১৯৭৯ সালটা ছিল মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল বছর। সে বছর ইরানে ঘটে গিয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিপ্লব, ইসলামি বিপ্লব। এই একই বছরের শেষদিকে এসে ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরবে ঘটে আরেকটি অভূতপূর্ব ঘটনা। পবিত্র নগরী মক্কায় সেবার রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। মক্কার গ্র‍্যান্ড মসজিদে একটি উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অবরোধ ছিল সাম্প্রতিক ইসলামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা।

আল জামা আল সালাফিয়া আল মুহতাসিবা বা জেএসএম নামের এক উগ্র সুন্নী গোষ্ঠী ১৯৭৯ সালে মক্কার গ্র‍্যান্ড মসজিদ অবরোধ করে সারা বিশ্বে এক আলোড়নের জন্ম দেয়। ইসলামের পবিত্র এ শহরে এমন চাঞ্চল্যে সৌদি রাজপরিবারকে বিব্রত করে তুলে। এই সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করতো সৌদি রাজপরিবার পশ্চিমাদের অনুসরণ করে ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও ইসলামি মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করছে। তাই এই পাশ্চাত্যায়ন রুখে দিতে তারা সৌদি রাজপরিবারকে একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করে। তবে তারা এই বার্তা ছাড়াও আরও একটি বিষয় সামনে নিয়ে আসে। এই দলটির নেতা ছিলেন জুহায়মান আল ওতায়বি। তিনি তার ভগ্নিপতি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহতানিকে ইমাম মাহদী দাবি করে মুসলমানদের তার পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।

১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর ফজরের নামাজে সেদিন কাবা শরীফ প্রাঙ্গনে জড়ো হয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় ৫০ হাজার মুসল্লি। আর এর মধ্যেই মিশেছিলেন জুহায়মান আল ওতায়বি আর তার ৪০০-৫০০ অনুচর। ইমাম নামাজ শেষ করার পরই ছদ্মবেশী এই বিদ্রোহীরা ইমামকে সরিয়ে মাইক্রোফোনের দখল নেয়। মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই জুহায়মান সৌদি রাজ পরিবারের সমালোচনা করতে থাকেন। তারা কয়েকটি কফিন নিয়ে এসেছিল। একসময় এই কফিনগুলো থেকে তারা ভুরি ভুরি অস্ত্র বের করে।

মক্কার গ্র‍্যান্ড মসজিদে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী

মূল পরিকল্পনাকারী জুহাইমান বিন মুহাম্মাদ বিন সাইফ উতাইবি

ইতোমধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা অস্ত্র হাতে পজিশন নেয়া শুরু করে। উপস্থিত মুসল্লীরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে যান। এই মুহুর্তে জুহায়মানের এক অনুসারী লিখিত বক্তব্য পড়তে থাকেন। বক্তব্যে বলা হয় শেষ জামানার ইমাম মাহদী এসে গেছেন। আর তিনি হচ্ছেন জুহায়মানের ভগ্নিপতি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাহতানি। মোহাম্মদ (স) এর ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী কাহতানির নামের সাথে নবীজীর পিতা ও তার নামের মিল আছে। এর আগে ইমাম মাহদীকে স্বপ্নে দেখার গুজব রটিয়েছিল এই গোষ্ঠীর সদস্যরা। ফলে কথিত মাহদীকে দেখে সাধারণ মুসল্লীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। অনেকে জুহায়মানকে অনুকরণ করে কথিত ইমাম মাহদীকে সম্মান জানানো শুরু করে। জুহায়মান কাহতানির কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে। অপরদিকে মসজিদের বাইরে চলছিল জোর সশস্ত্র প্রস্তুতি। জেএসএম এর সদস্যরা অস্ত্র হাতে মসজিদের মিনারে অবস্থান নেয়। জেসএমের স্নাইপাররা নিজেদের পজিশন নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রার্থনায় আসা মুসল্লিরা ভীত হয়ে পড়ে এবং যে যেদিকে পারে পালিয়ে যেতে শুরু করে। বেদুইন গোত্র থেকে উঠে আসা জুহায়মান অনেকের কাছে ছিল একজন নেশাগ্রস্ত ও অবৈধ মাদক ব্যবসার একজজ হর্তাকর্তা হিসেবে। অনেকে আবার মনে করতো তিনি ছিলেন এক ত্যাগী ধর্মীয় নেতা। তবে জুহায়মানের এই বিদ্রোহ ছিল ভোগবাদী সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে যাদেরকে তিনি মনে করতেন দুর্নীতিগ্রস্থ। মসজিদের ভেতরে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে জু্হায়মান কিছু জিম্মিকে রেখে অবরোধ শুরু করে।  প্রথমে এই অবরোধকে সৌদি কর্তৃপক্ষ এতোটা গুরুত্বের সাথে নেয়নি। ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে সৌদি সরকার কয়েকটি পেট্রোল কার পাঠায়। তবে এই কারগুলো জেসএমের সৈন্যদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে। কাবা শরীফ প্রাঙ্গনে যখন ঘটনা এতদূর গড়িয়ে গেছে তখন সৌদি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এসময় ক্রাউন প্রিন্স ফাহাদ আরব লীগের সম্মেলনে তিউনিসিয়া ছিলেন। আর সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান আব্দুল্লাহও ছিলেন মরক্কোতে সরকারি সফরে।

মক্কার গ্র‍্যান্ড মসজিদে ধরা পড়া জঙ্গি

লড়াই শেষে ধরা পড়া জঙ্গিদের কয়েকজন। এদের অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

দেশে ছিলেন অসুস্থ রাজা খালেদ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতান। প্রথমে সৌদি পুলিশের একটি দল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে যায়। কিন্তু জেএসএম এর স্নাইপাররা এদের গুলি করে হত্যা করে। পবিত্র এ নগরীতে রক্তপাত অনুমোদিত ছিল না। তাই সৌদি সরকার চেয়েছিল যথাসম্ভব কোন রক্তপাত ছাড়াই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে সৌদি কর্তৃপক্ষ হারাম শরীফে সামরিক অভিযানের বৈধতার জন্য দেশের শীর্ষ মুফতির কাছে অনুমতি চায়। অতঃপর সৌদি সামরিক বাহিনী অভিযানে নামে বিদ্রোহীদের হাত থেকে হারাম শরীফ দখলমুক্ত করতে। এন্টি ট্যাংক মিসাইল ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন করা হয়। আকাশে  ওড়াওড়ি করতে থাকে সামরিক বিমান। কাবা অবরোধের এই ঘটনা যাতে বাইরে প্রচার না পায় সেই ব্যবস্থা নেয় সৌদি সরকার। তা সত্ত্বেও ঘটনাটি চাপা থাকেনি৷ মসজিদের সংস্কারকাজে থাকা এক কর্মচারীর মাধ্যমে এই সংবাদ বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ভারী অস্ত্র সহ সাঁজোয়া যান কাবার চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। প্রথম কয়েকদিন স্বল্প আয়তনের এই জায়গায় বিদ্রোহী ও সৌদি বাহিনীর মধ্যে তীব্র গোলাগুলি হল। বিদ্রোহ পক্ষে যুদ্ধের পুরোভাগে ছিলেন কথিত মাহদী আব্দুল্লাহ কাহতানি৷ তিনি বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে কাহতানি আহত হন। এতে বিদ্রোহীদের মনে দ্বিধা তৈরি হয়৷ ইমাম মাহদী আহত হওয়ার কথা ছিল না।

মক্কার গ্র‍্যান্ড মসজিদ অবরোধের পরে সৌদি সৈন্যরা মসজিদে প্রবেশ

সৌদি সৈন্যরা মসজিদ আল হারামের নিচে কাবার ভুগর্বস্থ সুড়ঙ্গে প্রবেশের জন্য যুদ্ধ করছে, ১৯৭৯

সৌদি বাহিনী এবার মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে। আর বিদ্রোহীরা অবস্থান নেয় ভূগর্ভস্থ কক্ষে৷ বিশেষ এই অভিযানে পশ্চিমাদের সাহায্য নেয়ার দরকার মনে করে সৌদি সরকার। ফ্রান্সের তিনজন বিশেষ কমান্ডো এই অপারেশনে অংশ নেয়। তবে তাদের কথা গোপন রাখা হয়। ফরাসি অধিনায়কদের পরামর্শ জঙ্গিরা যে ভূগর্ভস্থ জায়গায় অবরোধ করে রেখেছিল সেখানে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ার পরামর্শ দেয়। দুই সপ্তাহ অবরোধ রাখার পর অবশেষে জুহায়মান তার দল নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। মোট ৬৩ জনকে এই ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কথিত ইমাম মাহদীর লাশের ছবি প্রকাশ করে সৌদি সরকার। অনেক বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার মানুষ আহত হয় এই অভিযানে। গ্র‍্যান্ড মসজিদের অনেক ক্ষতি হলেও পবিত্র কাবা অক্ষত থাকে।  জুহায়মানের দাবি ছিল সৌদি আরবে পাশ্চাত্যকরণ বন্ধ করা। টেলিভিশনে মহিলা উপস্থাপক নিষিদ্ধ করা। সৌদি সরকার এরপর থেকে দেশে আধুনিকায়ন ও সংস্কার বন্ধ করে কট্টর রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। গত চার দশক ধরে যা বলবৎ আছে। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এই ঘটনার পেছনে আমেরিকা ও ইহুদিদের দায়ী করেন।

তথ্যসূত্র