Knossos palace at Heraklion

খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ সাল। ক্রীটের উত্তর অংশে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে নসোস রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে চলছে পূজার বিশাল সমারোহ। ভালো ফসল উৎপাদন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা লাভ –এসব কারণে দেবীকে সন্তুষ্ট করতেই এই আয়োজন। হ্যাঁ, দেবতা নয়, দেবীই তাদের মুখ্য আরাধ্য। সব দেবীর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হলেন সর্পদেবী। ভীষণ সুন্দর এই সর্পদেবী, মাথায় রয়েছে হাতির দাঁতের চমৎকার মুকুট, সারা গায়ে পেঁচিয়ে রয়েছে সোনার তৈরী সাপ।

প্রাসাদের সাজসজ্জাও দেখার মতো। দক্ষ চিত্রশিল্পীরা প্রাসাদের দেয়ালে উজ্জ্বল রঙের ডলফিন, নারীমূর্তি ও লতাপাতার ফ্রেস্কো এঁকে রেখেছেন। বাজিকর ও নর্তকীরা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে নাচ ও ভোজবাজির খেলা। প্রচন্ড শীত থেকে বাঁচতে আগুন জ্বালানো হয়েছে মাটির পাত্রে। এদিক-ওদিক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ধূপ। পুরো প্রাসাদ ধূপের গন্ধে মুখরিত হয়ে আছে।

আরেক দিকে ঘটা করে চলছে ষাঁড়ের পূজা। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবতা জিউস ষাঁড়ের রূপে ইউরোপকে নিজের পিঠে বহন করে সাঁতরে ক্রীট দ্বীপে নিয়ে আসেন। এ কারণেই ষাঁড়ের পূজা করে ক্রীটবাসিরা। তাদের আঁকা ফ্রেস্কোতেও প্রাধান্য পেয়েছে ষাঁড়। ষাঁড়ের নৃত্যও তাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।

গ্রিসের ক্রেট অঞ্চল

গ্রিসের ক্রেট অঞ্চলের ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে আইল্যান্ড অব ক্রাইসি। এই ক্রাইসি দ্বীপ এক সময় মিনোয়ান সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ছিল।

রাজমহলটি তিন তলা বিশিষ্ট। সিংহাসনে বসেই রাজা তার সভাসদদের মাধ্যমে সব কাজের খোঁজখবর রাখছেন। কারণ ক্রীটে রাজাই রাজ্যের প্রধান পুরোহিত। সামরিক ও বেসামরিক সব কাজের প্রধান তিনি। তবে শাসক হিসেবে রাজার কোনো তুলনা ছিলো না। প্রজাদেরকে তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই সাধারণ মানুষও মন থেকে শ্রদ্ধা করতো তাকে। ক্রীটের রাজা ছিলেন শান্তিপ্রিয় এবং সৃজনশীলতার আধার।

পূজার এতোসব আয়োজনের মাঝেই থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সব কিছু। চারপাশে সমুদ্রবেষ্টিত ক্রীটের এমন কম্পনের সাথে তারা রীতিমতো অভ্যস্ত, তাই তেমন একটা আমলে নিলো না কেউই। তবে এবারের পরিস্থিতিটা একটু অন্যরকম, যেনো বেড়েই চলেছে কম্পন। হঠাৎ করেই চারদিক অন্ধকার করে ধেয়ে এলো সুনামি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংস হয়ে গেলো উৎসবমুখর নসোস। তছনছ হয়ে গেলো ক্রীটে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব সংস্কৃতি, বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে গেলো প্রাচীন এক প্রগতিশীল সভ্যতা, মিনোয়ান সভ্যতা।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ সাল পর্যন্ত ব্যাপক প্রসার ঘটেছিলো মিনোয়ান সভ্যতার। তারপর আত্মঘাতী এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে এই সভ্যতা। অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এটি। হ্যাঁ, এই মিনোয়ান সভ্যতাই ছিলো ইউরোপের প্রথম প্রগতিশীল সভ্যতা।

মিনোয়ান সভ্যতা প্রথম প্রগতিশীল সভ্যতা

১১০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এই মিনোয়ান সভ্যতা। মিনোয়ান সভ্যতাকেই ইউরোপের প্রথম প্রগতিশীল সভ্যতা বলা হয়।

