বিয়ার আজকের দিনের একটি বহুল জনপ্রিয় অ্যালকোহলিক পানীয়। পানি এবং চায়ের পর জনপ্রিয়তার দিক থেকে তৃতীয় স্থানেই বিয়ার নামের এই পানীয়টিকে রাখা যায়। সাধারণত গম বা ভুট্টা থেকে গাঁজনকৃত ও কার্বনযুক্ত করে তৈরী এই পানীয়টিতে শতকরা তিন থেকে চার ভাগ অ্যালকোহল থাকে, যেটি আসলে অ্যালকোহলের সবচেয়ে কম পরিমাণ নির্দেশ করে।
মিশরতত্ত্ববিদ হেলেন স্ট্রুডউইকের মতে, বিয়ার প্রস্তুতি এবং রুটি পোড়ানো উভয়ই ছিলো নারীদের কাজ। এছাড়াও বিভিন্ন সমাধিতে পাওয়া দেয়ালচিত্র কিংবা মূর্তিগুলো থেকে দেখা যায়, শস্য পেষা কিংবা মদ বানানোর কাজটিও নারীরা মিলেই করছেন। প্রথমে বিয়ার বাড়িতেই তৈরী করা হতো এবং স্বাভাবিকভাবে নারীরাই সেটা করতেন। পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পর পুরুষরা এই বিয়ার শিল্পের সঙ্গে জড়িত হন এবং স্থানে স্থানে শুঁড়িখানা তৈরী হয়। যেখানে বিয়ার উপাদানের কাজটি করা হতো, তাকেই বলা হতো শুঁড়িখানা, অর্থাৎ শুঁড়িখানা ছিলো মূলত বিয়ার তৈরীর কারখানা।
প্রাচীন মিশরে বিয়ারের গুরুত্ব এতোটাই বেশি ছিলো যে, যে কোনো ধর্মীয় উৎসব বা উপলক্ষ আসলেই সবাই বিয়ার পান করতেন এবং নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবাই এই অ্যালকোহলিক পানীয় গ্রহণ করতেন। শুধু তা-ই নয়, বিয়ারকে সে সময় মিশরে পুষ্টির উৎস হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। অনেক চিকিৎসকও রোগীকে বিয়ার পানের জন্য উৎসাহিত করতেন। কারণ প্রাচীন মিশরের ১০০টিরও বেশি সংখ্যক ওষুধের মধ্যে তখন বিয়ার ছিলো অন্যতম।
শ্রমিকদের কাজের ক্ষতিপূরণ হিসেবেও অনেকে উপহারস্বরূপ বিয়ার দিয়ে থাকতেন। গিজা মালভূমির শ্রমিকদেরকে দিনে তিনবার রেশন হিসেবে বিয়ার সরবরাহ করা হতো। সাধারণত বিয়ারে শতকরা তিন থেকে চার ভাগ অ্যালকোহলিক উপাদান থাকলেও কোনো ধর্মীয় উৎসব বা প্রধান অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষভাবে তৈরী বিয়ার ছিলো উচ্চ অ্যালকোহলিক উপাদানযুক্ত এবং একেই সবচেয়ে উন্নত মানের বিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
প্রাচীন মিশরে বিয়ার কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, তা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে উপলব্ধি করা সম্ভব। কেননা বিয়ারের সাথে দেবতা এবং দেবীর সম্পৃক্ততার কথাও মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন। বিয়ার শুধু মানুষের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিলো না, তার বাইরেও মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী বিয়ার দেবতাদেরও খুবই পছন্দনীয় ও পবিত্র পানীয় হিসেবে বিবেচিত হতো।
প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, বিয়ারের দেবীও ছিলেন, যার নাম টেনেনেট। দেবী টেনেনেটের নাম অনুসারে বিয়ারের একটি আলাদা নামও মিশরীয়রা দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে ‘টেনেমু’। এছাড়াও বিয়ারকে ‘হেকেট’ নামেও ডাকা হতো। এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের ক্ষেত্রেও বিয়ারের ভিন্ন ভিন্ন নাম প্রচলিত ছিলো। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন, দেবতা ওসিরিস মানবজাতিকে শুধু সংস্কৃতি ও কৃষিকাজের শিক্ষাই দেন নি, পাশাপাশি বিয়ার শিল্পের অসাধারণ দক্ষতাও তাদেরকে তিনি আশীর্বাদস্বরূপ দিয়েছেন।
মধ্যবর্তী রাজবংশে পালিত মিশরীয়দের মধ্যে বহুল জনপ্রিয় ‘তেখ’ উৎসবে বিয়ার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এটি ছিলো দেবী হাথোরকে উৎসর্গ করার উৎসব এবং এই উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা অতিরিক্ত বিয়ার পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। যেহেতু বিয়ারকে তখন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হিসেবে গণ্য করা হতো, তাই এর কোনো ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
‘তেখ’ উৎসব ছাড়াও আরো বিভিন্ন জনপ্রিয় উৎসব, যেমন ‘ওপেট’ উৎসব, ‘ওয়াদির উপত্যকা’-র উৎসব ইত্যাদিতেও প্রচুর পরিমাণে বিয়ার পানের প্রচলন ছিলো। বিয়ার পানে প্রাচীন মিশরীয়রা একে অপরকে বিপুলভাবে উৎসাহিতও করতেন।
বিয়ার তৈরীর সঙ্গে জড়িতদেরকে বলা হতো ‘শুঁড়ি’। নারীরা ছিলেন মিশরের প্রথম ‘শুঁড়ি’ এবং বিয়ার তৈরীর ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় নারীদের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি। স্বয়ং দেবী টেনেনেট এই শুঁড়িদের উপর নজর রাখতেন বলে বিশ্বাস করতেন প্রাচীন মিশরীয়রা। বিয়ারের মান যেনো কোনোক্রমেই নষ্ট না হয়, সে জন্য সবসময় তটস্থ থাকতেন দেবী টেনেনেট।
মিশরীয়রা শুঁড়ি হিসেবে এতোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন যে, মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো বিয়ারের মূল আবিষ্কর্তা আসলে সুমেরীয়রা। কারণ মিশরীয় বিয়ারাই ছিলো সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও পানে আরামদায়ক। সুমেরীয়দের পুরু বিয়ারকে পাতলা এবং অপেক্ষাকৃত হালকা করে তৈরীকৃত মিশরীয়দের এই বিয়ারই তাদেরকে শুঁড়ি হিসেবে এক নতুন পরিচিতি দিয়েছিলো।
এমনকি গ্রীকরাও বিয়ার প্রস্তুতিতে মিশরীয়দের দক্ষতার প্রশংসা করেছেন, যেখানে তারা মেসোপটেমীয় ও সুমেরীয়দেরকে এড়িয়ে গেছেন। গ্রীকরা বিয়ার তেমন পছন্দ করতেন না। তারপরও তারা মেসোপটেমীয় বিয়ারের সমালোচনা করেছেন এবং মিশরীয় বিয়ারকে উৎসাহিত করেছেন।
প্রাচীন মিশরে তৈরী বিয়ারটি ছিলো গ্লাস বা কোনো পাত্রে ঢেলে চুমুক দিয়ে খাবার যোগ্য তরল পানীয়, যার সাথে বর্তমান বিয়ারের সবচেয়ে বেশি মিল বিদ্যমান। তাই গ্রহণযোগ্য বিয়ারের উৎপত্তিস্থল মিশরকেই বলা হয়ে থাকে।