পৃথিবীর এযাবৎ কালের সবচেয়ে রহস্যময় স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে মিশরীয় পিরামিড। এই পিরামিডগুলো হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জানা মতে, গিজার পিরামিড থেকে শুরু করে প্রাচীন মিশরের অধিকাংশ পিরামিডই পাথর দিয়ে নির্মিত। অত্যন্ত উন্নত মানের ভারী পাথর ব্যবহার করেই তৈরী করা হয়েছিলো এসব পিরামিড। তবে মিশরীয় ফারাওদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মাটির পিরামিডও নির্মাণ করেছিলেন, যাদের মধ্যে বারো তম রাজবংশের চতুর্থ ফারাও দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিস এবং তার নাতি তৃতীয় আমেনেমহেটের নাম উল্লেখযোগ্য।
বেশ গুরুত্বপূর্ণ কৃষি অঞ্চল এল লাহুনে দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিস একটি মাটির পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন। আমরা সবাই-ই কম-বেশি এ ব্যাপারে অবগত যে, প্রাচীণকালের নির্মিত পিরামিডগুলো ছিলো মূলত ফারাও কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সমাধিস্থল। সুতরাং এল লাহুনে নির্মিত এই মাটির পিরামিডটিও ছিলো নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিসের সমাধিস্থল। দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিসকে অনেকে দ্বিতীয় সেনুসরেট নামেও চেনেন।
এল লাহুনে দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিসের পিরামিড কমপ্লেক্সটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় গঠনশৈলী অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছিলো। পিরামিডটির উত্তর দিকে একই সারিতে ছিলো ৮ টি মাস্তাবা বা আয়তাকার সমাধি। এর ঠিক পূর্ব পাশে একটি ছোট আকৃতির পিরামিডও পাওয়া গিয়েছে। এই ছোট পিরামিডটি কেনো নির্মিত হয়েছিলো, তা জানা যায় নি। অনেকে ধারণা করেন, হয়তো এটি কোনো মিশরীয় রাণীর পিরামিড, অথবা ফারাও সেসোস্ট্রসের প্রধান পিরামিডটির সাথে এই ছোট পিরামিডের কোনো সংযোগ রয়েছে। দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিসের পিরামিডটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, পিরামিডটির দক্ষিণ দিকে আরো ৪ টি সমাধি পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে ‘সমাধি আট’ নামে পরিচিত বিশেষ সমাধিতে তার মেয়ে রাজকুমারী সিঠাথোর ইউনেটের সমাধিও রয়েছে।
রাজকুমারী সিঠাথোর ইউনেটের সমাধি থেকে ১৯১৪ সালে ভীষণ আকর্ষণীয় কিছু অলংকার উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো একটি আয়না, রাজকুমারীর একটি মুকুট এবং একটি বক্ষবন্ধনী। প্রাচীন সমাধিগুলোতে আজ অবধি যতো সমাধি পাওয়া গিয়েছে, সিঠাথোর ইউনেটের সমাধিতে পাওয়া এই অলংকারগুলো ছিলো তাদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত মানের।
দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিসের নাতি ফারাও তৃতীয় আমেনেমহেট একটি ৭৫ ফুট উঁচু মাটির পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন দাশুরে। এই পিরামিডটিকে ‘কালো পিরামিড’ বলেও অভিহিত করা হতো। তবে পিরামিডটির বেশ কিছু গঠনগত দুর্বলতা ছিলো, যে কারণে পিরামিডটির নির্মাণ কাজ অসমাপ্তই রয়ে গেছে। এই পিরামিডের কাজ বাদ দিয়ে তৃতীয় আমেনেমহেট আরেকটি পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন। এটিও ছিলো মাটির ইটের তৈরী পিরামিড। তিনি তার রাজত্বের ১৫ তম বছরে এই পিরামিডটি নির্মাণ করেছিলেন ‘হাওয়ারা’ নামের একটি এলাকায়, যা দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিসের এল লাহুনের পিরামিডটির খুবই কাছাকাছি অবস্থিত ছিলো।
তৃতীয় আমেনেমহেটের এই পিরামিড সমাধির সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি ছিলো এর গোলকধাঁধা। তিনি ডাকাতি এবং লুটতরাজের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গোলকধাঁধায় পরিপূর্ণ ঘর, গ্যালারি ও উদ্যান তৈরী করেছিলেন। তৃতীয় আমেনেমহেটের এই পিরামিডেও তার নিজের সমাধির সাথে ছিলো তার মেয়ে রাজকুমারী নেফেরুপ্টাহের সমাধি। তবে সম্ভবত রাজকুমারী নেফেরুপ্টাহ তৃতীয় আমেনেমহেট জীবিত থাকা অবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন এবং তার জন্য আলাদা পিরামিড নির্মাণ করার আগে সাময়িকভাবে বাবার জন্য নির্মিত সমাধিতেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো।
অবশ্য পরবর্তীতে নেফেরুপ্টাহের পিরামিডও নির্মিত হয়েছিলো। তবে নেফেরুপ্টাহের সমাধিটি যখন পাওয়া গিয়েছে, তখন তা চার ফুট উঁচু পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো এবং ধারণা করা হয় যে, তার মমিটি পানিতে সম্পূর্ণরূপে দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছিলো। তবে এরপরও নেফেরুপ্টাহের সমাধিটি কিন্তু আমাদেরকে হতাশ করে নি। সেখান থেকে পাওয়া গিয়েছে তার পরিহিত গলার নেকলেস। চমৎকার এই গহনাটি থেকেই বর্তমানের বহুল ব্যবহৃত চকারের ডিজাইন অনুকরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
দ্বিতীয় সেসোস্ট্রিজ এবং তৃতীয় আমেনেমহেট -দুজনের মাটির পিরামিডেরই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। আর তা হলো, এই পিরামিডগুলোর প্রবেশ পথ, যা ছিলো উত্তর দিকে। সাধারণত প্রাচীন পিরামিড সমাধিগুলোর প্রবেশপথ রাখা হতো দক্ষিণ দিকে, যে দিক দিয়ে এই মাটির পিরামিডগুলো ছিলো ব্যতিক্রম। সম্ভবত ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যই এই মাটির পিরামিডগুলোর প্রবেশপথ উত্তর দিকে তৈরী করা হয়েছিলো, যদিও লুটের হাত থেকে সেগুলো পুরোপুরি রক্ষা পায় নি।