১৮৯৪ সাল। সদ্য স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে প্রত্নতত্ত্ববিদ আর্থার ইভান্সের। তার বাবাও ছিলেন নামকরা প্রত্নতত্ত্ববিদ। ইভান্সের উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। তাই স্ত্রী চলে যাওয়ার দুঃখটাকে বৃথা যেতে দিলেন না তিনি, নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন ইচ্ছে-সাগরে, আরও একবার বেরিয়ে পড়লেন তিনি। হ্যাঁ, ১৮৯৪ সালে তিনিই খুঁজে পেয়েছিলেন ক্রীট দ্বীপে নসোস শহরের ধ্বংসাবশেষ। শুরুর দিকে শুধু তাবিজের মতো কিছু সীল চোখে পড়ে তার। নিঃসন্দেহে মানুষের কাজ এটি! কৌতূহল নিবৃত্ত করতে আরেকটু গভীরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ইভান্স এবং খুঁজে পেলেন অভাবনীয় প্রগতিশীল এই সভ্যতার অস্তিত্ব। পৃথিবীকে যখন এই সভ্যতার সাথে পরিচয় করানো হলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো সবাই। অনেকে তো এ-ও মনে করেন, প্লেটো সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাওয়া যে আশ্চর্য দ্বীপ আটলান্টিসের কথা বলেছেন, ক্রীটই সেই দ্বীপ, যেখানে গড়ে ওঠেছিলো মিনোয়ান সভ্যতা। তবে এই ব্যাপারে হলফ করে বলবার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। থেরার অগ্ন্যুৎপাত থেকে যে সুনামির সৃষ্টি হয়েছিলো, তাতেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো মিনোয়ান সভ্যতা, হারিয়ে গিয়েছিলো সাগরের তলদেশে।

‘মিনোয়ান’ নামটি পৌরাণিক রাজা মিনোসের নাম অনুসারে ইভান্সই রেখেছিলেন। নিজেদেরকে আসলেই তারা কি বলে ডাকতো সেটা আর জানা যায় নি। এই সভ্যতাটি অলক্ষ্যে চলে যাবার কারণ হিসেবে ইভান্স বলেন, চারিদিক থেকে সমুদ্র পরিবেষ্টিত অবস্থায় থাকবার কারণেই তাদের সম্পর্কে খুব একটা জানতে পারে নি মানুষ। কিন্তু তার এই ধারণা ভুল ছিলো। আসলে ভূমধ্যসাগর ও ইজিয়ান সাগর চষে বেড়ানো এই জাতির সাথে বিশ্বের বহু অংশেরই ছিলো গভীর বাণিজ্যিক যোগাযোগ। যে সাগর তাদেরকে লোকালয় থেকে আলাদা করে রেখেছিলো, সেই সাগরই তাদেরকে যুক্ত করেছে সবার সাথে, পরিণত করেছে আধুনিকতম জাতিতে। তবে এ কথা বলতে ভীষণ দুঃখ হয়, যে সাগর মিনোয়ানদের দিয়েছে এমন আশ্চর্য উত্থান, সেই সাগরই তাদের পতনের জন্য দায়ী।

এবার একটু জানা যাক, কারা এই মিনোয়ান? সমুদ্রবেষ্টিত এই ক্রীটেই বা কি করে আসলো তারা? ক্রীট এবং মিনোয়ান সভ্যতাকে জানতে হলে আমাদেরকে সাত হাজার বছর পেছনে যেতে হবে। সে সময়কার যেসব শস্যদানা পুরাতত্ত্ববিদরা ক্রীটে পেয়েছেন, তা প্রাচীন এনাটোলিয়ার শস্যদানার সাথে মিলে যায়। তাই ধারণা করা হয়, ক্রীটের আদি বাসিন্দারা এনাটোলিয়া থেকে মাইগ্রেট করেই এখানে এসেছিলো। এমনকি তাদের ডিএনএ অ্যানালাইসিস থেকেও এর প্রমাণ মিলেছে।

