প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। দেবী ইশতারের পূজোয় নিবেদিত একজন নারী পুরোহিত চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে ইউফ্রেটিস নদীর দিকে যাচ্ছেন। কোলে তার নবজাতক শিশু। একটি ঝুড়ির মধ্যে প্রাণপ্রিয় সন্তানটিকে শুইয়ে দিয়ে ভাসিয়ে দিলেন ইউফ্রেটিস নদীর স্রোতে। কুমারী মাতা তিনি। গোপনে জন্ম দেয়া এই সন্তানকে তো তিনি চাইলেও রাখতে পারবেন না। স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে ঝুড়িটি পৌঁছলো মেসোপটেমিয়ার কিশ শহরে। সেখানকার একজন মালীর চোখে পড়লো ঝুড়িটি। তিনি এগিয়ে গেলেন। ঝুড়ির মধ্যে ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে চমকে গেলেন মালী। ভীষণ মায়া হলো তার। কোলে তুলে নিলেন তিনি শিশুটিকে এবং আইনগতভাবে দত্তক নিলেন তাকে। মালীকে বাবা মেনে বড় হতে থাকলো নদীতে ভেসে আসা ছোট্ট শিশুটি। জন্মের পর তার নাম কি রাখা হয়েছিলো, আমরা তা জানি না। শুধু এই গল্পটুকুই জানা গেছে রাজা আশুরবানিপালের বিখ্যাত লাইব্রেরিতে পাওয়া একটি ট্যাবলেট থেকে।

পরিচয়বিহীন সেই শিশুকে দত্তক নেয়া মালীর সাথে ছিলো রাজপরিবারের যোগাযোগ। শিশুটি যুবক বয়সে উপনীত হবার পর তাই খুব সহজেই রাজা উর-জাবাবার পেয়ালা-বাহক বা সুরা-বাহকের কাজে নিযুক্ত হবার সুযোগ পেলেন। আর এই পেশায় রাজার কাছাকাছি থাকতে পারা ছিলো খুব সহজ এবং হয়েছিলোও তা-ই। সুরা-বাহকের কাজে নিয়োগ পেতে হলে কোনো মানুষকে অত্যন্ত দক্ষ, যোগ্য, চালাক এবং বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হতো। আর সেই সমস্ত গুণে গুণান্বিত ছিলেন মালীর পালিত ছেলেটি। এক পর্যায়ে তিনি রাজার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করতে শুরু করলেন।

আক্কাদের সার্গন দ্য গ্রেট: একজন সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাট হয়ে ওঠার গল্প

সার্গন ছিলেন সম্রাট উর-জাবাবার পেয়ালা-বাহক; © Pazasaurus.

বহু সুমেরীয় নগররাষ্ট্র মিলে গড়ে উঠেছিলো মেসোপটেমীয় সভ্যতা। দেখা যেতো, এক রাজ্যের সাথে অন্য রাজ্যের প্রতিনিয়তই যুদ্ধ লেগে থাকতো। এমনই আরেক সুমেরীয় নগর রাজ্য উম্মার (ইরাকে অবস্থিত) রাজা ছিলেন লুগাল-জাগে-সি। তিনি ছিলেন তৃতীয় উরুক সাম্রাজ্যের একমাত্র শাসক। সুমেরের বহু শহর জয় করে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তার সাথেই যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন উর-জাবাবা। আর এ যুদ্ধের সময় নিজের অনুপস্থিতিতে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গেলেন নিজের সুরা-বাহক ছেলেটিকে।

রাজার অনুপস্থিতিতে ছেলেটি ভীষণ শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একদিন ছেলেটি স্বপ্নে দেখলেন, দেবী ইশতার উর-জাবাবার উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট এবং উর-জাবাবাকে হত্যা করে তার আশীর্বাদপুষ্ট হবার জন্য তিনি ছেলেটিকে নির্দেশ দিচ্ছেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানবার জন্য ছেলেটি গণকের কাছে গেলে বিদ্যুৎ-বেগে তা ছড়িয়ে পড়লো রাজপ্রাসাদে।

