সময়টা ষাটের দশক। শিকারপ্রিয় মানুষ আফগান অভিজাত খান গোলাম সারওয়ার নাসের। বেরিয়েছিলেন শিকারে, কিন্তু আবিষ্কার করে বসলেন কিছু পুরাতত্ত্ব, যেগুলো তার দেখা ও শোনার জগৎ থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। অদ্ভূত সেই পুরাতত্ত্বগুলো দেখে তিনি এতোটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে পুরো এলাকাটা খননের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। খননকাজ শুরু হলো। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত খননের ফলে যা পাওয়া গেলো তা ছিল সকলের জন্য এক বিস্ময়কর দৃশ্য। সবার চক্ষুস্থির! যেনো ভারতীয় কৃষ্টিকলা ও সংস্কৃতি এবং গ্রীক স্থাপত্যকলার একটি অনন্য ফিউশান, এক অবিস্মরণীয় মেলবন্ধনের অভূতপূর্ব এক শহর, আল-খানুম। এটি ‘চাঁদ বিবি’ নামক এক রাজত্ব।

১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় রাজ্যের বিস্তার

গ্রীক বংশোদ্ভূত কোনো সম্রাটের হাতেই যে এর গোড়াপত্তন হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হলো প্রতিটি জিনিসে ভারতীয় সংস্কৃতি ভীষণভাবে মিশে আছে। তবে কে তৈরী করেছে অনন্য এই শহরটিকে? আর কেনোই বা এমন ভিন্ন স্বরূপে গড়া এটি?

বুঝা গেল যে, এটি ছিল একটি গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য। গ্রীক আদলে তৈরী জিমনেশিয়াম, থিয়েটার, নানা ধরনের দেব-দেবীর মন্দির, কি নেই এখানে! কিন্তু কোথায় এই ব্যাক্ট্রিয়া? কোনো ম্যাপে তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না! আসলে বর্তমান আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানের কিছু অংশ নিয়েই গড়ে উঠেছিলো এই ব্যাক্ট্রিয়া। আমুদরিয়ার অববাহিকা ও আব্বাস নদীবাহিত পলির মাধ্যমে এই অঞ্চলটি ছিলো অত্যন্ত উর্বর। আর ব্যবসার প্রসারের কারণেই এই অঞ্চলটি ধনী ও ক্ষমতাশীল রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। ব্যাক্ট্রিয়াতে বসবাসকারী এই যবনরা ছিল ভীষণ বিত্তশালী।

তবে অত্যন্ত কষ্টের সাথে মেনে নিতে হয় যে, আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের সময় তালেবানরা এসব নিদর্শন অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছিল। এই নিদর্শনগুলোই ছিল ভারতবর্ষের সাথে গ্রীকদের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রের দলিল। তাদের মুদ্রাগুলো ছিল ভারতবর্ষের চৌকোণাকৃতি মুদ্রাগুলোর মতো এবং তাতে ছিলো লক্ষ্মী, বিষ্ণু ও শিবের প্রতিকৃতি। ভারতের সাথে তাদের ছিল গভীর বন্ধুত্ব।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে সময়টা তখন মৌর্যদের, বিশেষ করে সম্রাট অশোকের, যিনি নিজেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। চারদিকে মিশনারীজ পাঠাতেন বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। ব্যাক্ট্রিয়াতেও তিনি একজন গ্রীক দূত পাঠিয়েছিলেন এবং বহু ব্যাক্ট্রিয়াবাসীকে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।  শ্রীলঙ্কার ইতিহাস নিয়ে লিখিত একটি কবিতা থেকে জানা যায়, ‘ধর্মরক্ষিতা’ নামক একজন যবন সাধুকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন সম্রাট অশোক। কান্দাহারে গ্রীক ভাষায় লেখা অশোকের যে প্রস্তরখন্ড পাওয়া গিয়েছে, সেখান থেকেও বোঝা যায় যে, গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্যই তিনি গ্রীক ভাষাটি ব্যবহার করেছিলেন।