The Kefti bringing tributes to Egpyt

মিশরের দেওয়াল চিত্রে ক্রীটের বণিক 

ক্রীটে মিনোয়ানদের বিকাশ লাভের প্রক্রিয়াটি খুব সময়সাপেক্ষ ছিলো না। ক্রীটের মাটি ছিলো ভীষণ উর্বর, আর তারা ছিলো কৃষিকাজে দক্ষ। সুতরাং সোনায় সোহাগা! প্রথম দিকে কৃষিকাজের জন্য তারা কাঠ ও হাড়ের তৈরী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতো। খুব দ্রুতই মিনোয়ানরা একই জমিতে বহুবার ফসল উৎপাদনের কৌশল অর্জন করেছিলো। তাদেরকে আরও শক্তিশালী করে তোলে মৌমাছির চাষ ও মধু বাণিজ্য। উদ্বৃত্ত ফসল বিপণনের চিন্তা থেকে তারা তৈরী করে নৌকা। আর এভাবেই শুরু হলো মিনোয়ানদের সমুদ্রে চড়ে বেড়ানো অ্যাডভেঞ্চারের। সমুদ্রপথের এক অপরাজেয় খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভাব হলো তাদের।

অনেক অর্জন থাকলেও কিছু অপূর্ণতাও ছিলো তাদের। সেই সময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিলো ব্রোঞ্জ, যা তৈরীতে কপার ও টিনের প্রয়োজন। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদানকে কি করে হেলায় হারাতে পারে তারা! যেভাবেই হোক, এই অপূর্ণতাকেও ঢেকে ফেলতে হবে, নাম লেখাতে হবে শ্রেষ্ঠত্বের খাতায়। শুরু হলো নতুন প্রচেষ্টা। কারখানা নির্মিত হলো ব্রোঞ্জের মনোহরি দ্রব্য তৈরীর জন্য। পটারী, নকশা করা সোনার গয়না, জলপাই এর তেল, ওয়াইন, কাপড় রং করার বিশেষ রঞ্জক-প্রাকৃতিক বেগুনী রং, হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দ্রব্য প্রভৃতি সব ধরনের চাহিদাসম্পন্ন জিনিসপত্রও তৈরী করলো তারা এবং এসবই সমুদ্রপথে নিয়ে যাওয়া হলো সাইপ্রাস, মিশর ও মেসোপটেমিয়ার মতো জায়গাগুলোতে। এক বিশাল বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হলো ক্রীটের মিনোয়ান সভ্যতা।

 Intricate craftsmanship of Minoan jewelry.

এই মিনোয়ান সভ্যতার বিপুল সম্পদই সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ক্রাইসির মাটি খুঁড়ে তাঁরা উদ্ধার করেছেন সোনার গয়না ও প্রচুর মূল্যবান সম্পদ।

মিনোয়ানরা ছোট ছোট মাটির ট্যাবলেটে লিখে গেছে অনেক কিছু। ‘লিনিয়ার-এ’ নাম দেয়া হয় সেই লিখন পদ্ধতিকে। হয়তো নিজেদের ইতিহাসই ছিলো সেগুলো। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আজও সে সব লেখার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। ফলে অধরাই থেকে গেছে মিনোয়ানদের নিজেদের কথা। তবে এই হতাশা থেকে মুক্তি দিতে আশার আলো নিয়ে এলো মিশরের পিরামিডে আঁকা ক্রীটের ব্যবসায়ীদের দেয়ালচিত্র এবং কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের আরেকটি লিখন পদ্ধতি ‘লিনিয়ার-বি’, যার সাথে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার কিছুটা মিল পাওয়া গিয়েছিলো। মিশরীয়রা মিনোয়ানদেরকে ‘কেফটিউ’ বলে অভিহিত করে। মিনোয়ানরা প্রসাধন সামগ্রী, লেদার বুট, মনোহরী দ্রব্য, মাটির পাত্র ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে গিয়েছিলো মিশরে বাণিজ্য করবার জন্য।

মিনোয়ানদের একটি দেয়ালচিত্র পাওয়া গেছে মিশরের তেল-এল-দাবা তে ফারাও তৃতীয় থুতমোসের একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর সমাধিতে। আরেকটি ফ্রেস্কো পাওয়া গেছে রেখ-মি-রে সমাধিতে। মিনোয়ান ফ্রেস্কোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ‘বুল-লিপিং’ এর চিত্র। বুল-লিপিং মিনোয়ানদের অন্যতম প্রধান রিচুয়াল। মূলত ষাঁড়ের পিঠের ওপর দিয়ে লাফিয়ে ষাঁড়ের গতিরোধ করতে পারার এক অদ্ভূত খেলা এটি। এখনও ফ্রান্সের কিছু কিছু জায়গায় প্রচলিত আছে এই রিচুয়াল। নিজেদের শক্তি, সামর্থ্য ও পৌরুষত্বকে প্রমাণ করবার জন্যই প্রচলন ছিলো এমন রিচুয়ালের। মিনোয়ান নারীরা বিজয়ীদের মধ্য থেকে নিজেদের জন্য বর পছন্দ করে নিতো।