এই স্বপ্নের বিষয়টি রাজা উর-জাবাবার কানে যাবার পর তিনি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন এবং নিজের একান্ত বিশ্বস্ত কিছু লোককে নিয়োগ করলেন তার পেয়ালা-বাহককে হত্যা করবার জন্য। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সবাই-ই এতে ব্যর্থ হলেন। অবশেষে উর-জাবাবা ছেলেটিকে তার শত্রু লুগাল-জাগে-সির সাথে রাষ্ট্রীয় বৈঠকের অজুহাত দিয়ে পাঠালেন এবং একটি ট্যাবলেটের মাধ্যমে লুগাল-জাগে-সির কাছে বার্তা দিলেন, যেনো বার্তাবাহককে তিনি হত্যা করেন। লুগাল-জাগে-সিও সুযোগ পেয়ে শত্রুর উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য ছেলেটির সামনে সব ফাঁস করে দিলেন। এতে ছেলেটি ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন এবং লুগাল-জাগে-সির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে উর-জাবাবার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। লুগাল-জাগে-সির সামরিক শক্তি এবং উর-জাবাবার পেয়ালা-বাহক ছেলেটির বৈষয়িক বুদ্ধি, জ্ঞান ও কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে শত্রুকে উৎখাত করতে তাদেরকে বেশি বেগ পেতে হলো না। খুব দ্রুতই কিশ শহরটি জয় করে ফেললেন তারা। তার কিছু দিনের মাঝেই লুগাল-জাগে-সির সাথেও মতের অমিল দেখা দিলো ছেলেটির। তিনি নিজ যোগ্যতায় বহু রাজ্যের অধীশ্বর লুগাল-জাগে-সিকেও পরাজিত করলেন এবং এর মাধ্যমে মেসোপটেমিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল নিজের অধীনে নিয়ে আসলেন। পরিণত হলেন রাজাদের রাজা সার্গন দ্য গ্রেটে।

আক্কাদের সার্গন দ্য গ্রেট: একজন সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাট হয়ে ওঠার গল্প

সার্গনের জন্মকাহিনি সম্বলিত কিংবদন্তি; © Louvre Museum.

নাম-পরিচয়বিহীন এক তরুণ হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম সম্রাট, উপনীত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের শাসকদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণায়। ‘সার্গন’ শব্দের অর্থ ‘সত্যিকার শাসক’। তিনি এতোটাই সফল সম্রাট ছিলেন যে, তার উত্তরসূরিরা নিজেদের নামে ‘সার্গন’ শব্দটি ব্যবহার করতেন অত্যন্ত গর্বসহকারে।

কে জানে! হয়তো বুদ্ধিমান সার্গন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই দেবী ইশতারের নামে একটি মনগড়ন স্বপ্নের প্রচারণা চালিয়ে সবাইকে বোকা বানিয়েছিলেন। হয়তো এ সবই ছিলো তার পরিকল্পনা। সম্রাট হবার সত্যিকার লালিত স্বপ্নকে পুঁজি করে হয়তো খুবই সাবধানতার সাথে অগ্রসর হয়েছিলেন সার্গন। তবে এ-ও সত্যি, দেবী ইশতারকে সব সময় যথাযথ মর্যাদায় আসীন করেছিলেন তিনি। তার সমস্ত কাজেই ছিলো দেবী ইশতারের জয়-জয়কার। ভক্তিভরে ইশতারকে একটি নতুন নামও দিয়েছিলেন তিনি, ‘ইনান্না’।

একের পর এক অসংখ্য রাজ্য জয় করেও পুরোপুরি সন্তুষ্টি লাভ করতে পারছিলেন না সার্গন। রাজ্য জয়ের জন্য তিনি সাইপ্রাসও দাবি করেছিলেন, যাত্রা করেছিলেন ভূমধ্যসাগরেও। বাণিজ্যের জন্য ভারতবর্ষ পর্যন্ত তিনি জাহাজ পাঠিয়েছিলেন। সমস্ত মেসোপোটেমিয়া জয়ের পর তিনি লেবানন, তুরস্ক ও সিরিয়া পর্যন্ত তার সম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীবিন্যাস করে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ তিনিই শুরু করেছিলেন। সার্গনই সর্বপ্রথম ভাড়া করা সৈন্যের পরিবর্তে স্থায়ী পদাতিক সৈন্যবাহিনীর প্রচলন করেছিলেন।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মাঝেও সার্গনের আদর্শই প্রতিফলিত হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্রাজ্য গড়ে না তোলা পর্যন্ত তিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে একের পর এক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একটি শিলালিপিতে লেখা আছে, উপরের সমুদ্র থেকে নিচের সমুদ্র পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে গেছেন সার্গন। তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রথম সর্ববৃহৎ আক্কাদীয় সাম্রাজ্য।

আক্কাদের সার্গন দ্য গ্রেট: একজন সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাট হয়ে ওঠার গল্প

স্বপ্নে সার্গনের কাছে এসেছেন দেবী ইশতার; © Edwin J. Prittie.

