ঢাকাবাসীর অভিনন্দনের উত্তরে মাইকেল মদুসূদন দত্তের লেখা সনেট, সাথে প্রখ্যাত শিল্পী অতুল বসুর আঁকা কবি মধুসূদনের প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতিটি বর্তমানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সংরক্ষিত আছে।
পূর্বকথাঃ বাড়ির ঠিকানা-৬, লাউডন স্ট্রিট, কলকাতা। বাড়িটির মাসিক ভাড়া ৪০০টাকা। ১৮৬০ সালের হিসাবে এই ভাড়া নিঃসন্দেহে আকাশছোঁয়া! আশেপাশের সব বাড়িতে ইউরোপিয়দের বাস হলেও এই বাড়ির বাসিন্দা একজন বাঙালি- ব্যারিস্টার মধুসূদন দত্ত; আমাদের কাছে যার পরিচয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রূপে। স্বভাবসুলভ বিলাসিতায় গা-ভাসানো কবি এ বাড়ি সাজিয়েছেন আধুনিক আসবাব, ঝাড়লণ্ঠন, বিলাতি সব তেলচিত্র আর প্রিয় ইংরেজ কবি-নাট্যকারদের আবক্ষ ভাস্কর্যে।
মুশকিল হল, বিলাসী জীবনযাপনের উপকরণগুলোর প্রায় সবই ধার এ জোগাড় করা। ব্যারিস্টারি পাশ করে ফেরার পরও মধুসূদনের ব্যবসা তেমন জমেনি। তিনি ফিরে এসে দেখেন ইতিমধ্যে বহু ব্যারিস্টার কলকাতায় নিজ নিজ ব্যবসা জমিয়ে বসেছেন। তীব্র সেই প্রতিযোগিতায় ধৈর্য্যের অভাব, সাধারন মানুষের সাথে রক্ষণশীল আচরন আর আত্ম-অহমিকা- এসব কারনে তার ব্যবসা পসার পেল না। আরেকটি প্রধান কারন ভগ্নস্বাস্থ্য। অতিরিক্ত মদ্যপান আর ধূমপানে কবির স্বাস্থ্য তখন একদমই ভেঙে পড়েছে। বয়স মাত্র ৪৫ বছর, কিন্তু অস্বাভাবিক মুটিয়ে গিয়ে নাম লিখিয়েছেন প্রৌঢ়র খাতায়। সে সময়কার বিখ্যাত চিকিৎসক পামারের সেবাতেও কোনো উন্নতি নেই, যকৃত আর প্লীহা যে নষ্ট করে ফেলেছেন! আয়-রোজগার প্রায় শুণ্যের কোঠায়। পাওনাদারেরা দল বেঁধে এসে টাকা দাবী করে। মাঝে মাঝে লোক ভাড়া করে আনে, যাতে নীচ থেকে চেঁচিয়ে, গালমন্দ করে পাড়া মাথায় তুলে তাঁকে অপমান করা যায়।
এরকম সময়েই একটা মামলা পরিচালনার কাজে কবি ডাক পেলেন ঢাকা থেকে। রুগ্ন শরীরে কলকাতা থেকে ঢাকা সফর খুব সহজ ছিল না। তারপরও কবি ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে সেটা শুধু একটি মামলার জন্য না। কলকাতায় তখন তাঁর পসার নেই বললেই চলে। ঢাকার এই আমন্ত্রন তাঁর মনে আশা জাগালো। ঢাকায় যদি ঠিকমত আইন ব্যবসা শুরু করা যায় তাহলে হয়তো বিনা প্রতিযোগিতায় প্রচুর রোজগার করা যাবে; আর এই আর্থিক দুরবস্থা থেকেও তাঁর মুক্তি মিলবে। তাই অসুস্থ শরীরেই ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পৌঁছুলেন ঢাকা, অতিথি হলেন আরমানিটোলায় পোগজ সাহেবের বাড়িতে।
মামলা উপলক্ষে আগমন হলেও স্থানীয় কিছু সাহিত্যমোদী নাগরিক ‘মহাকবি’ মধুসূদনের এই সফরকে স্মরণীয় করে রাখবার উদ্যোগ নিলেন। ‘ঢাকা প্রকাশ’ এর সেসময়কার সহকারি সম্পাদক অনাথ বন্ধু জানিয়েছেন মধুসূদনের আগমনে ঢাকায় কম করে হলেও তিনটি অভ্যর্থনা সভা হয়- একটি পোগজ স্কুলে, একটি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে আর শেষোক্তটি ‘ঢাকা প্রকাশ’ কার্যালয়ে। সবগুলো সভাতেই ঢাকার বহু বিশিষ্ট লোক উপস্থিত হন। ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে কবিকে মানপত্র প্রদান করা হয়।
ধারনা করা হয় এর খসড়া তৈরি করেছিলেন কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ। এরকম এক সভায় দেয়া বক্তব্যে ঢাকার এক যুবক মধুসূদনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ আপনার বিদ্যাবুদ্ধি, ক্ষমতা প্রভৃতি দ্বারা আমরা যেমন মহা গৌরবান্বিত হই, তেমনি আপনি ইংরেজ হইয়া গিয়াছেন শুনিয়া আমরা ভারি দুঃখিত হই, কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ ব্যবহার করিয়া আমাদের সে ভ্রম গেল।“ এবার মধুসূদনের উত্তর দেয়ার পালা! কৌতুকভরা কণ্ঠে কবি জানালেন যে তিনি, তাঁর বৈঠকখানা আর শয়ন কক্ষ-দু’জায়গাতেই দু’টি বিশাল আকারের আয়না রেখেছেন যেখানে নিজ চেহারা দেখামাত্রই মনে পড়বে তিনি বাঙালি। উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “আমি শুধু বাঙালি নহি, আমি বাঙাল, আমার বাড়ী যশোহর।“ অভিনন্দনে মুগ্ধ কবি ঢাকা বিষয়ক সনেট “নাহি পাই নাম তব…” রচনা করেছিলেন আরমানিটোলার সেই বাড়িতে বসেই।
সে সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হরিশচন্দ্র মিত্র। তিনি ছিলেন কবির গুণ্মুগ্ধ এক ভক্ত, কবির ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের অনুকরণে ততদিনে নিজেই লিখে ফেলেছেন ‘কীচকবধ কাব্য’। হরিশচন্দ্রের উদ্যোগে কবির সনেটটি ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ পত্রিকায় ছাপানো হল। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যে আশায় বুক বেঁধে এই অসুস্থ শরীরে কবি ঢাকা এসেছিলেন, তাঁর সেই আশা পূরন হয়নি। ঢাকায় এসেই তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ফলে স্থানীয়ভাবে প্র্যাক্টিস চালু করবার জন্য আদালত পাড়ায় যে ছুটাছুটি করবার দরকার ছিল তা আর করা হল না। স্ত্রী হেনরিয়েটা আর সন্তানদের ফেলে এসেছিলেন, মন অস্থির হয়ে উঠল তাদের জন্য। দিন দশেক রোগে ভুগে তড়িঘড়ি করেই ফিরে গেলেন কলকাতা।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১- আশার ছলনে ভুলি, গোলাম মুরশিদ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৫ ২- A City and its Civic Body: A description of Facts & Events, Azimusshan Haider, 1966.