গ্রীক স্থাপত্যশৈলী ও জীবনধারা কি করে এই ভারতবর্ষে প্রবেশ করলো, সেই ইতিহাসের কথা বলতে গেলে সবার আগে সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণা অনুযায়ী আলেকজান্ডারের নামই চলে আসে। গ্রীকদের কাছে পৌরাণিক কাহিনী ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডারের ঐসব নানা রকম পৌরাণিক কাহিনী পড়েই বেড়ে উঠা। গ্রীক পুরাণের তেমনই একটি গল্প থেকে জানা যায়, গ্রীক শূরা দেবতা ডিওনিসাসের কাজই ছিলো ঘুরে ঘুরে মানুষকে শূরার প্রস্তুত প্রণালী শেখানো, আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ভারতবর্ষে এসে তিনি বহুকাল এখানে থেকে গিয়েছিলেন। এগুলো পৌরাণিক কাহিনী হলেও গ্রীকরা এমনকি আলেকজান্ডারও কিন্তু এসব মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। বিজয়ী আলেকজান্ডার সিন্ধু নদের তীরে বসবাসরত ‘নিশরা’ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে জেনেছিলেন যে, তাদের পূর্বপুরুষেরা ডিওনিসাসের সফরসঙ্গী হয়েই এখানে এসেছিলেন। সুতরাং যেহেতু তারা আলেকজান্ডারের মিত্র, তাদের যেনো কোনোরূপ ক্ষতি না করা হয়। তাছাড়া আরেকটি পুরাকাহিনী খুবই জনপ্রিয় ছিল যেটি সম্পর্কে গ্রীক ভূগোলবিদ স্ট্র্যাবো খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে তার বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘জিওগ্রাফী’-তে লিখে গেছেন। তার লেখা অনুযায়ী, ভারতীয়রা কখনোই বাইরের কোনো শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং একমাত্র জিউসের পুত্র হারকিউলিস বাদে অন্য কোন বহিরাগত শক্তিই ভারতবর্ষকে জয় করতে পারেনি।

হেলিওদোরাস স্তম্ভ

জেদী হারকিউলিসের ভক্ত আলেকজান্ডার হয়তোবা এই পৌরাণিক গল্প থেকে ভারতবর্ষকে জয় করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। এ ছাড়াও সেই কবে তার পূর্বপুরুষকে পরাজিত করেছিলেন পারস্য সম্রাট! ভাবখানা এমন, যেনো বহু দিনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। সেই জেদের জের ধরেই যেনো আগ্রাসী আক্রমণ চালালেন পারস্য সম্রাট দারিয়ুসের ওপর, পরাজিতও করলেন তাকে এবং এরপর স্ত্রী রোকসানাকে নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন ব্যাবিলনের দিকে। ভারত জয় করা আর হলো না। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, খ্রিস্টের জন্মের ৩২৩ বছর আগে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্য তার জেনারেলদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। ভারত, মধ্য এশিয়া ও পারস্য সেলুকাস নিকাটরের দখলে চলে আসে। প্রায় ২০ বছর টলেমির সাথে যুদ্ধ শেষ করে ৩০৫-৩০২ অব্দে সেলুকাস ভারত আক্রমণ করেন, উদ্দেশ্য চন্দ্রগুপ্তের দখলে চলে যাওয়া আলেকজান্ডারের দখলকৃত এলাকা ও সম্পদ উদ্ধার। তাদের যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ নেই, তবে যেহেতু হিন্দুকুশ, পাঞ্জাব ও আফগানিস্তানের অংশবিশেষ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে ছেড়ে দিতে হয়েছে, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেলুকাস যুদ্ধে হেরে যান। শুধু তাই নয় সমঝোতায় বাধ্য হয়েছেন বলেই তার কন্যা হেলেনাকে চন্দ্রগুপ্তের কাছে বিয়ে দেন এবং মেগাস্থিনিসকে মৌর্য দরবারে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন। ভারত নিয়ে রচিত গ্রন্থ ইন্ডিকার জন্য মেগাস্থিনিস খ্যাত হন এবং তখনকার ভারতের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা তার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। এভাবে বেশ কিছু দিন চলার পর খ্রিস্টের জন্মের ২৫০ বছর আগে ব্যাক্ট্রিয়ার স্থানীয় গভর্নর ডিওডোটাস সেলুসিড রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতা দাবি করেন। এ রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সেলুকাস নিকাটর। ডিওডোটাস গ্রেকো-ব্যাকট্রিয়ান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেন। আগেই বলেছি একালের মানচিত্রে ব্যাক্ট্রিয়ার কোনো হদিস মিলবে না, তবে জায়গাটি মোটামুটিভাবে উত্তর আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান মিলিয়ে হিন্দুকুশ ও পামির ঘেরাও অঞ্চল।

ভারতের ডায়োনিসিস বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব

এতো ছিল মেসিডোনীয় রাজাদের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্কের খানিকটা ঝলক। কিন্তু ইতিহাসে একটি ফোঁকর রয়ে গেছে। অধিকাংশেরই ধারণা, আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-৩২৫ অব্দ) এর মাধ্যমেই গ্রীকদের সাথে প্রথম ভারতবর্ষের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু ভারতীয় ঐতিহাসিক ও মুদ্রাতত্ত্ববিদ এ. কে. নারায়ণ এর ‘ইন্দো-গ্রীক’ বই অনুসরণ করলে গ্রীকদের ভারতবর্ষ আগমনের বেশ অন্যরকম এক তত্ত্বই খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন মুদ্রা বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করে দেখান যে, পারস্যে বহু আগে থেকেই কতিপয় গ্রীকদের অবস্থান ছিল এবং পারস্যের শাসকেরা সেই গ্রীকদের রাজ্যের পূর্বদিকের প্রান্তে নির্বাসিত করেছিল। সুতরাং এই সূত্র থেকে বলা যায় যে কিছু সংখ্যক গ্রীক জনগোষ্ঠী পারস্যে আলেকজান্ডারের আগমনের অনেক আগেই ভারতবর্ষে এসে বসবাস শুরু করে। তিনি এদেরকে ‘ব্যাক্ট্রিয়ান গ্রীক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আজকের আফগানিস্তান, হিন্দুকুশ ও তাজিকিস্তানের কিছু অংশ মিলেই তখনকার ব্যাক্ট্রিয়া গঠিত হয়েছিল। আলেকজান্ডারের সাথে যেসব গ্রীকরা এসেছিলেন, তাদেরকে ‘মেসিডোনীয় গ্রীক’ বলা হয় এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা ও আমুদরিয়া নদীর মধ্যবর্তী স্থানে বসতি স্থাপনকারী গ্রীকরাই হলো ‘ব্যাক্ট্রিয়ান গ্রীক’। এই দুই দলের অধিবাসীরা প্রত্যেকে গ্রীক জনগোষ্ঠী হলেও তাদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল।

এবার আসা যাক আলেকজান্ডারের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের পুনরুদ্ধার প্রসঙ্গে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ১৭০ অব্দে তক্ষশীলা থেকে ভীষণ শক্তিশালী দুটি সৈন্যদল ঘোড়ার ক্ষুরে ধূলি উড়িয়ে দুই দিক থেকে এসে ভারতকে জয় করে। কার ছিল এই সেনাবাহিনী? কে পাঠিয়েছিলেন তাদের? মেঘে মেঘে তখন বহু বেলা পার হয়ে গিয়েছে। মৌর্য সাম্রাজ্যের শান-শওকত ও শক্তি প্রায় নিঃশেষ হবার পথে। নিজস্ব জেনারেল পুষ্যমিত্র শুঙ্গের হাতেই শেষ মৌর্য শাসক বৃহদ্রথের মৃত্যু পাল্টে দিয়েছে সব। মৌর্য বংশের শেষ প্রদীপকে পরপারে পাঠিয়ে পুষ্যমিত্র শুঙ্গ আজ নিজেই রাষ্ট্রের ভাগ্য-বিধাতা। রাজ্যের চারিদিকে তখন নৈরাজ্য, এখনইতো শ্রেষ্ঠ সময় দুর্বলের রাজ্য হরণ করার। আর তাই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিলেন ব্যাক্ট্রীয় গ্রীক শাসক কিংবা ভারতীয়দের ভাষায় যবনরাজ ডিমেট্রিয়াস। হ্যাঁ, ডিমেট্রিয়াসই পাঠিয়েছিলেন শক্তিশালী সেই দুই সৈন্যদলকে। তিনি ভুল করেননি, গ্রীকদের বহু বছরের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়েছিলেন তিনি। দুই দলের মধ্যে এক দল সৈন্য ছিল অত্যন্ত যোগ্য জেনারেল মেনিন্দারের তত্ত্বাবধানে এবং অপর দলের দায়িত্বে ছিলেন রাজা অ্যাপোল্লোডোটাস। সুযোগ্য মেনিন্দারকে তিনি পাঠিয়েছিলেন পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে। প্রথমে অযোধ্যা ও পরে মথুরায় ধ্বংসলীলা চালিয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন পাটালিপুত্রে।

অ্যাপোল্লোডোটাসই বা কম কি! সিন্ধু নদের পথ ধরে দখল করে নিলেন উজ্জয়িনীকে। তক্ষশীলা, পাটালিপুত্র এবং উজ্জয়িনী- তিন দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী তিনটি রাজ্য তখন ব্যাক্ট্রীয়-গ্রীকদের দখলে। ভারতবাসী বাধ্য হলো ব্যাক্ট্রীয়-গ্রীক শাসনের কাছে নতজানু হতে। ঠিক কতোদিন ভারতবাসীকে ডিমেট্রিয়াসের প্রজা হিসেবে থাকতে হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব না মিললেও রাজা হিসেবে ডিমেট্রিয়াস প্রতিষ্ঠিত হবার পর নিজ নামে মুদ্রা চালু করেছিলেন। হাতির পিঠে পাগড়ি পরিহিত তার ছবি খোদিত মুদ্রাই ২২ হাজার বছর আগের শক্তিশালী যবন রাজার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