সার্গন শুধুমাত্র রাজ্য জয়ই করেন নি, সম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখবার জন্য অবলম্বন করেছেন কতগুলো অভিনব পন্থা। প্রশাসন ব্যবস্থাকে খুবই সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তিনি জানতেন, তার একার পক্ষে এতো বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি কোণায় গিয়ে গিয়ে রাজ্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি কৌশলগতভাবে তার সবচেয়ে যোগ্য, সেরা ও বিশ্বস্ত লোকগুলোকে নির্বাচন করেছিলেন এই কাজে। এভাবে বিজিত রাজ্যগুলোর কেন্দ্রে অবস্থান করে সমগ্র সম্রাজ্যকে নির্বিঘ্নে পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন সার্গন। সুতরাং ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্রের প্রবর্তকও বলা যায় সম্রাট সার্গনকে।

তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিজের মেয়ে এনহেদুয়ান্নাকে উরে দেবী ইশতারের পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে খুব সহজেই পরিচালনা করতে পেরেছিলেন।

সার্গনের মেয়ে এনহেদুয়ান্না সম্পর্কেও কিছুটা উল্লেখ না করলেই নয়। বিশ্বের প্রথম লেখিকা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এই নারী। কিউনিফর্মগুলোতে তার জীবন সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়। শুধু সাহিত্য অঙ্গনেই তার প্রতিভা ছিলো না, তিনি একই সাথে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও শক্তিশালী একজন প্রশাসক।

সার্গন নিজের শত্রুর প্রতি ছিলেন নির্দয়। অন্য দিকে, সম্রাট হিসেবে প্রজাদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সহানুভূতিশীল। বিধবা, অনাথ ও ভিক্ষুকদের জীবনকে উন্নত করবার জন্য তিনি নানা রকম বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার গতিশীলতা ও সচেতন মনোভাব তাকে প্রজাবৎসল সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। সম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রকেই তিনি সংস্কার করেছিলেন।

আক্কাদের সার্গন দ্য গ্রেট: একজন সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাট হয়ে ওঠার গল্প

সুমেরীয় এবং সেমাইটীয়দের চলমান যুদ্ধ, যার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সম্রাট সার্গন; © Alamy.

আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে আক্কাদের মানুষের মুখের ভাষা ছিলো সুমেরীয়, আর লেখার প্রধান মাধ্যম ছিলো কিউনিফর্ম। সম্রাট হবার পর সার্গন রাষ্ট্রে নতুন ভাষার সূচনা করেছিলেন, আক্কাদীয় ভাষা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আক্কাদীয় ভাষাই ছিলো ভবিষ্যতের বহু সুমেরীয় ভাষার পূর্বসূরি। আরবি এবং হিব্রু ভাষারও পূর্বরূপ হচ্ছে সার্গনের এই আক্কাদীয় ভাষা। বিজ্ঞানীরা এই ভাষাকেই প্রথম নথিভুক্ত সেমিটিক ভাষা বলে বর্ণনা করেন। এই ভাষাটিই পরবর্তীতে ব্যবিলনীয় ভাষার উপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিলো।

সার্গনের সাম্রাজ্য ছিলো কৃষিপ্রধান। অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান, যেমন, ধাতু বা কাঠ তার সাম্রাজ্যে ছিলো না। তাই তিনি মনোনিবেশ করলেন ব্যবসা-বাণিজ্যে। সেই সাথে তিনি রাস্তা তৈরী করলেন এবং খাল কেটে উন্নত সেচের ব্যবস্থাও করলেন। বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য গবেষণা কাজ এবং শিল্প বিস্তারের জন্য বিভিন্ন প্রজেক্টে তিনি প্রণোদনা দিয়েছিলেন। আক্কাদীয় সাম্রাজ্যে প্রথম ডাক-ব্যবস্থার প্রচলন তিনিই করেছিলেন। আক্কাদীয় কিউনিফর্ম লিপিতে খোদাই করা ট্যাবলেটগুলোতে প্রাপকের নাম-ঠিকানা ও প্রেরকের সিলমোহর দেখতে পাওয়া গিয়েছে।

সার্গনের শাসনামলের এই চিঠিগুলো মাটির খামের মধ্যে মুড়ে দেয়া হতো। যে ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে চিঠিগুলো লেখা হতো, মাটির খামটি ভাঙ্গার পর যেনো শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিই চিঠিটি খুলতে পারেন, এমন ব্যবস্থা ছিলো সার্গনের ডাক-ব্যবস্থায়। এভাবে চিঠির গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হতো আক্কাদে।

একজন যোগ্য নেতা ছিলেন সার্গন। দৈনন্দিন ব্যবসা-বাণিজ্যে সঠিক পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তিনি আদর্শ পরিমাপক স্কেলের সূচনা করেছিলেন। ওজন ও মান ঠিক রেখে সুনির্দিষ্টভাবে নিজের কর্তব্য পালন করেছেন তিনি। কর-ব্যবস্থারও সূচনা করেছিলেন সার্গন এবং এর মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার প্রদর্শনের চেষ্টা তিনি করে গেছেন।