Kleine Schlangen

সর্পদেবী

ব্যবসার উদ্দেশ্যে তৈরী মিনোয়ানদের সবচেয়ে দামী দ্রব্যটি ছিলো কাপড়ে ব্যবহারের একটি বিশেষ বেগুনী রঞ্জক, যার কথা আগেই বলা হয়েছে। শামুকের শরীর থেকে তৈরী করা হতো এটি। ‘ভায়োলেট’ নামে পরিচিতি পায় এই রংটি। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই রং থেকে আসতো প্রচুর বৈদেশিক আয়। এর মূল্য এতো বেশি ছিলো যে, পরবর্তীতে প্লিনি এই রং-কে রূপার চেয়েও মূল্যবান এবং বিত্তবানদের সবচেয়ে পছন্দের পণ্য বলে অভিহিত করেন।

সমুদ্রপথের প্রধান হাতিয়ার হলো নৌকা। আর কাঠও ছিলো মিনোয়ানদের হাতের নাগালে। তাই সমুদ্রপথে বাণিজ্যের চিন্তা থেকেই উন্নত থেকে উন্নততর নৌকা প্রস্তুতের দিকে মনোযোগ দিলো তারা। ক্রীট দ্বীপটির ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সমুদ্রপথের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করা তাদের জন্য সহজ ছিলো। নৌকায় ওঠার ২৮ দিনের মধ্যে মিশরে পৌঁছে যাওয়া যেতো। তাছাড়া এক দিকে পাহাড় ও অন্য দিকে সমুদ্র থাকার ফলে বহিঃশক্তির আক্রমণের ভয়ও ছিলো কম। তবে তারা সাহসীও ছিলো বটে। শত্রুর ভয়ে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখে নি তারা। বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে অন্য দেশের মানুষকে তাদের নিজেদের ভূখন্ডে এসে ব্যবসা করবার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করার জন্য সবগুলো পোর্ট খুলেও দিয়েছিলো। এভাবেই কৃষিজীবী মিনোয়ানরা একটু একটু করে ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলো।

নসোসের কথা তো একটু না বললেই নয়। অসংখ্য সমৃদ্ধ শহর গড়ে উঠেছিলো ক্রীটে। তবে নসোস ছিলো তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভূমধ্যসাগরের পাশে সবচেয়ে বড় শহর নসোস। শহরের পাশে পাহাড় এবং কোল ঘেঁষে রয়েছে বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদটি আসলে অনেকগুলো দালানের সমষ্টি। প্রাসাদের মধ্যে ঘরের কোনো শেষ নেই। বসার ঘর, খাবার ঘর, সভা ঘর তো আছেই; আরও আছে রাণীর বিশেষ কামরা, যেখানে রয়েছে আধুনিক গোসলখানা, বাথটাব, টয়লেট, এমন কিছু নেই যেটা সেখানে নেই। প্রাসাদের দুই স্তরের দেয়াল শব্দদূষণমুক্ত রা্খতো। মাঝখানে ছিলো শানবাঁধানো উঠান। রাজার ঘরের জানালা থেকে সরাসরি দেখা যেতো ভূমধ্যসাগরের অপরূপ নীলাভ সৌন্দর্য। প্রাসাদের কিছু অংশ ছিলো বহুতলবিশিষ্ট। সিঁড়িগুলো ছিলো প্রশস্ত। শক্ত পিলারগুলো ছিলো কাঠ ও ইটের তৈরী।

Minoan palace of knossos

ক্রাইসির এই অঞ্চলে মিনোয়ান সভ্যতার বিশাল রত্নভাণ্ডার রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ৩৮০০ বছরের পুরনো ব্রোঞ্জ যুগের এই এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ির পর প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই সাফল্য মিলেছে।

প্রাসাদের ভেতরের দেয়াল ছিলো ধূসর বর্ণের, তার উপর ফ্রেস্কো বা দেয়ালচিত্র আঁকা। আঁকা হতো নিত্যদিনের সমাজ ও জীবনযাত্রার অপূর্ব সব ছবি। সামুদ্রিক জীবন, সমুদ্রের প্রাণী, শিকারের দৃশ্য, লতাপাতার অলংকার যেনো চোখ জুড়িয়ে দেয়।

রঙিন ছবিগুলো আঁকার পদ্ধতি কিছুটা প্রাচীন ধারার হলেও শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা রঙের ব্যবহারের মাধ্যমে চমৎকার সব দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন। রং মিশিয়ে নতুন রং তৈরীর কৌশলও তারা অর্জন করেছিলো।

ভাস্কর্যের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিলো না। তবে যে কয়টাই ছিলো, সেগুলো তৈরীতেও যথেষ্ট যত্নের ছাপ আছে। পশুমূর্তিগুলো দেখতে একেবারে জীবন্ত মনে হয়। ষাঁড়ের একটি মূর্তিতে যে কারো চোখ আটকে যাবে। মূর্তিটির মাথাটা হালকা কাত করা, জ্বলজ্বল চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেটি, তার সেই দৃষ্টি যেনো দর্শকের অন্তরকেও ভেদ করে ফেলে।

মৃৎশিল্পীরা মসৃণ পাত্রের গায়ে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করে তৈরী করতো প্রাণকাড়া সব চিত্র ও নকশা। চীনামাটির পাত্র থেকে কোনো অংশে কম ছিলো না সে সব পাত্রের সৌন্দর্য। ভীষণ সুন্দর সোনার বাটীও পাওয়া গেছে, যা নিঃসন্দেহে ছিলো মিনোয়ানদের আভিজাত্যের প্রতীক।

মিনোয়ান সভ্যতার কারুকার্য করা কাচের টুকরো

ব্যবসা সূত্রে মিশরের সঙ্গেও এই সভ্যতার যোগাযোগ ছিল বলে জানিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। মাটি খুঁড়ে যে কারুকার্য করা কাচের টুকরো উদ্ধার হয়েছে, তার অনেকগুলো মিশরীয় সভ্যতার। তা থেকেই তাঁদের অনুমান, মিশরেও এই সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল।

শুরুতেই বলেছিলাম, দেবতা নয়, দেবীই তাদের প্রধান আরাধ্য। নিজেদেরকে তারা গ্রীক দেবতা জিউসের সন্তান বলে মানলেও দেবীর আরাধনাই ছিলো তাদের জন্য মুখ্য। মাতৃতান্ত্রিক মিনোয়ান সমাজে প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা দেবীর পূজা করা হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতেও বিশেষ দেবীর পূজা হতো। তারা বিশ্বাস করতো, দেবীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা। পৃথিবীর সব ভালো এবং খারাপ কাজের পেছনেও রয়েছে দেবীর ইচ্ছা। প্রধান দেবীর সহকারী হিসেবে পাতালের দায়িত্বে থাকা সর্পদেবী, পৃথিবীর দায়িত্বে থাকা বুনোপ্রাণীর দেবী এবং স্বর্গের দেবী কবুতরের অস্তিত্বকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতো তারা। উপাসনার জন্য তারা মন্দির তৈরী করে নি। বরং উন্মুক্ত আকাশ, পাহাড়ের গুহা, গাছের নিচে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় বসে অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য দেবীর কাছে প্রার্থনা করতো তারা।

ক্রীটের প্রাচীনতম মিনোয়ান সভ্যতা এক কল্পনাতীত অগ্রগতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের মাঝখানে থেকেও তারা সেই সময়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে থাকে নি, বরং এগিয়ে ছিলো কয়েকশো গুণ। তারা নিজেদের মেধা ও শ্রমকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজে লাগিয়েছে এবং আমাদের জন্য রেখে গেছে শিক্ষার বীজ। বহু প্রথমের জন্ম দিয়েছে এই ক্রীট –প্রথম জোড়া রাস্তার প্রচলন, প্রথম সিংহাসনে অধিষ্ঠান, টয়লেটে প্রথমবার ফ্লাশের ব্যবহার, প্রত্যেকটিই বিস্ময় জাগানিয়া। এতো প্রাচীন সময়েও নারীর মূল্যায়ন ছিলো সর্বাধিক, অধিকার খর্বের তো প্রশ্নই আসতো না তাদের মাঝে। সেই প্রলয়ঙ্করী সুনামিতে শুধু একটি জনগোষ্ঠীই হারিয়ে যায় নি, সেই সাথে হারিয়ে গেছে এক অকল্পনীয় সম্ভাবনাময় সভ্যতার চিহ্ন।

রেফারেন্সঃ