সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে নারীর এক শক্তিশালী ভূমিকা থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত ইতিহাসের পাতায় তারা সবসময় উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র চেঙ্গিস খান ও তার সাম্রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে হাজার না হলেও শত শত বই নিঃসন্দেহে রয়েছে। তবে সেসব বইতে তার সাম্রাজ্য নির্মাণে নারীদের ভূমিকার বিষয়টা তেমনভাবে স্থান পায় নি।
আবার বিষয়টি যে একেবারেই অনুল্লিখিত রয়ে গেছে, তা অবশ্য বলা যাবে না। কেননা ‘দ্য সিক্রেট হিস্টোরি অফ দ্য মঙ্গোল কুইন্স’-এ সাম্রাজ্য বিস্তার ও রক্ষায় চেঙ্গিস খানের মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে মোটামুটি একটা বিবরণ দিয়েছেন জ্যাক ওয়েদারফোর্ড। সমাজে মঙ্গোলীয় নারীদের বেশ শক্ত একটি অবস্থান ছিলো। সমসাময়িক অন্যান্য সমাজের নারীদের তুলনায় তাদের অধিকার ছিলো সুনির্দিষ্ট ও স্বীকৃত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হলেও সে সময়ে পণ দিয়ে মেয়েদেরকে বিয়ে করতে হতো। পুরুষদের একাধিক বিয়ের সুযোগ থাকলেও প্রত্যেক সন্তানের লালন-পালনের অর্থ এবং আইনী মর্যাদা নিশ্চিত করতে হতো মঙ্গোলীয় সমাজের পুরুষদের।
মঙ্গোলীয় সমাজে নারীরা নিজেদের কর্মদক্ষতা দিয়ে পারিবারিক জীবনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম ছিলেন। বৈরী আবহাওয়া এবং যাযাবর জীবন অনেকাংশেই বহুমুখী প্রতিভার নারী শক্তি তৈরীতে ভূমিকা রেখেছিলো। ছোটবেলা থেকেই মঙ্গোলীয় নারীদের ঘোড়ায় চড়া, তীর চালানো, নিজেদের আবাসস্থল রক্ষণাবেক্ষণ, তাঁবু টাঙানো বা তাঁবু খুলে ফেলার মতো শক্ত কাজগুলোতে দক্ষ হতে হতো। বাড়ির পুরুষেরা বেশিরভাগ সময়ই থাকতো যুদ্ধের ময়দানে। তাই ঐ সময় সমস্ত পারিবারিক দায়িত্ব ও সংসার পরিচালনার ভার বাড়ির বয়স্ক নারীদের ওপরই বৰ্তাতো। এই সক্ষমতা তাদেরকে দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলে। পরিবারের বয়োঃজ্যেষ্ঠ নারীরা পুরুষদের পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। রাজপরিবারের ক্ষেত্রে রাজা কিংবা সম্রাটের স্ত্রী এবং মা এই কাজে নিয়োজিত থাকতেন। এভাবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারতেন।
পরিবারে নারীদের শক্ত অবস্থান তৈরীর আরেকটি কারণ হচ্ছে, তাদের নিজস্ব সম্পদ গড়ার পরিপূর্ণ সুযোগ ছিলো। সম্পদের অধিকার, বিয়ে এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে সুযোগ তাদের ছিলো, তা সেই সময় অন্যান্য সমাজের নারীদের একেবারেই ছিলো না।
চেঙ্গিসের বাবা যখন শত্রুর হাতে নিহত হন, তখন চেঙ্গিস খুব ছোট। বাবার অনুপস্থিতিতে তার মা হোয়েলুনই তাকে বড় করেন। প্রচুর সংগ্রাম করে নিজের পরিবারকে রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে এককভাবে ভূমিকা রেখে গেছেন এই নারী। চেঙ্গিসের প্রথম স্ত্রী বর্তেকে চেঙ্গিসের প্রতিদ্বন্দ্বী উপজাতিরা অপহরণ করে কয়েক মাস বন্দি করে রাখবার পর বহু চেষ্টায় চেঙ্গিস খান তাকে উদ্ধার করে আনেন। সে সময় বর্তে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। চেঙ্গিস এর প্রথম ছেলে জোচি সম্ভবত তার জৈবিক ছেলে ছিলো না। তবুও সেই সন্তাককে তিনি অবহেলা করেন নি। নিজের পরিবারের সাথেই তাকে থাকতে দেয়া হয়েছিলো।
অন্য শক্তিশালী গোত্রপতির সন্তানের সাথে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মঙ্গোলীয়রা পারিবারিক সম্পর্কের ভিত শক্তিশালী করতেন। দুর্ধর্ষ একটি দল গঠনের জন্য এটি ছিলো একটি কার্যকরী প্রক্রিয়া। মেয়েদের স্বামীরা অবশ্যই রাষ্ট্র বিকাশের সময় শ্বশুরের হয়ে কাজ করবে, এমনটাই প্রত্যাশা করা হতো। মঙ্গোল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের এই কৌশল অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিলো। স্বামীদের অনুপস্থিতিতে নারীরাই রাজ্য পরিচালনা করতো।
পুত্রবধূরাও কোনো অংশে কম ছিলো না। মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্য গড়বার ক্ষেত্রে তাদেরও শক্তিশালী ভূমিকা ছিলো। সোরঘাঘতানি বেকি ছিলেন বিশিষ্ট মঙ্গোলীয় সম্রাজ্ঞী। চেঙ্গিসের ছোট ছেলে তলুইকে বিয়ে করে চার সন্তানের মা হন তিনি। মঙ্কে খান, হুলাগু খান, অ্যারিক বোর্কে এবং কুবলাই খান –তার এই চার সন্তান যেনো চেঙ্গিসের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সে জন্য তাদের শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেকি। বিভিন্ন ভাষাভাষী নিয়ে গঠিত এই সাম্রাজ্যে তিনি বহু ভাষা শেখার ও লেখার দক্ষতা অর্জনের জন্য নিয়মিতভাবে ভাষা শিক্ষা চালু করেন। সব ধর্মের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের শিক্ষাও তিনি তার সন্তানদেরকে দিয়েছিলেন। তার স্বামী তলুই ৪১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলে চেঙ্গিস খানের তৃতীয় ছেলে ওগোদেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিধবা বিয়ে মঙ্গোলীয় সমাজে প্রচলিত ছিলো। কিন্তু তিনি রাজি হন নি। সন্তান লালন-পালনে মনোনিবেশ করার জন্যই এই প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখান করেন।
১২৪১ সালে ওগোদেই খানের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী তোরেজিন খাতুন ১২৪৬ সাল পর্যন্ত সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। নৈমান উপজাতি গোষ্ঠী থেকে আসা এই নারী একজন ‘গ্রেট খাতুন’-এর সম্মান পেয়েছিলেন। নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে তিনি সাম্রাজ্যে এমন এক অবস্থান তৈরী করে নিয়েছিলেন, যা শুধুমাত্র পুরুষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো ইতিপূর্বে। তিনি সফলভাবে সাম্রাজ্য পরিচালনায় নিজের পরিপূর্ণ প্রভাব খাটিয়েছিলেন। তার সময়ের একটি মুদ্রাও পাওয়া গেছে ককেশিয়াতে।
মঙ্গোলদের ইতিহাসে নারীদের অবদানের প্রচুর চমকপ্রদ গল্প রয়েছে। এ ক্ষেত্রে খুতুলুনের গল্পটি তো উল্লেখ না করলেই নয়। খুতুলুন ছিলেন কুবলাই খানের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। একজন যোগ্য কুস্তিগীর ছিলেন এই নারী। ছেলেবেলা থেকেই বাবার সাথে বিভিন্ন সামরিক যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তাকে আরো শক্তিশালী ও কঠোর মনোভাবের অধিকারী করে গড়ে তোলে। কুস্তিগীর খুতুলুন হঠাৎ ঘোষণা করে বসেন যে, তিনি তাকেই বিয়ে করবেন, যে তাকে কুস্তিতে পরাজিত করতে পারবে। তার এই চ্যালেঞ্জ কেউ ভাঙতে সক্ষম হয় নি, যার ফলে লম্বা একটি বয়স পর্যন্ত নিজের জেদের কারণে তিনি অবিবাহিত ছিলেন। পরবর্তীতে একজনকে তিনি বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায়, কিন্তু সেই ব্যক্তিও খুতুলুনকে কোনো দিন পরাজিত করতে পারেন নি।
উত্তর মঙ্গোলীয় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ১৪৭৩ থেকে ১৪৭৯ সালের মধ্যে দুজন নারী যোদ্ধার দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। জীবিত অবস্থায় নারী দুজন ঘোড়সওয়ার ছিলেন, সেই সাথে ছিলেন সুযোগ্য তীরন্দাজও। ১৫ শতকে মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্য পতনের আশঙ্কা দেখা দিলে সম্রাজ্ঞী মাণ্ডখাই খাতুন সাম্রাজ্য রক্ষার এক বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নেন। অভিজাত পরিবারের মেয়ে মাণ্ডখাই। ষোলো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। তিনি চেঙ্গিস খানের সরাসরি বংশধর সাত বছর বয়সী বাতুমুন খানকে দত্তক নেন ও তার নাম দয়ান খান হিসেবে ঘোষণা দেন। দয়ান খানের বয়স যখন ১৯ বছর, তখন তাকেই বিয়ে করে মঙ্গোলদের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন মাণ্ডখাই। গল্প আছে, তাং সম্রাজ্যের সাথে বহু যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। যমজ সন্তান গর্ভে ধারণ করে একের পর এক যুদ্ধ করে জয়ী রাণী হিসেবে ফিরে আসেন তিনি। পরবর্তীতে সেই দুই সন্তানকে সুস্থভাবেই জন্ম দেন তিনি। ‘কুইন মাণ্ডখাই দ্য ওয়াইজ’ নামে তার জীবনের উপর একটি সিনেমাও তৈরী হয়েছিলো।
জ্যাক ওয়েদারফোর্ডের মতে, মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের অগ্রযাত্রার পিছনে নারীরাই ছিলো সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। তাদের বুদ্ধিমতা ও শক্তির জোর না থাকলে অনেক আগেই মঙ্গোল সাম্রাজ্য হারিয়ে যেতো। আর এসব বহুগুণে গুণান্বিত রমণীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেবার মাধ্যমেই মঙ্গোল সাম্রাজ্য বিস্তারের গল্পটি পূর্ণঙ্গতা পাবে।