“আমার গায়ে যত দুঃখ সয় বন্ধুয়ারে … করো তোমার মনে যাহা লয়”।

হৃদয় স্পর্শ করা গানটি বারি সিদ্দিকীর কন্ঠে শোনা যায় হুমায়ুন আহমেদের “শ্রাবণ মেঘের দিন” ছবিতে, গানটি সবার মন ছুঁয়ে গেলো। তখনই সবাই জানলো গানটির রচয়িতা ‘বাউল উকিল মুন্সী’।

ধনী পিতা গোলাম রসুল আকন্দ ছেলের নাম রাখেন আব্দুল হক আকন্দ।তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালে নেত্রকোনা জেলার জৈনপুর গ্রামে। সেই গ্রামের পাশেই বয়ে যেতো বেতাই নদী।

উকিল মুন্সী যেহেতু ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, তাই বাবার তত্ত্বাবধানে তিনি বাংলা, ফার্সি ও আরবি ভাষায় লেখাপড়া শিখেন। ছোটবেলায় তাঁর বাবা- মায়ের ইচ্ছা ছিলো, ছেলে বড় হয়ে একজন উকিল হবে, তাই তাঁরা আদর করে তাঁকে উকিল বলে ডাকতেন। পরে তিনি মসজিদে ইমামতি করেন, তখন তাঁর নামের শেষে ‘মুন্সি’ টাইটেলটি যুক্ত হয়। একদিন তাঁর ‘আব্দুল হক আকন্দ’ নামটি হারিয়ে যায় এবং তিনি ‘উকিল মুন্সী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। তাঁর দশ বছর বয়সে বাবা মারা গেলে তাঁর মা আরেকটি বিয়ে করেন।সেখানে সৎ ভাইয়ের জন্মের পর তিনি অবহেলার কারনে অভিমান করে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু সেখানেও অবহেলা আর অনাদর হয় তাঁর নিত্যসঙ্গী, পরে তাঁর ফুপু তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে যান, কিন্তু পারিবারিক অশান্তির কারণে তাঁকে বেশিদিন তার কাছে রাখতে পারেননি। আবার নিজগ্রামে ফিরে আসেন, পড়ালেখা আর আগালো না। যখন তাঁর বয়স আঠারো / উনিশ বছর, তখন তিনি বাবার সম্পত্তি বিক্রি করা শুরু করেন, এতে করে সাময়িকভাবে তাঁর অভাব দূর হয়,কিন্তু তাঁর অন্তরে তৈরি হয় এক গভীর হাহাকার, অতৃপ্তি এবং অবহেলার ফলে তিনি ঘর ছাড়েন। তবে মনের ভিতরের গভীর শূণ্যতা তাঁর পেছন ছাড়লো না।

তখন সেই অঞ্চলে ‘ঘেঁটু’ গানের প্রচলন ছিলো,তিনি কাত জেগে নিয়মিত সেগুলি দেখতেন, পরে নিজেই ঘেঁটু গান রচনা করে গাওয়া শুরু করলেন। তাঁর কন্ঠ সবাইকে মুগ্ধ করলো। তখন থেকেই তিনি ঘেঁটু গানের দলের সাথে গান গাওয়া শুরু করলেন। নেত্রকোনা,হবিগঞ্জ,কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ সহ ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে ঘেঁটু গান পরিবেশন করতেন।অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সেই অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, এবং তার নাম চরিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। একুশ/ বাইশ বছর বয়সে তিনি মোহনগঞ্জের জালালপুর গ্রামে প্রভাবশালী চাচার বাড়িতে চলে যান, সেখানে তিনি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হামিদা আক্তার খাতুনের প্রেমে পড়েন। এতে করে চাচার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়, দরিদ্র পরিবারে সম্পর্ক করার কারণে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তিনি পাগলের মতো নিজ গ্রামে ফিরে আসেন, কিন্তু আত্মীয়রা কেউই হামিদার সাথে বিয়েতে রাজী হয় না। তখন তিনি মোহনগঞ্জের জৈনপুর,শ্যামপুর, আটবাড়ি এরকম নানা জায়গায় দিন কাটাতেন। কারো সহযোগিতা না পেয়ে তিনি পানির দামে সম্পত্তি বিক্রি করতে থাকেন, তখন তাঁর বয়স তিরিশ বছর। তিনি মসজিদে ইমামতি ও বাচ্চাদের আরবি পড়া শিখাতে লাগলেন। নির্জনে একা একা থাকতে থাকতেই তিনি গজল রচনা করে নিজেই গাইতেন। দিনগুলি তাঁর মনঃকষ্টে কাটছিলো।

কুলিয়াটি গ্রামে উকিল মুন্সীকে নিয়ে ভাটি বাংলার বিভিন্ন এলাকার বাউল শিল্পীরা আখড়া গড়ে তোলেন।এটাই ছিলো তখনকার বাউলদের ঠিকানা।এই কুলিআটি গ্রামটি আসলে অনেক বাউলেরই আঁতুড়ঘর। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে… হৃদয় সরকার,আব্দুল জলিল,ধনাই খাঁ,আবু চাঁন ও নুরুল ইসলাম, তাঁরা উকিল মুন্সীর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন।

মরমী এই শিল্পী সৃষ্টিতত্ত্ব,দেহতত্ত্ব,গুরুতত্ত্ব,লোকতত্ত্ব, গানের মধ্যে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে ঐ সময়ের মালজুড়া গানে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করতেন।উকিল মুন্সী নিজের লেখা গানই বিভিন্ন পালাগানে গাইতেন। ভরা বর্ষায় তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন, তখন লিখতেন বিরহের গান।এমনই দরদ দিয়ে গাইতেন যে, নিজেও কাঁদতেন, অন্যদেরও কাঁদাতেন। গানের জগতে তিনি ছিলেন এক বিরহী ডাহুক। নারী- পুরুষের প্রাণের আকুতি,প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ,বিরহ গাঁথা নিয়ে গান লিখতেন এবং সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করতেন।

তিনি মসজিদে ইমামতি করতেন, কোরান তেলাওয়াৎ করে তার ব্যাখ্যা দিতে পারতেন,হাদিসের ব্যাখ্যাও দিতে পারতেন। যাদের নামাজের ইমামতি করতেন,তারাই আবার তাঁর গানের শ্রোতা হতেন।তাঁর গান শুনে মানুষ চোখের পানি আটকাতে পারতেন না।

উকিল মুন্সীর অনেক বিরহ গাঁথার মধ্যে একটি হচ্ছে … “পূবালী বাতাসে, আমি বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসেরে…” এই গানটির মধ্যে একটি গ্রাম্যবধুর নাইওর যাবার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর অসংখ্য গানের মধ্যে দুই’শো গান খুঁজে পাওয়া যায়।

উকিল মুন্সীসহ তখনকার বাউলরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানুষে মানুষে বন্ধন ভ্রাতৃত্ব ও কল্যানের কথা গানের কথায় ও সুরে তুলে ধরেছেন।

১৯৭৮ সালে তাঁর পূত্র বাউল আব্দুস সাত্তারের মৃত্যুতে তিনি কঠিন আঘাত পান। তারপর মাত্র কয়েকমাস পরে সেই সালের ১২ ই ডিসেম্বর তিনিও পাড়ি জমান পরপারে। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জৈনপুর গ্রামের বেতাই নদীর ধারে, বাড়ির উঠানে পূত্রের পাশে তাঁকে সমাধীস্থ করা হয়। এখনও প্রতি বছর জৈনপুরে উকিল মুন্সীর মাজারে বাউল গানের আয়োজন করা হয়।

তথ্যঋণ বাউল ধ্বংস ফৎওয়া ও অন্যান্যঃ আবুল আহসান চৌধুরী, লালন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বাউলঃ সমাজ,সাহিত্য ও সংগীত, ডঃ আনোয়ারুল করিম, বর্ণায়ন, ঢাকা, বাংলাদেশ। বিরহী বাউল উকিল মুন্সির গান ও জীবন, অমলেন্দু কুমার দাস, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ।