আমরা বেহুলা- লখিন্দর আর চাঁদ সওদাগরের কথা অনেক শুনেছি। এরা আসলে কে? লখিন্দর চাঁদ সওদাগরের ছেলে আর বেহুলা লখিন্দরের বউ কাজেই চাঁদ সওদাগর ছিলেন বেহুলার শ্বশুর। চাঁদ সওদাগরের কথা জানা যায় মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গল কাব্যে, এটি একটি কিংবদন্তি চরিত্র। চাঁদ সওদাগর ছিলেন প্রাচীন ভারতের চম্পক নগরের ক্ষমতাশালী ও ধনী বনিক। তিনি ছিলেন শিবের ভক্ত তাই মনসা যখন তাঁর কাছে পূজা চায় তখন তিনি তাতে রাজি হননা। চাঁদ সওদাগরের ছিল শিবের দেওয়া মহাজ্ঞান মন্ত্রবল, মনসা তার কাছ থেকে পুজো নেওয়ার চেষ্টা করলে সেই মন্ত্রবলে তিনি তা ব্যর্থ করে দেন।
মনসাও ছাড়ার পাত্রী না, সে সুন্দরী মেয়ে সেজে চাঁদ সওদাগরের গুপ্তরহস্য জেনে ফেলে ফলে তিনি মহাজ্ঞানের রক্ষাকবচটি হারিয়ে ফেলেন, মনসা তার বন্ধুকেও মেরে ফেলে যে কিনা অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিল। তারপরও তিনি মনসার পূজা করতে রাজি না হওয়ায় একে একে তার ছয়টি ছেলেই সাপের কামড়ে মারা যায়। এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি আবার বাণিজ্যে বের হন। সফল বাণিজ্যের পর তিনি যখন ধনসম্পদে জাহাজ ভর্তি করে বাড়ি ফিরছিলেন, তখনই মনসা প্রচণ্ড ঝড় তুলে তার বাণিজ্য-জাহাজ কালিদাস সাগরে ডুবিয়ে দেন। এতে সঙ্গীরা সব মারা যায় কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। দূর্গা তাঁকে রক্ষা করতে যান কালিদাস সাগরে, কিন্তু মনসার অনুরোধে শিব দূর্গাকে সেটা করতে বারণ করেন।
এরপর মনসা তাঁকে ভাসিয়ে সমুদ্রের তীরে চন্দ্রকেতুর কাছে পৌঁছে দেন। চন্দ্রকেতু তাকে দিয়ে মনসার পূজা করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হন না। ফলে তাকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে হয়। মনসা তখন স্বর্গের দুই নর্তক-নর্তকীর সাহায্য নেন। তাদের একজন চাঁদ সদাগরের ছেলে আর অন্যজন চাঁদ সওদাগরের বন্ধু সয়া বেনের মেয়ে রূপে জন্মগ্রহণ করেন।
চাঁদ সওদাগর চম্পক নগরে ফিরে এসে আবার নিজের জীবন সাজিয়ে তুলেন। লখিন্দর নামে তার একটি ছেলে জন্মে। এদিকে বন্ধু সয়াবেনের স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয় বেহুলা। বেহুলা এবং লখিন্দর একসঙ্গে বেড়ে ওঠে। তাদের বাবা-মায়েরা তাদের দুজনের বিয়ের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখা যায়, বিয়ের রাতেই বাসরঘরে সাপের কামড়ে লখিন্দরের মৃত্যুর কথা লেখা আছে। মনসার ভক্ত বেহুলা ও লখিন্দর ছিলেন রাজযোটক,তাই শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়ে হয়। লখিন্দরের প্রাণরক্ষা করতে চাঁদ সওদাগর একটি লোহার বাসর ঘর তৈরি করে দেন।
মনসা সেই লোহার বাসর ঘরে একটি সাপ পাঠিয়ে লখিন্দরের প্রাণনাশ করেন। সেযুগে নিয়ম ছিল, সাপের কামড়ে কেউ মারা গেলে তাকে না পুড়িয়ে কলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া। বেহুলা ছয় মাস ধরে ভেলায় ভাসতে থাকেন। লখিন্দরের শরীরে পচন ধরে। গ্রামবাসীরা বেহুলাকে পাগল মনে করে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। কিন্তু মনসা শুধু ভেলাটিকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা ছাড়া কিছুই করেন না। কলার ভেলা ভাসতে ভাসতে মনসার সখী ‘নেতা’র ঘাটে এসে ভিড়ে, সেই ঘাটে কাপড় কাচত নেতা। বেহুলার প্রার্থনা শুনে নেতা ঠিক করেন যে তাকে নিয়ে যাবেন মনসার কাছে। নিজের অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে নিয়ে স্বর্গে উপস্থিত হলেন।
মনসা বেহুলাকে বলেন, “যদি তোমার শ্বশুরকে দিয়ে আমার পূজা করাতে পারো, তবে তুমি তোমার স্বামীর প্রাণ ফিরে পাবে।” বেহুলা তাতে রাজি হয়ে যান কারন তাতে যদি তার মৃত স্বামী বেঁচে উঠে তাহলে সেটা তাকে করতেই হবে। বেহুলা রাজি হবার ফলে তার স্বামীর পচাগলা শরীর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। বেহুলা তার শাশুড়িকে সব ঘটনা খুলে বলেন, তিনি চাঁদ সদাগরকে গিয়ে সে সব কথা জানান। চাঁদ সওদাগরের পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয়না।
প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করতে রাজি হন। কিন্তু তিনি বাম হাতে প্রতিমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মনসাকে পূজা করতে থাকেন। মনসা অবশ্য তাতেই সন্তুষ্ট হন। এর পর চাঁদ সদাগর ও তার পরিবার সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে। চাঁদ-এর ছয় ছেলেকেও মনসা জীবন দান করেন। চাঁদ সদাগরের মতো ধনী ও প্রভাবশালী বণিক মনসার পূজা করায় মনসার পূজা দ্রুত জনসমাজে প্রচার লাভ করে।