আমাদের এই বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অপরিসীম। ছোট গল্প, নাটক, কবিতা থেকে শুরু করে গান, উপন্যাস সবকিছুতেই তার পদার্পণ পড়েছে। কিন্তু আমরা কি জানি, এই রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলা কেমন ছিল? আমরা কি জানতাম এক স্কুল পালানো ছোট ছেলে একদিন হবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? কে ছিল তার সৃষ্টির পেছনে? কে ছিল তার প্রেরণার উৎস?

কাদম্বরী দেবী। রবি ঠাকুরের নতুন বৌঠান। সাধারণ এক বাঙালি পরিবারের মেয়ে ছিলেন কাদম্বরী। তার বাবা ছিলেন এই ঠাকুরবাড়ির কর্মচারী। মাত্র নয় বছর বয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিয়ে হয় তার। এক সাধারন পরিবারের মেয়ে হয়ে এত বড় বাড়ির বউ হিসেবে কেমন বাধা আসতে পারে, তা হয়তো সহজেই অনুমেয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কাদম্বরীর ১০ বছরের বড়। উচ্চশিক্ষিত একটি পরিবারের বউ হয়েও তিনি অতটা শিক্ষিত ছিলেন না। বিয়ের পর পরই তাকে নিতে হয়েছিল এত বড় বাড়ির দায়িত্ব। একে তো বয়সে ছোট, বড় পরিবারের বউ, উচ্চ শিক্ষিতদের সাথে চলাচলের সামাজিক লড়াই, ছোট রবীন্দ্রনাথের দায়িত্ব, সব মিলিয়ে একেবারে হিমশিম খাচ্ছিল কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন সাত বছরের ছোট ছেলে। তার সব দায়িত্ব ছিল তার নতুন বৌঠানের। স্কুল পালানো রবি তখন একজন বন্ধুর সঙ্গ খুঁজতো। আর বাড়ির বউ হলেও কাদম্বরীরও ছিল খেলার বয়স। তাই তাদের বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনি।

কাদম্বরী নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন সামাজিকভাবে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে মিলে নাটকে সময় দেয়া শুরু করেন। বাংলা সাহিত্যে কাদম্বরীর অবদান নেহাতই কম নয়। ঠাকুর পরিবারের মেয়ে বউরা সকলেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। অনেকের ধারণা মতে, ঠাকুর পরিবার বৈষম্য ও শ্রেণীবিভাগে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু যাই হোক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীর বিয়েটা অনেকটা শ্রেণীবিভাগেরই পরিচয় দেয়। ঠাকুর পরিবারের সন্তানদের অন্য পরিবারের বিয়ের সুযোগ ছিল না। আর, তখন ভালো বংশীয় মেয়েও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই কর্মচারীর মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। এই বিষয়টা বাড়ির অন্য সদস্যরা মানতে পারেননি। তার মাঝে একজন ছিলেন রবির মেঝ বৌঠান গ্যানাদানন্দিনী।

কাদম্বরীর জীবন আরো কঠিন হয়ে যায়, যখন বিয়ের অনেক বছর পরও সে কোন সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। এ কারণে তাকে নানা ধরনের বাজে এবং কুরুচিপূর্ণ কথাও শুনতে হতো। এসব শুনতে শুনতে কাদম্বরী সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে থাকে। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় যখন রবীন্দ্রনাথের বোন সুবর্ণকুমারীর মেয়ে উর্মিলা মারা যায়। উর্মিলা ছিল কাদম্বরীর ভীষণ ভক্ত। তাই উর্মিলার মৃত্যুর দায়ও কাদম্বরীর উপর চাপানো হয়। ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই কাদম্বরীকে নিয়ে হতো সমালোচনা। একটা সময় কাদম্বরী হয়ে গেলেন একা। তার এই অসহায় মুহূর্তে তার স্বামী কিছুটা হলেও পাশে ছিলেন। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার পরও তিনি কাদম্বরীর জন্য বই এনে দিতেন। সাহিত্যে আরও মনোযোগ বাড়াতে উৎসাহ দিতেন। বাড়ির ভেতরে ও বাইরে সব ধরনের স্বাধীন কাজের সুযোগ দিতেন। যে সময়ে বাঙালি নারীরা ঘরের বাইরে বের হতে পারত না, সেই সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেই সুযোগটা কাদম্বরী ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ে পশ্চিমা সাহিত্য রপ্ত করতে শুরু করেন। গান, নাটক, অভিনয়ে সময় কাটাতে থাকেন।

ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের সাথে তার সাহিত্য সমালোচনা শুরু হয়। রবি ঠাকুরের লেখা কবিতা, গল্পের প্রথম পাঠক ছিলেন নতুন বৌঠান। কাদম্বরী গল্প প্রিয় মানুষ ছিলেন। কথা ছিল কাদম্বরী একটা করে গল্প বলবেন, আর রবি শোনাবেন তার একটি করে নতুন লেখা। তার লেখা নিয়ে কাদম্বরী মাঝে মাঝে সমালোচনা করতেন। এতে রবি ঠাকুর আরো ভালোভাবে লেখার উৎসাহ পেতেন। কাদম্বরী নিজেও কবিতা লিখতেন। তার বেশির ভাগই ছিল রবি ঠাকুরের পাশে বসেই। মাঝে মাঝে জ্যোতিরিন্দ্র, রবি ও কাদম্বরী একসাথে বসেই সাহিত্য চর্চা করতেন। তাদের মাঝে ছিল অদ্ভুত একটা সম্পর্ক। কাদম্বরী দেবী মাত্র ২৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এই নারী একটা সময় জীবনের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আর এই সময়টা ছিল রবি ঠাকুরের বিয়ের পরপর। গল্প তৈরি হতে সময় লাগেনি। রবি ঠাকুরের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে বানানো হয় না না অরুচিকর গল্প। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, সেইসব গল্পের সত্যতা কতটুকু? কাদম্বরী কি রবি ঠাকুরের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি? নাকি অন্য কোন কারণ আছে তার আত্মহননের পেছনে?

কাদম্বরী বরাবরই ছিলেন নিঃসঙ্গ একজন নারী। স্বামীর সাথে তার বয়সের ছিল বিস্তর ফারাক। জ্যোতিরিন্দ্র বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। কাদম্বরীকে সময় দিতেন খুবই কম। নিঃসন্তান কাদম্বরী সময় কাটতো ছোট রবি সাথেই। রবির সব দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। তাই রবির বিয়ের পর তিনি হয়ে যান মারাত্মকভাবে নিসঙ্গ। একেতো পরিবারের কারো সাথেই তার তেমন ভালো সম্পর্ক ছিল না, স্বামীও তেমন সময় দিতে পারেননি, তার ওপর রবি ঠাকুর নিজের বৈবাহিক জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে তাই প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকতেন কাদম্বরী। একটা সময় সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি। টানা দুইদিন তাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি হয়। তার মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক ছিল বলে জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুর পরিবার ছিল নীরব। তার লাশ হিন্দু প্রথা অনুযায়ী মর্গে পাঠানো হয়নি। সেই ঠাকুর বাড়িতেই বসানো হয়েছিল করোনার কোর্ট। কিন্তু সেই রিপোর্টেও গায়েব করা হয়। এমনকি এত বড় একটা ঘটনাও তখনকার পত্রিকায় ছাপানো হয়নি। ৫২ টাকা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয় সাংবাদিকদের।

কাদম্বরীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তার প্রিয় বন্ধুর উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছিলেন,

“কিন্তু আমার সেই প্রিয়তম কোথায়, যিনি আমার বাল্যকালের প্রায় একমাত্র সঙ্গী, যার সাথে আমি আমার যৌবনের স্বপ্নের সব রহস্য খুঁজে কাটিয়েছি? তিনি আমার রানী, তিনি মারা গেছেন এবং আমার আর তার পৃথিবীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।”