আগেই বলা হয়েছে, স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠনে সার্গনের অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য সেনা তৈরী সার্গনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আক্কাদ শহরে পাওয়া একটি শিলালিপিতে লেখা ছিলো, প্রায় ৫৪০০ জন সৈন্য প্রতিদিন সম্রাটের সাথে রুটি খেতেন। এতে প্রমাণিত হয়, রাষ্ট্রের সবার প্রতি তিনি সমান সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং যোগ্যতার সাথে নিজের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।

আক্কাদের সার্গন দ্য গ্রেট: একজন সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাট হয়ে ওঠার গল্প

সার্গনের ছবি সম্বলিত সিলিন্ডার পাওয়া গেছে কিশির ধ্বংসাবশেষে; © The Field Museum.

সার্গনের উন্নত নীতির জন্য তার শাসনামলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু আক্কাদীয় শাসনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যের শেষ সময়টাতে বিদ্রোহ লেগেই থাকতো। আক্কাদ একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত শহর হওয়া সত্ত্বেও সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কখনোই পুরোপুরি শেষ হয় নি। এই বিদ্রোহগুলো মোকাবেলা করতে সার্গনকে বেশ অনেকটা সময় পার করতে হয়েছে। এভাবে প্রায় ৫৬ বছর রাজত্ব করার পর প্রাকৃতিকভাবেই বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

সার্গন যতো দিন বেঁচেছিলেন, ততো দিন রাষ্ট্রের প্রতি, জনগণের প্রতি তিনি সুষ্ঠুভাবে তার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। দেবী ইশতারের প্রতি পরম ভক্তির মর্যাদা নিয়েই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।

সার্গনের মৃত্যুর পর তার ছেলে রিমুশ হয়েছিলেন আক্কাদের দ্বিতীয় সম্রাট। রিমুশ প্রায় নয় বছর রাজত্ব করার পর মারা যান। এরপর সার্গনের তৃতীয় ছেলে মানিশতুশু সম্রাট হন। তিনি পনেরো বছর রাজত্ব করেন। তবে আক্কাদীয় সম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন সার্গনের নাতি নারাম-সিন।

নারাম-সিনের মৃত্যুর পর থেকে আস্তে আস্তে একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হতে শুরু করে। চারদিক থেকে আক্রান্ত হতে শুরু করে আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। গবেষণায় জানা গেছে, সে সময়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছিলো, দুর্ভিক্ষও হয়েছিলো। এ সমস্ত কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে দুর্বলতার চরমে পৌঁছে সার্গনের আক্কাদ। এরই মধ্যে পূর্ব দিক থেকে আবির্ভাব হয় এক আধা-যাযাবর উপজাতি ‘গুতিয়ান’-দের। এই বর্বর জনগোষ্ঠী আক্কাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিলো। গুতিয়ান বাহিনীর প্রবল আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা ততো দিনে লোপ পেয়েছে আক্কাদীয় সেনাদের। এরই ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টপূর্ব ২১৫৪ সালের দিকে গুতিয়ানদের আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় আক্কাদীয় সাম্রাজ্য।

আক্কাদের সার্গন দ্য গ্রেট: একজন সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাট হয়ে ওঠার গল্প

আক্কাদীয় সভ্যতায় দেবী ইশতারের প্রতিমূর্তি; © Wikimedia Commons.

দুঃখের বিষয় হলো, মৃত্যুর ২০০০ বছর পরও অসংখ্য শাসকের আদর্শ ও ‘মহাবিশ্বের রাজা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকা সার্গনের আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের মূল অবস্থান সম্পর্কে আজও সঠিকভাবে জানা যায় নি।

নদীতে ভাসিয়ে দেয়া একজন পরিচয়হীন শিশু থেকে বহু চরাই-উৎরাই পেরিয়ে একজন মহান নেতা হয়ে ওঠা সার্গন পৃথিবী শাসনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে গেছেন। হয়তো হিব্রু লেখকেরা তার জীবনের কাহিনী থেকে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েই রচনা করেছিলেন মূসার কাহিনী, কেননা মূসার জন্মের কাহিনীর সঙ্গে সার্গনের জন্মের কাহিনীর এক অদ্ভূত মিল লক্ষ করা যায়। এ ছাড়াও পরবর্তীকালের অসংখ্য কাহিনীতে সার্গনের গল্পের ছাপ স্পষ্টত লক্ষণীয়।

 

রেফারেন্স: