১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ড জুড়ে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যের জন্য বহুলাংশে আলুর উৎপাদনের উপর নির্ভর করা দেশটিতে সে বছর  কৃষিখাতে মারাত্মক এক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এক ধরণের বিশেষ ছত্রাকের সংক্রমণে পুরো দেশজুড়ে আলুর উৎপাদন নাটকীয়ভাবে কমে যায়। ১৮৪৫ সালে অর্ধেকের বেশি আলু সংক্রমণে নষ্ট হয়ে গেলে পরবর্তী সাত বছর এর প্রভাবে তিন চতুর্থাংশ ফসল নষ্ট হয়। ফলে খাদ্যের অভাবে দেশটিতে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ১৮৫২ সাল ব্যাপী চলা এই দুর্ভিক্ষ আয়ারল্যান্ডের জনতাত্ত্বিক খোলনলচেই পালটে দেয়। খাদ্যের অভাবে ১ মিলিয়ন আইরিশদের মৃত্যু ঘটে এবং আরো ২ মিলিয়ন পালিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় শরণার্থী হয়। ইতিহাস কুখ্যাত এই দুর্ভিক্ষের পেছনে যতোটা না দায় ছিল ছত্রাক সংক্রমণ ঠিক ততোটাই দায় ছিল ব্রিটিশ কলোনিয়াল সরকারের।

আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষের সময়

আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষের সময় আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যার ব্যাপক হ্রাস | ছবির ক্রেডিট: উইলিয়াম স্মিথ পারিবারিক ইতিহাস

১৮০১ সালে  Act for the union of great Britain and Ireland এর আওতায় আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে শাসিত হতে থাকে। ১৯২২ সালে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরিচিত হয় United Kingdom of Great Britain and Ireland  নামে। ব্রিটিশরা আয়ারল্যান্ড রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে  যথাক্রমে লর্ড লেফটেন্যান্ট ও চিফ সেক্রেটারি অফ আয়ারল্যান্ড নামে দুইটি পদ সৃষ্টি করে। আয়ারল্যান্ডের জনগণ অবশ্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারতো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আয়ারল্যান্ডের মোট প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ১০৫ জন। তবে এদের মধ্যে বেশিরভাগ নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন ইংলিশ বংশোদ্ভূত  ভূস্বামী ও তাদের পুত্ররা। তথাকথিত পেনাল ল’ নামের এক আইনের বদৌলতে অধিকাংশ ক্যাথলিক আইরিশদের ভূমি মালিকানা  লিজ নেয়ার অধিকার, ভোট দেয়ার অধিকার রহিত করা হয়। যদিও এই আইন ১৮২৯ সালে রদ করা হয় তারপর এই আইনের প্রভাব দুর্ভিক্ষ শুরুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিভাত থাকে। বেশিরভাগ ভূমির মালিকানা ছিল হয় ইংরেজ অথবা এংলো-আইরিশ ভূস্বামীদের হাতে। আবার এই ভূস্বামীরা গরিব ক্যাথলিক আইরিশদের কাছ থেকে  জোরপূর্বক ভূমির খাজনা আদায় করতো।

আইরিশ দুর্ভিক্ষ মায়ের সাথে সন্তানদের সাথে

দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মায়ের ছবি তার সন্তানদের সাথে| ছবির ক্রেডিট: উইকিপিডিয়া

গ্রেট ব্রিটেনে  প্রথম দিকে আলু খুব একটা জনপ্রিয় খাদ্য ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ রাজকীয় সদস্য ও ভূস্বামীদের পৃষ্ঠপোষকতায় আলুর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ১৭ শতকের শেষ দিকেও আলু প্রধান খাদ্য হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৭৬০ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের অর্থনীতি বড় হতে থাকে। নেপোলিয়নিক যুদ্ধ (১৮০৫-১৫) এর পর গ্রেট ব্রিট্রনে খাদ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। এসময় কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য অল্প পরিমাণ জমি অবশিষ্ট থাকে। আলুর দ্রুত উৎপাদন শক্তির কারণে এই কৃষকরা আলু চাষে ঝুঁকে পড়ে। ফলে ধীরে ধীরে আলু হয়ে উঠে আয়ারল্যান্ডের প্রধান খাদ্যে যা শীতকালে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ করে এই জনপ্রিয়তার পেছনে কিছু বিপত্তিও উঠে আসে। এই আলুর প্রজাতিতে ভিন্নতা ছিল না। ফলে আইরিশ লাম্পার নামের এই আলুর জাত ছাড়া অন্য কোন আলু তেমনভাবে উৎপাদন হয়নি। ফলে ছত্রাকের সংক্রমণ শুরু হলে এর বিকল্প প্রজাতি না থাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।  ১৮৪৫ সালে যখন আলু উৎপাদন হ্রাসের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল তখন আইরিশ নেতারা রাণী ভিক্টোরিয়া ও পার্লামেন্টের কাছে Corn law নামের আইন বাতিলের জন্য পিটিশন দাখিল করে। এই আইন গম সহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই আইন রদ করে। কিন্তু একইসাথে আলুতে ছত্রাকের সংক্রমণ আশংকাজনক হারে বাড়তে থাকে। বর্গাচাষীরা নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্যই আলু উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে খাদ্যের অভাব তীব্রতর হওয়া শুরু করে। এরমধ্যেই মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দেয় অন্যান্য খাদ্যশস্যের গ্রেট ব্রিটেনে রফতানি। ১৮৪৭ সালে যখন আয়ারল্যান্ডের গ্রামে গ্রামে দুর্ভিক্ষ তার ভয়াল রূপ প্রদর্শন করছে ঠিক একই সময় মটরশুঁটি, বরবটি, মাছের মত প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ব্যাপক হারে গ্রেট ব্রিটেনে পাচার হতে থাকে।  ১৮৫২ সাল পর্যন্ত এই দুর্ভিক্ষ চলতে থাকে। অভুক্ত মানুষরা ক্ষুধা ও ক্ষুধাজনিত অবসাদে মারা পড়তে থাকে। ইতিহাসের অন্যতম গণদেশান্তরী প্রত্যক্ষ করে এসময়  দ্বীপ দেশ আয়ারল্যান্ড। দেশটি থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন লোক উত্তর আমেরিকা ও গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে শরণার্থী হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র আলুর অভাবে আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ১৮৫২ সালের দিকে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে এই দুর্ভিক্ষকে মোকাবেলা করা হয়।

আইরিশ ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ শুধু এক মানবিক বিপর্যয়ই ছিল না। এই দুর্ভিক্ষই আইরিশ জাতীয়তাবাদকে উজ্জীবিত করে তুলে। রুগ্ন আয়ারল্যান্ডে থেকে যাওয়া মানুষগুলো উচকিত কণ্ঠে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের দাবি তুলে। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে ব্রিটিশ সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার জন্ম হয়। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এই দুর্ভিক্ষের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আইরিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। দুর্ভিক্ষের সময় আইরিশরা যেসব শহরে দেশান্তরী হয়েছিল সেই ঘটনা স্মরণ করতে কানাডার মন্ট্রিল, টরেন্টো, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইউর্ক সিটি, বোস্টন শহরে আইরিশ হাংগার মেমোরিয়াল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া গ্লাসগো সেল্টিক FC নামের স্কটল্যান্ড ভিত্তিক ফুটবল ক্লাব আইরিশ পটেটো ফেমিনে নিহতদের স্মরণে কালো ব্যাচ পরে মাঠে নেমে শ্রদ্ধা জানায়। উল্লেখ্য এই ক্লাব গঠনই হয়েছিল আইরিশ অভিবাসীদের মাধ্যমে যারা সেই ভয়াল দুর্ভিক্ষ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।

আইরিশ দুর্ভিক্ষ শেষ

দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার পর একটি আইরিশ পরিবার | ছবির ক্রেডিট: আইরিশ টাইমস