তথাকথিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে নাটক অভিনয় তাঁর এলাকা ছিল না। আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছোতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পথনাটককে৷ ২রা জানুয়ারী, সাধারণ মানুষের জন্য, সাধারণ মানুষের কথাগুলো নাটকের রূপ দিয়ে কারখানার গেটে, গ্রাম-মহল্লায় পৌঁছে দেওয়া সেই পিপলস আর্টিস্ট সফদার হাশমির শহীদ দিবস।
১৯৫৪ সালের ১২ই এপ্রিল। দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন সফদার হাশমি। ১৯৭৫ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পাশ। তাঁর আগে তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন সফদার। প্রথমে এসএফআই, পরে সিপিআইএম দলের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ‘সিটু’র হয়ে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কাজ করতে যেতেন। এরপর ‘পিপলস থিয়েটার’কে হাতিয়ার করে তিনি এগিয়ে যান মানুষের নাটক নিয়ে গ্রামে, মফঃস্বলে, কারখানায়। নাট্যব্যক্তিত্ব বামপন্থী কর্মী সফদার পথনাটকের মাধ্যমে তুলে ধরতেন মেহনতী মানুষের কথা, রাজনৈতিক শোষণের প্রসঙ্গ। পুঁজিবাদী সংস্কৃতি কীভাবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তাদের স্বাভাবিক প্রতিবাদী চরিত্রকে, নাটকের মাধ্যমে তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে চাইতেন সফদর। এই কাজে সফদরের সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী মলয়শ্রী, তাঁর মা ও সমগ্র পরিবার।
 
২রা জানুয়ারী মৃত্যু হয় সফদারের। কিন্তু তার আগের দিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারীর ঘটনা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কী ঘটেছিল সেদিন? আশির দশকের শেষে কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার। বহুদিন ধরেই সফদারেরর প্রচার-নাটক বন্ধ করার হুমকি এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের থেকে। কিন্তু সফদার থেমে থাকেননি। চ্যালেঞ্জ নিয়েই বহু বিপদসঙ্কুল এলাকাতেও পথনাটক করেছেন দলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ১লা জানুয়ারি তিনি দিল্লির কাছে, শাহিবাবাদের ঝণ্ডপুর অঞ্চলের একটি শ্রমিক কলোনিতে পারফর্ম করতে যান। তার কয়েকদিন পরে ১০ জানুয়ারি ছিল গাজিয়াবাদ সিটি বোর্ডের নির্বাচন। স্থানীয় সিপিএম প্রার্থী রামানন্দ ঝা-এর সমর্থনেই পথনাটক প্রচারে নেমেছিলেন তিনি।
সকাল ১১টা নাগাদ আম্বেদকর পার্কে শুরু হয় সফদার-নির্দেশিত পথনাটক “হাল্লা বোল”। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই দলবল নিয়ে ও পুলিশকে সাথে নিয়ে সেখানে হাজির হয় এলাকার কংগ্রেস নেতা মুকেশ শর্মা, তিনিই সিপিএম প্রার্থী রামানন্দ ঝা-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাচনে। মুকেশ শর্মা ও তার সঙ্গীরা পথনাটকের পারফরম্যান্স এরিয়ার মধ্যে জোর করে ঢুকতে গেলে বাধা দেন সফদার। তিনি বলেন, হয় নাটকটি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অথবা অন্য কোনও পথে যেতে। এর পরেই শর্মা এবং তার শাগরেদরা নির্বিচারে লাঠিচার্জ করতে থাকে সফদার এবং জন নাট্য মঞ্চের সদস্যদের উপর। গুলিও চালায় তারা। গুরুতরভাবে আহত হন সফদার এবং তাঁর দলের কর্মীরা। মারা যান এক স্থানীয় বাসিন্দা। সফদার এবং তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যদের স্থানীয় সিটু অফিসে নিয়ে আসা হয়। শর্মা ও তার দলবল সেখানেও চড়াও হয়ে আবারও মারধর করে।
 
এরপর সফদরকে প্রথমে ভর্তি করা হয় নরেন্দ্রমোহন হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লির রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। পরের দিন অর্থাৎ ২রা জানুয়ারি সকাল ১০টায় মারা যান সফদার হাশমি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। তার দু’দিন পরে অর্থাৎ ৪ঠা জানুয়ারি আবারও ওই একই জায়গায় অসমাপ্ত “হাল্লা বোল” নাটকটি পরিবেশন করেন সফদারের স্ত্রী মলয়শ্রী ও জন নাট্যমঞ্চের সদস্যরা।
 
মাত্র ৩৫ বছরে তাঁর মৃত্যুর হলেও, তার আগে মানুষের কথা জানাতে ২৪টি পথনাটিকা প্রায় চার হাজার বার শো করেছিলেন৷ তাঁর মৃত্যুতে থেমে থাকেনি তাদের নাট্য আন্দোলন বরং আরও জোরে প্রতিবাদের জন্য গর্জে উঠেছিল সফদারের সঙ্গীরা৷ ৪ঠা জানুয়ারীর শো-তে সেদিন সফদারের মৃত্যুর শোক নয়, বরং ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠেছিল গোটা এলাকায়। নাটকে যুক্ত সফদার হাশমির অনুগামীদের দুঃসাহস আর প্রতিজ্ঞার কাছে পিছু হটেছিল গুন্ডাগিরিও। ওই ঘটনার ১৪ দিন পরে গাজিয়াবাদ আদালত সফদার হাশমি হত্যার জন্য ১০ জনকে অপরাধী গণ্য করে যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কংগ্রেস নেতা মুকেশ শর্মা।
জননাট্য মঞ্চ (জনম)-এর আহ্বায়ক সফদারকে ৩১ বছর পর কতজন মনে রেখেছি জানা নেই। আজকের প্রজন্মের নাট্যব্যক্তিত্ব, যারা প্রগতিশীল সংস্কৃতি, পিপলস্ কালচার নিয়ে কাজ করছেন তারাই বা কতটা সফদার হাশমির আত্মত্যাগকে জনমানসে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন জানা নেই। তবে একটা অংশের মানুষের কাছে বামমনস্ক সংস্কৃতি জগতের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছেন সফদার। তিনি চলে গেলেও থেমে থাকেনি জনমের কার্যকলাপ৷ নাটকের অভিনয় ও কর্মশালার কথা ভেবে ও তাঁর জন্মদিনকে মাথায় রেখে ২০১২ সালের ১২ই এপ্রিল এই নাট্যগোষ্ঠী উদ্বোধন করেছে “স্টুডিও সফদার”৷ শহীদ সফদরের মতো মানুষের স্মৃতি রোমন্থন আজ অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্তত সেই মানুষগুলির কথা ভেবে যাঁদের কাছে বর্ষবরণ শুধুমাত্র আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার নয়, যাঁরা সেই দিনটিতেও জীবনের সেই চরম সত্যটা বিস্মৃত হন না যে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ বর্ষবরণের রাতে ঘুমোতে গিয়েছেন ভুখা পেটে।
লেখা – Animesh Dutta

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...