিদেল। ১৯৪৮ সালে কিউবার এক রাজনীতিবিদের কন্যা মার্তা দিয়াজ বালার্তকে বিয়ে করেন ফিদেল। ধীরে ধীরে তাঁর মনে কিউবান জাতীয়তাবোধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কারণে দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব এবং একমাত্র জনগণের বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
১৯৫২ সালের নির্বাচনে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন ফিদেল। নির্বাচনে পিপলস পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও নির্বাচনের আগে ১০ই মার্চ জেনারেল ফুলগেন্সিও বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রিয়র সরকারকে উচ্ছেদ করেন। বাতিস্তা কিউবার ক্ষমতা দখল করে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করলে কাস্ত্রো ও তাঁর দলের কয়েক সদস্য মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। এসময় কিউবা পরিণত হয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের স্বর্গরাজ্যে। যৌন ব্যবসা, জুয়া এবং মাদক চোরাচালান চরম আকার ধারণ করেছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে বিপ্লবই একমাত্র পথ, এই ভাবনা থেকেই তাঁরা ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালের ২৬শে জুলাই ‘দ্য মুভমেন্ট’-এর ১৫০ জন সদস্য কিউবার সান্তিয়াগোতে থাকা মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করে। ওই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বহু বিপ্লবী হয় নিহত হয় নয়তো ধরা পড়ে। কাস্ত্রো বন্দী হন।
এরপর এক ‘প্রহসন’-এ তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারে ফিদেলের জীবিত সহযোগীদেরও নানা মেয়াদে সাজা হয়, এর মধ্যে তাঁর ছোটভাই রাউলও ছিলেন। জেলে থাকার সময় ফিদেল তাঁর দলের নাম বদলে রাখেন ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই মুভমেন্ট’। বিচারকালে আদালতে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা জানিয়ে ভাষণ দিতেন তিনি। এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে অপরাধী বানাতে পারো, কিন্তু ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে।” আসলে বিচারের শুনানিগুলিকে কাস্ত্রো ব্যবহার করতেন সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে। এসময় শুনানিগুলোতে বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার থাকায় কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ফলে ১৫ বছরের সাজা ঘোষণা হলেও প্রবল জনমতের চাপে মাত্র ২ বছরের জেল খেটে ১৯৫৫ সালের মে মাসে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোয় পাড়ি দেন ফিদেল।
মেক্সিকোতে পৌঁছে তিনি একটি গেরিলা বাহিনী তৈরি করেন। সেখানেই দেখা হয় আর্জেন্টিনার বিপ্লবী ডাক্তার চে গেভারার সঙ্গে; চে’ও তখন স্বপ্ন দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার সমাজ বদলের। সেখানেই ফিদেল, রাউল ও চে কিউবায় ফিরে গিয়ে বাতিস্তা সরকার উৎখাত করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তাঁরা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ২রা ডিসেম্বর ফিদেল আর তাঁর ৮২ জন সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকা ‘গ্রানমা’-য় চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলের মানজানিলোতে আসার খবর পেয়ে বাতিস্তা সেখানে বাহিনী পাঠান। ফিদেলরা নামার সময় গুলি চালানো হলে বেশ কিছুজন নিহত অথবা কারাবন্দী হন। চে আর রাউলসহ ২২ জনকে নিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পার্বত্য জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন ফিদেল। সেখানে বিদ্রোহীদের ছোট অংশটি পুনরায় সংঘবদ্ধ হয় এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করে।
সশস্ত্র দল ও পর্যাপ্ত অস্ত্রভাণ্ডার মজুত করে চে গেভারা, খুয়ান আলমেদা প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়ে কিউবায় ফেরত আসেন কাস্ত্রো। তারপর বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এবারও বহু গেরিলা সৈন্য সরকারের আক্রমণে প্রাণ হারায়। তবে এসবের মাঝেই ফিদেলের সমর্থনে একজোট হতে শুরু করে কিউবার যুবসমাজ, সমর্থন বাড়তে থাকে কিউবার মধ্যবিত্তশ্রেণীরও। গেরিলা বাহিনীকে জেনারেল বাতিস্তার সেনা পাঠিয়ে দমনের চেষ্টা বিফল হয়। বেশি কিছু সেনা গেরিলা দলে যোগ দেয়। ১৯৫৮-র শেষ দিক থেকে ফিদেল বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। গেরিলা সৈন্যরা কিউবার রাজধানী হাভানা ঘিরে ধরতে শুরু করলে ১৯৫৯ সালের ১লা জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালিয়ে বাতিস্তা আশ্রয় নেন ডমিনিকান রিপাবলিকে। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ৯ই জানুয়ারি কিউবা দখলে নেয় ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই মুভমেন্ট’; জয়ী হন কাস্ত্রো, জয় হয় বিপ্লবের।
ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থন নিয়ে ঐবছরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যানুয়েল উরুতিয়া; হোসে মিরো কর্দোনা হন প্রধানমন্ত্রী। ফিদেলকে দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব। পরের মাসেই মিরো পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেল। দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ‘ফার্স্ট এগ্রেরিয়ান রিফর্ম অ্যাক্ট’ পাশের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন এবং কিউবায় বিদেশি কোম্পানির সম্পদ জাতীয়করণ করেন, করেন ভূমি সংস্কার। কারখানা এবং খামারগুলোকে জাতীয়করণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি ঘটতে থাকে কিউবার। কাস্ত্রোও ধীরে ধীরে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ওই সময় কাস্ত্রো বারবার বলেছেন, তিনি ‘কমিউনিস্ট’ নন, যদিও তার সরকারের রূপরেখার সঙ্গে সোভিয়েত ঘরানার মিল পাওয়া যাচ্ছিল।
১৯৬১ সালে ক্যারিবীয় সাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটির এই স্পর্ধায় ফিদেল কাস্ত্রোকে উৎখাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তৎপর হয়ে ওঠে। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের প্রশিক্ষণে ওই বছরই কিউবা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১৪শ’ দেশত্যাগী কিউবার ‘বে অফ পিগ’-এ ফিরে ফিদেলকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। কিউবার বিপ্লবীবাহিনী ওই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে। প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনায় নিজেদের দায় অস্বীকার করলেও পরে মার্কিন সম্পৃক্ততা প্রকাশ পায়।
১৯৬০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তেল কেনার চুক্তি করেন ফিদেল। যুক্তরাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ওই তেল পরিশোধনে আপত্তি জানালে ফিদেল তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে চিনি কেনার নির্ধারিত কোটা বাতিল করে; চাপিয়ে দেয় নিষেধাজ্ঞা। ক্ষমতায় আসার পর ১৯৬১ সালই ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য সবচেয়ে সঙ্কটকালীন বছর। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে ছেদ টানে। তারপর ওই বছরের এপ্রিলে ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাকে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করলে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
১৯৬২ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে জুপিটার মিসাইল বসানোর পাল্টা হিসেবে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল বসানোর গোপন পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো ও রুশ নেতা নিকোলাই ক্রুশ্চেভ। খবর পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি রাশিয়াকে কিউবা থেকে মিসাইল সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান; সেই সঙ্গে তাঁর দেশের বাহিনীকে কিউবার জলসীমা অভিমুখী সব জলযানে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দেন। ১৩ দিনের আলাপ-আলোচনার পর কিউবায় মিসাইল বসানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বদলে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে তাদের মিসাইল সরিয়ে নেয় এবং কিউবায় হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
১৯৬৫ সালে কাস্ত্রো কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নিজের দলকে মিশিয়ে নিজে হন দলের প্রধান। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একনিষ্ঠ সমালোচক হিসেবে। ১৯৬৬ সালে কাস্ত্রো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে গড়ে তোলেন নানান সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পরের বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘লাতিন আমেরিকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’, যার হাত ধরে এর পরের কয়েক দশকে ওই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। ১৯৭০ এর দশকে কাস্ত্রো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সোভিয়েত বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে সামরিক সহায়তাও পাঠান। তাঁর পাঠানো সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনে। ঐ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সাহায্য করলেও বিভিন্ন দেশে সেনাসাহায্য পাঠাতে গিয়ে টান পড়ে কিউবার অর্থনীতিতে; পরে এ ধরনের অভিযান থেকে সরে আসেন ফিদেল। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে যোগ দেন কাস্ত্রো।
ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ জন প্রেসিডেন্টের বদল ঘটে। বলা হয়, ১০ জনের চেষ্টায়ও উৎখাত করা যায়নি এক ফিদেলকে। বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যায় বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। কিউবার গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, কেবল সিআইএ কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য ৬৩৮টি চেষ্টা চালিয়েছে, যার মধ্যে আছে সিগারেটে বিস্ফোরক বা স্কুবা ডাইভিং স্যুটে বিষ মাখিয়ে; ছিল মাফিয়া স্টাইলে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও। যুক্তরাষ্ট্রের এই ধারাবাহিক চেষ্টাকে নিয়ে কৌতুকও করেছেন ফিদেল কাস্ত্রো। বলেছেন, “হত্যার চেষ্টা এড়িয়ে যাওয়ার যদি কোনো অলিম্পিক ইভেন্ট থাকত, তাহলে নির্ঘাত তাতে স্বর্ণপদক জিততাম আমি।”
১৯৮০-র দশকে বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘুরতে শুরু করে। মিখাইল গর্ভাচেভের নেতৃত্বাধীন মস্কো কিউবা থেকে চিনি কিনতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও অব্যাহত থাকায় কিউবা বিরাট বিপদে পড়ে যায়। খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এই সময় ফিদেল কাস্ত্রো ঘোষিত বিশ্বের সবচাইতে অগ্রসরমান কিউবা কার্যত মান্ধাতা যুগে ফিরে যায়। ১৯৯০ এর দশকে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে হাজার হাজার কিউবান ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় সমুদ্রে পাড়ি দেয় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এসময় বহু মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। অনেকেই এই মৃত্যু এবং হাজার হাজার কিউবানের আমেরিকায় যাত্রাকে দেখেছেন ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতি অনাস্থার নিদর্শন হিসেবে।
১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়। সোভিয়েতের দেশগুলোতেই সিগারেট এবং অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করত কিউবানরা; ওই জোটের কাছ থেকে কম মূল্যে পেত তেলও। ধস ঠেকাতে নতুন পন্থা নেন ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কিউবার উপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ দেওয়া শুরু করেন। এ সময় কিউবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্ত বাজার অর্থনীতি পদ্ধতি চালু হয়। উৎসাহ দেওয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগকেও।
ডলারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সঙ্গে স্বল্প আকারে পর্যটনও চালু করেন ফিদেল। প্রায় চার দশক পর ১৯৯৬ সালে আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ফিদেল; সেখানে দেশত্যাগী কিউবানদের নিজ দেশে ফিরে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান তিনি। ২০০১ সালে হারিকেন মিশেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কিউবায় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠাতে চাইলেও তা ফিরিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নগদ টাকায় খাদ্য কেনার প্রস্তাব দেন ফিদেল। এরপর বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ধীরে ধীরে রাউল কাস্ত্রো নেতৃত্বাধীন কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক বদলাতে থাকে। তবে ওবামার হাভানা সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ মুক্ত না হওয়ায় ওবামাকে সাক্ষাৎ দেননি বলে পরে লেখেন কাস্ত্রো। তিনি বলেন, “সাম্রাজ্যের কাছ থেকে কোনো উপহার আমাদের দরকার নেই।”
দেশ শাসনের ক্ষেত্রে কাস্ত্রো সোভিয়েত ইউনিয়নের মডেলটি গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি সুসংগঠিতভাবে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তখন থেকে কিউবা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নীতি মেনে শাসিত হয়ে আসছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে একদলবিশিষ্ট কিউবার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। সারাবিশ্বে যখন কমিউনিস্ট সরকারগুলো ধসে পড়ছে ঠিক তখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৃহত্তম শত্রু বলে পরিচিত আমেরিকার দোরগোড়াতেই সমাজতন্ত্রের ধারা প্রচলিত করেন কাস্ত্রো। তাঁর সময়ে কিউবা জুড়ে ১০ হাজার নতুন স্কুল খোলা হয়; শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া হয় পাহাড়ি, দুর্গম প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে। এর ফলও মেলে হাতেনাতে; অল্প সময়ের মধ্যে কিউবার সাক্ষরতার হার হয়ে দাঁড়ায় ৯৮ শতাংশ। কাস্ত্রোর হাত ধরেই কিউবা গড়ে তোলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা; কিউবানরা এখন এমন এক সমাজব্যবস্থায় বসবাস করছেন যেখানে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে মাত্র ১১ জন। এভাবেই তিনি কিউবাকে দিয়েছেন প্রথম বিশ্বের সমতুল্য শিক্ষার হার, আর এক উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা যা অনেক দেশের কাছে ঈর্ষণীয়। কিউবানদের গড় আয়ু এবং শিশুমৃত্যুর অতি নিম্ন হারও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তুলনীয়। জ্বালানি সরবরাহের পরিমাণ কমে গেলে তিনি ১১৮টি কারখানা বন্ধের আদেশ দেন এবং ভেনিজুয়েলায় চিকিৎসক পাঠিয়ে সেদেশ থেকে আমদানি করা তেলের অর্থ শোধ করেন।
তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে সমাজতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতেন, যিনি জনগণের কাছে কিউবাকে ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সমালোচনায় মুখর পশ্চিমারা তাকে ‘অধিকার হত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। তাঁর আমলে বন্ধ হয়েছে পেশাজীবী আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়নের ধর্মঘট করার অধিকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি গণমাধ্যম, বিপাকে পড়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়ন ও সেসব দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন এবং জোরপূর্বক দেশত্যাগ করানোরও অভিযোগ আছে ফিদেলের বিরুদ্ধে। কিউবার নতুন সরকার জনগণকে সব জমি বুঝিয়ে দেবার এবং গরীবের অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু একই সাথে দেশে একটি এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। রাজবন্দী হিসেবে বহু মানুষকে কারাগারে এবং শ্রম শিবিরে প্রেরণ করা হয়।
নব্বই দশকের শেষদিক থেকে কাস্ত্রোর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে থাকে। ২০০৬ সালে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনালে রক্তক্ষরণ হওয়ায় কাস্ত্রোর একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। ওই বছরের ৩১শে জুলাই আচমকা এক ঘোষণায় ছোটভাই ও সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষনেতা রাউলের হাতে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেন ফিদেল। ২০০৮ এর ১৯শে ফেব্রুয়ারি কাস্ত্রো আনুষ্ঠানিকভাবে কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ৭৬ বছর বয়সী ছোট ভাই রাউলের হাতে ছেড়ে দেন। কিউবার জাতীয় কংগ্রেস রাউলের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। ফিদেল হন কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি। ২০১১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে রাউলকেই শীর্ষনেতা মনোনীত করে দলের নেতাকর্মীরা। ফিদেল কাস্ত্রো তখন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, পাঁচ বছর আগেই তিনি দলের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, বাকিটুকু ছিল আনুষ্ঠানিকতা।
অবসরে নিজের অভিজ্ঞতা ও মত পত্রিকায় প্রকাশ করতে ‘রিফ্লেকশন অব ফিদেল’ নামে কলাম লেখা শুরু করেন ফিদেল। ২০০৭ সালে তার আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়। ২০১১-র নভেম্বর থেকে পরের বছর জানুয়ারি পর্যন্ত পত্রিকায় ফিদেলের কলাম না পেয়ে তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। তবে জানুয়ারিতেই সেই নীরবতা ভেঙে আবারও ফিরে আসেন ফিদেল। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বে না থাকলেও দেশ এবং দেশের বাইরে তাঁর প্রভাব ছিল আগের মতোই। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ধারাবাহিক সাক্ষাৎ করে যাচ্ছিলেন ফিদেল। ভেনিজুয়েলার উগো চাবেস (প্রয়াত), নিকোলাস মাদুরো, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসসহ লাতিন আমেরিকায় কিউবাঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তাঁর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
২০০৮ সালে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর প্রকাশ্যে খুব একটা আসতেন না ফিদেল। অস্ত্রোপচারের পর বেশ কিছুদিন জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে থেকে ফিদেল কাস্ত্রো কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও জনসম্মুখে তার উপস্থিতি ক্রমশ কমে আসতে থাকে। ২০১৬ সালের ২৫শে নভেম্বর বিশ্ববাসীকে শোকস্তব্ধ করে লাতিন আমেরিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মানুষের এই মুক্তির দূত না ফেরার দেশে পাড়ি দেন।
“১৯৫৯ সালে যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন খুব কম লোকই ভাবছিল ফিদেল কাস্ত্রো কিছু করতে পারবেন,” বলেছিলেন কিউবা বিষয়ক আমেরিকান বোদ্ধা ড্যান এরিকসন। কিন্তু থেমে থাকেননি ফিদেল। বিপক্ষ মত, দেশের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ, হত্যার ষড়যন্ত্র পেরিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি; যা টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও। দেশে বিরোধীদের চোখে তিনি ‘স্বৈরাচারী’, পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাছে তাঁর পরিচয় ‘একনায়ক’; বিপরীতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তিনি ‘আস্থার প্রতীক’, অনুসারীদের কাছে তিনি ‘এল কমান্দান্তে (দি কমান্ডার)’, মুক্তিসংগ্রামী সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘কিংবদন্তী’। বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টদের দুর্দিনের মধ্যে কংগ্রেসে ভাষণে তিনি কিউবাবাসীদের উদ্দীপ্ত করে বলেছিলেন, “কমিউনিজম এখনও প্রাসঙ্গিক, কিউবা বিজয়ীই থাকবে।”
লেখা – শোভন
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel