১২৪৮ খ্রিস্টাব্দ–
ফ্রান্সের প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছেন প্রাচ্যে মুসলিমদের কাছ থেকে পবিত্রভূমি ছিনিয়ে নিতে। মাত্র কয়েকবছর আগেই মিশরের আইয়ূবী সুলতান আস সালিহ বিখ্যাত “হারাবিয়্যাহ” এর যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজিত করে পবিত্রভূমি জেরুজালেম আবার মুসলিম অধিকারে নিয়ে আসেন। যার ফলশ্রুতিতে নবম লুইয়ের ডাকে শুরু হয় সপ্তম ক্রুসেড। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এইবার ক্রুসেডাররা সরাসরি পবিত্র ভূমি জেরুজালেম আক্রমন বা অবরোধ না করে, তারা মিশরের দিকে আক্রমন চালায়। নবম লুই অনুধাবন করেছিলেন জেরুজালেম দখল করার পথে একমাত্র বাধা শক্তিশালী মিশর। মিশরের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন আইয়ূবীরা। কিন্তু সেইসময়ে মিশর ছিলো এক সংকটকালীন সময়ে।হঠাৎ করে মিশরের সুলতান আস সালিহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মহিয়সী স্ত্রী শাজরাতুদ-দার ও সুলতানের পুত্র তুরাণ শাহ মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ান।প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধে ক্রুসেডাররা জয়লাভ করলেও পরবর্তীতে মুসলিম বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সম্রাট নবম লুই বন্দ্বী হন মুসলিম বাহিনীর হাতে। মুসলিম বাহিনীর এই গৌরবজ্জ্বল বিজয়ের নেপথ্যে ছিলো যে এলিট সেনা দল, তারাই মামলূক বা দাস নামে পরিচিত ছিলো।
মধ্যযুগের ইতিহাসে মামলূক সালতানাত একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জুড়ে আছে। সেই খ্রিস্টানদের সাথে ক্রুসেড থেকে শুরু করে আব্বাসি খিলাফত টিকিয়ে রাখা, বিখ্যাত আইন জালূত যুদ্ধে অপরাজেয় মঙ্গোলদের জয়রথকে থামিয়ে দেওয়া, হিদুস্তান, মিশর ইত্যাদি অঞ্চলে নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন – সবখানেই মামলূকদের প্রসঙ্গ চলে আসে। অনেকেরই ধারণা হয়ত মামলূকরা কোনো স্বতন্ত্র জাতি, আদতে তা নয়। মূলত ক্রীতদাসদের নিয়ে প্রস্ততকৃত সেনাবাহিনীর দলকে সাধারণভাবে বলা হত মামলূক। “মামলূক” শব্দটি মূলত আরবি “মামালিক” শব্দের বহুবচন। “মামালিক” শব্দের অর্থ যে অন্যের অধীন বা আজ্ঞাবহ। জাতিগত ভাবে তারা ছিলেন তুর্কি। স্বভাবতই তাদের ভাষা ছিলো তুর্কি। কিন্তু তারা প্রয়োজনবোধে আরবি ভাষাও আয়ত্ত করে নিয়েছিলো, যাতে তাদের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পেতে সহায়ক ছিলো।সেই আব্বাসি খিলাফতের শুরুতে বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম আমির-সুলতানেরা তুর্কি স্তেপ অঞ্চল থেকে বিভিন্ন তুর্কমান জাতির বালক ক্রীতদাসদের ক্রয় করে তাদের উত্তম প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে নিজেদের দেহরক্ষী বা সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতে থাকেন।এই তুর্কি বালকরা দেখতে হতো সুশ্রী ও শেতাঙ্গ। ভাগ্যের বিড়ম্বণায় তারা ক্রীতদাস বেচা-কেনার হাটে। তাদের মালিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার পর তারা হয়ে উঠত একেক জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। এদেরকেই মামলূক বলা হত। সেই সময়ের আমির সুলতানেরা তুর্কিদের ব্যাপকহারে ক্রয় করার উদ্দেশ্য সম্ভবত আরব ও পার্সিয়ানদের উপর নির্ভরতা কমানো। কারণ এই তুর্কি মামলূকদের আরবদের মতো গোত্রপ্রীতি ছিলো না আবার পার্সিয়ানদের মতো লোভও ছিলো না। নিজেদের মালিকদের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিলো প্রবাদপ্রতিম। যুদ্ধ তাদের রক্তে মিশে থাকতো। বিভিন্ন তুর্কি গোত্র থেকে এই মামলূকদের ক্রয় করা হতো। এরা ছোটবেলা থেকেই ছিলো দুর্ধর্ষ ও দুর্দান্ত। উদাহরণস্বরুপ কিপচাপ গোত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিখ্যাত মামলূক সুলতান রোকনউদ্দিন বাইবার্স যিনি পশ্চিমাদের কাছে পরিচিত “প্যান্থার” নামে, তিনি ছিলেন তুর্কি কিপচাক – কুমান গোত্রের। দুর্ধর্ষ এই গোত্রের শিশুরা ছেলেবেলা থেকেই চিতা, নেকড়ের সাথে লড়াই করে বেড়ে উঠত।
কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে একেকজন মামলূক সেনাকে শিশুকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে যেতে হতো।এইভাবে সঠিক শিক্ষা পেয়ে এই মামলূকরা একেকজন দক্ষ সেনাতে পরিনত হত। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এইসব মামলূকেরা ছিলেন নৈতিক দিক থেকেও শক্তিশালী। এদের শিশুকালে ধর্মীয় শিক্ষা তথা কুরআন-হাদিসের শিক্ষা থেকে কৈশোর কাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সময় পর্যন্ত নানারকম সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তারপর বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো তাদের যোগ্যতা যাচাই করার জন্য যেমন: তীরন্দাজী, ঘোরসওয়ারি ইত্যাদি।অনেকসময় পরীক্ষামূলক বিভিন্ন রণক্ষেত্রেও তাদের পাঠানো হতো, সেখানে তারা নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আসতেন। অনেকটা আধুনিকযুগের মিলিটারি একাডেমির মতোই তাদেরকে গড়ে তোলা হতো। রণক্ষেত্রে মামলূক সেনারা বীরত্বে ছিলো সবার আগে, রণক্ষেত্রে শত্রুর নিধন না করে তারা পিছু হটতো না। এই বিশেষায়িত সেনারা ছিলো দক্ষ ঘোরসওয়ার, দুর্দান্ত তলোয়ারবাজ এবং নিখুঁত তীরন্দাজ। নির্দিষ্ট সময় পর পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর তাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়া হতো একটা সম্মেলন আহবান করে।এতে সুলতান, আমিররা উপস্থিত থাকতেন। অনেক সময়ে তাদের দলগতভাবে স্বাধীন করে দেয়া হতো “ইতাক” নামের প্রত্যয়ন পত্র প্রদানের মাধ্যমে।মুক্ত মামলূকদের “মাতুক” বা আজাদকৃত বলা হতো। যিনি তাদেরকে আজাদ করে দিতেন তাকে মামলূকেরা জানতো “উস্তাদ” হিসেবে এবং তাদের সঙ্গীদের বলা হতো “খুশদাশিয়া” বা সাথী। এভাবে মামলূকেরা দাসত্ব থেকে স্বাধীন জীবনে প্রবেশ করতো। মুক্ত সকল মামলূকদের অস্ত্র, ঘোড়া,”কুম্মাশ ” নামের বিশেষ পোষাক দেয়া হতো। অনেকে যোগ্যতা অনুসারে জায়গিরও লাভ করতো।এরপর তাদেরকে বিভিন্ন দলে বা উপদলে একেকজন অধিনায়কের অধীনে ন্যাস্ত করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হতো। পরবর্তীতে তারা স্বীয় যোগ্যতায় প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব লাভ করতো।
মামলূকদের মালিকের নাম অনুসারে তাদের বিভিন্ন উপনামে ডাকা হতো। যেমন: আস সালিহের নাম অনুসারে সালিহী মামলূক, মুইজ আইবেকের মামলূকদের বলা হত মুইজ্জিয়া মামলূক, নাসিরুদ্দিন কালাউনের মামলূকদের বলা হতো নাসিরিয়া মামলূক। এছাড়া মিশরের আইয়ূবি সুলতান আস সালিহ নীলনদের রওজা দ্বীপে তাঁর মামলূক সেনাদলের জন্যে একটা সামরিক ঘাঁটি নির্মান করেন। এজন্য ঐ মামলূকদের বলা হতো বাহারিয়া বা নদীওয়ালা মামলূক। সুলতান রোকনউদ্দিন বাইবার্স এই বাহারিয়া মামলূক দলের প্রধান ছিলেন। আব্বাসিয় খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ সর্বপ্রথম মামলূক সেনাদের নিয়ে একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিলো পূর্বল্লেখিত আরব ও পার্সিয়ানদের প্রতিস্থাপন করা। আর মধ্য এশিয়ায় তুর্কি সেলজুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন মুসলিম সালতানাত গুলোতে তুর্কিদের প্রভাব বাড়তে থাকে। সেলজুক সাম্রাজ্যের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মূলক প্রথম মামলূকদের সুসংগঠিতকরেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি মামলূকদের নিয়ে নিজের এক বিরাট দেহরক্ষী দল প্রস্তুত করেন। তাঁর মামলূক দলকে বলা হত মামালিকে নিজামিয়্যা।
বড় বড় সাম্রাজ্যের সুলতানেরা অনেক সময় তাঁদের সন্তানদের সুশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রাসাদে একটু বয়স্ক মামলূকদের দায়িত্ব দিতেন, যুদ্ধের সময় তাদের নিকট হতে সময় প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতেন। এর বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন জায়গায় জায়গির দেয়া হতো। এছাড়া বিভিন্ন মামলূক নেতা বা আমিরদের পুরস্কারস্বরুপ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় জায়গির প্রদান করতেন। এই প্রভাবশালী মামলূক নেতাদের বলা হতো “আতাবেগ”। নিজাম-উল- মূলকই প্রথম ব্যক্তি যিনি আতাবেগ উপাধি গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের শাসন দুর্বল হয়ে গেলে এই আতাবেগরা নিজেদের এলাকায় প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। এই আতাবেগদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইমাদুদ্দিন জিংকি। তিনি দিয়ার বেকির, আলেপ্পো, মসুলে নিজের স্বতন্ত্র রাজ্য স্থাপন করেন। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র নুরুদ্দিন মাহমুদ জিংকি। তিনি পিতার রাজ্যকে আরোও বিস্তৃত করেন এবং ফাতেমি সাম্রাজ্যকে হটিয়ে মিশরকেও স্বীয় রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি অনেক মামলূক ক্রয় করেছেন।এরপর আসে আইয়ূবিরা। বিখ্যাত সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবিও প্রচুর মামলূক ক্রয় করেছেন। তাঁর মামলূকদের বলা হতো “মামালিকে সালিহিয়্যা” বলা হতো।
শুধু মিশর,সিরিয়া বা মধ্য এশিয়াই নয় আমাদের উপমহাদেশেও মোহাম্মদ ঘূরী ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে দিল্লী অধিকার করে তাঁর পুত্রসম কুতুবউদ্দিন আইবেককে দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে যান। এই কুতুবউদ্দিন ছিলেন নি:স্বন্তান মোহাম্মদ ঘূরীর ক্রয় করা মামলূক। ভারতের দিল্লী সালতানাতের তিনিই ছিলেন প্রথম সুলতান। কুতুবউদ্দিনের পর তাঁর জামাতা ইলতুৎমিশ সিংহাসনে বসেন এবং সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ইলতুৎমিশও ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেকের পুত্রসম ক্রীতদাস।যাঁর বিচক্ষণতা, মেধায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাঁকে জামাতা করে উত্তরাধিকার নিযুক্ত করে যান। এই কারণে দিল্লীর সালতানাতের এই বংশকে মামলূক বংশও বলা হয়। এ থেকে বোঝা যায়, মামলূকদের ক্রয় করা মালিক সুলতান, আমিররা তাদের ভালোবাসতেন অনেক।তাঁরা নিজেরা প্রায়ই মামলূকদের প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করতেন। অনেকসময় তাদের সাথে আহার করতেন বা তাদের সুবিধা-অসুবিধার তদারকি করতেন।
এই তুর্কি মামলূকেরা ছিলো অসম সাহসী যোদ্ধা। সুলতানদের এলিট ফোর্স হিসেবে তারা বিবেচিত হতো। বিশেষত মিশরে বিভিন্ন যুদ্ধে তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা কিংবদন্তিতূল্য হয়ে আছে। তাদের মধ্যে “উস্তাদ” ও “খুশদাসিয়া” বা সাথী সম্পর্ক তাদের আনুগত্য ও ভ্রার্তৃত্বের বন্ধনে বেধে রাখতো, যার কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ঐক্যও ছিলো প্রশ্নাতীত। উদাহরণস্বরূপ সপ্তম ক্রুসেডের সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধসহ, বিখ্যাত “আইন জালূত” এর যুদ্ধ, পরবর্তীতে মোঙ্গলদের সাথে মুসলিমদের বিভিন্ন যুদ্ধ, হাসাসিন বা আততায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান ইত্যাদি বিভিন্ন যুদ্ধে চরম বীরত্ব প্রদর্শন করেছে।সেই সময়ে মোঙ্গল ঝড়ে পুরো পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান ১২৫৮ সালে বিধ্বস্ত করেন আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী কিংবদন্তির বাগদাদ নগরী। তখন মোঙ্গলদের সামনে মুসলিম বিশ্বে সবচাইতে বড় বাধা ছিলো মিশর। তখন মিশরের রাজনীতির নানা পালা বদলে আইয়ূবীদের সড়িয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো মামলূকেরা। আইয়ূবী সুলতান আস সালিহের স্ত্রী সুলতানা শাজরাতুদ-দারকে মিশরের প্রথম মামলূক হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেন।অনেকে তাঁকে “উম্মুল মামলূক” বা মামলূকদের মাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষত বাহারিয়া মামলূকরা তাঁকে মায়ের মতোই দেখতো। কিন্তু তিনি বেশিদিন ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারেন নি। আব্বাসীয় খলিফার ভৎসনাপূর্ণ চিঠি ও বিভিন্ন স্থানে একজন নারীর ক্ষমতারোহনের কারণে বিদ্রোহের উপক্রম হলে, তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। হালাকুর বাগদাদ অভিযানের পর মিশর আক্রমণের সময়ে সুলতান ছিলেন সাইফুদ্দিন কুতুয। মামলূক হলেও তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খান কর্তৃক ধ্বংস্প্রাপ্ত খারেজম সাম্রাজ্যের শাহজাদা। মামলূকদের বিভিন্ন দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও কুতুয এই ক্রান্তিকালে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস করেন এবং সফলও হন। পূর্বে যে রাজ্যেই মোঙ্গলরা গিয়েছে সেই রাজ্যেরই ধ্বংস করেছে তারা। পাইকারি হারে মানুষ মারতে মারতে এগোতো তারা। তাদের হাত থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কেউই রেহাই পেতো না।
তারা ছিলো অপরাজেয়। অবশেষে, আইন জালূতের যুদ্ধে সেই প্ররাক্রমশালী হালাকু খানের সেনাপতি কিতাবুগাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত করে কুতুযের নের্তৃত্বাধীন মিশরের সেনাবাহিনী। এ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে মামলূক বাহিনী। বিশেষত বাইবার্স অসামান্য বীরত্ব দেখান। মামলূক সেনাদের ব্যবহৃত বিশেষ তরবারি “কিলিজ” এর আঘাতে মারা পড়ে হাজার হাজার মোঙ্গল সেনা।এই কিলিজের ফলা সামনের দিকে কিছুটা বাকানো ছিলো, যা দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে সুবিধা হতো। পরাজিত মোঙ্গোল বাহিনীকে বহুদূর পর্যন্ত ধাওয়া করে মামলূক সেনারা। মোঙ্গলদের যে পরাজিত করা সম্ভব এটা প্রথম মিশরের মামলূকেরাই প্রথম বিশ্বকে অনুধাবন করায়। বিভিন্ন সময়ে এই মামলূক সুলতানেরা নানা যুদ্ধে মিশরের পক্ষে নের্তৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরাই তৎকালীন নামসর্বস্ব আব্বাসীয় খিলাফতকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। মিশরের মামলূক সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয় মধ্য ১৩ শতকে এবং ১৬ শতকের প্রথমার্ধে তা বিলুপ্ত হয়। বিখ্যাত অটোমান বা ওসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম ১৫১৭ সালের ২০ জানুয়ারি মামলূকদের পরাজিত করে কায়রো দখল করে সম্পূর্ণ মিশর, সিরিয়া অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং আব্বাসীয় খিলাফত বিলোপ করে খিলাফত ইস্তাম্বুলকেন্দ্রিক করেন।
একটা সামরিক শ্রেণি হিসেবে মামলূকদের উত্থান বেশ বিস্ময়কর। সামান্য ক্রীতদাস থেকে তাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী বহু গুণে গুণান্বিত দুর্দান্ত সুলতান এসেছেন। নিজেদের যোগ্যতায় তাঁরা রাষ্ট্রের সর্বোচচ পর্যায়ে গিয়েছেন। মুসলিম সাম্রাজ্যগুলির ইতিহাসে মামলূক সালতানাত বিশেষ স্থান অধিকার করবে। কারণ তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম জাহানের ঢাল হয়ে শত্রুদের প্রতিরোধ করেছে। দীর্ঘদিন যাবৎ খিলাফতের ধারক হিসেবে খিলাফতকে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে অন্য সমস্ত সাম্রাজ্যের মতো কালের গহবরে হারিয়ে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস, কিংবদন্তির আখ্যান।