কলিঙ্গের রাজা ক্যারাভেলা ভুবনেশ্বরের কাছে উদয়গিরির হাতিগুম্ফা শিলালিপিতে বেশ দম্ভের সাথেই লিখেছিলেন যে, তার শক্তি ও শৌর্যের ভীড়ে একজন যবনরাজকে তার ভগ্ন মনোবলসম্পন্ন সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল মথুরাতে। তবে কি এখানেও যবনরাজ ডিমেট্রিয়াসের কথাই বলা হয়েছে? বিষয়টি অস্পষ্টই রয়ে গেছে, যদিও ইতিহাসবিদগণ কিছু যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, মথুরাতে ফিরে যাওয়া সেই রাজা ডিমেট্রিয়াস ছাড়া আর কেউ নন।

ডিমেট্রিয়াসের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই ব্যাক্ট্রীয়-গ্রীক সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে এবং অবশেষে পারস্যের শাক্যদের আক্রমণে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ সুযোগে চীন থেকে ‘ইউ-চি’ নামক এক উপজাতি প্রবেশ করে এই উপমহাদেশে, পরবর্তীতে যাদের নাম হয় ‘কুষাণ’।

ব্যাক্ট্রীয়-গ্রীক সাম্রাজ্যের পতনের পর যেসব গ্রীক শাসকেরা ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন, তাদের সাথে উত্তর দিক থেকে আসা আক্রমণকারী সাইথিয়ানরা ব্যাক্ট্রীয়-গ্রীকদের পার্থক্য স্পষ্ট করতে ‘ইন্দো-গ্রীক’ নামে ভারতবাসীর কাছে তাদের পরিচিত করেছিল।
কিন্তু অদ্ভুত একটি বিষয় হচ্ছে এই যবন রাজাদের গল্প ইতিহাসের পাতা থেকে কিভাবে যেনো হারিয়ে গিয়েছিল, যার খবর আমরা বহুদিন পাইনি। পরবর্তীতে ঋষি পতঞ্জলি নামক এক ব্যাকরণবিদ তার ‘মহাভাষ্য’ নামক সংস্কৃত ব্যাকরণ বইতে ‘কাল’ বুঝাতে গিয়ে কিছু বাক্যে ব্যবহার করেছিলেন, যবনরাজেকে উদহারন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ডঃ আর. জি. ভাণ্ডারকার, ডঃ আর. সি. মজুমদার প্রমুখ ইতিহাসবিদগণ ‘মহাভাষ্য’-তে উল্লিখিত সেই উদাহরণ থেকেই ‘যবনদের ভারতবর্ষ দখল’ –এই বিষয়টিকে নিশ্চিত করেছেন।

ডিমেট্রিয়াসের দক্ষ জেনারেল মেনিন্দার ছিল ইন্দো-গ্রীক রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের শিয়ালকোটে রাজ্য পরিচালনা করতেন এবং ধীরে ধীরে তার রাজ্যসীমা পাটনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ সময় তিনি বিখ্যাত বৌদ্ধগুরু নাগাসেনার সংস্পর্শে আসেন। তাদের মধ্যে চলতে থাকে যুক্তি-তর্ক এবং আলোচনা। একসময় যুক্তি-তর্কের খেলায় বৌদ্ধ আদর্শে পরিপূর্ণ নাগাসেনার কাছে আত্মসমর্পণ করেন রাজা মেনিন্দার, গ্রহণ করে নেন বৌদ্ধ ধর্মের নানা দিক এবং হয়ে ওঠেন বুদ্ধের অনুসারী।

মেনিন্দারের সাথে শিয়ালকোটে বসে নাগাসেনার যে ধর্মদর্শন ও আলোচনা হয়েছিলো, সেগুলোই পরবর্তীতে ‘মিলিন্দা পানহা’ বা ‘মিলিন্দার প্রশ্ন’-রূপে সংকলিত হয়। ‘মিলিন্দা পানহা’ থেকেই জানা যায়, নাগাসেনা ছিলেন বিখ্যাত যবন সাধু ধর্মরক্ষিতার ছাত্র, যার যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট অশোক তাকে নিজস্ব বৌদ্ধ মিশনারী হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিলেন। ধর্মরক্ষিতার কাছ থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা পেয়েছিলেন নাগাসেনা।

মেনিন্দার নিঃসন্দেহে একজন যোগ্য প্রজাপ্রেমী শাসক ছিলেন। তাই শুধু বৌদ্ধ অনুসারীরাই নয়, বরং খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর গ্রীক ইতিহাসবিদ প্লুতার্কও তার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ‘মিলিন্দা পানহা’ থেকে মেনিন্দারের প্রতি প্লুতার্কের প্রশংসাবাণী সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে বলা আছে, “একজন মেনিন্দার, যিনি সহানুভূতির সাথে ব্যাক্ট্রীয়দেরকে পরিচালনা করেছিলেন, তিনি যখন মারা গেলেন, প্রতিটি শহর সাধারণ সম্মতিতে শোক প্রকাশ করেছিল এবং বহু কাঠিন্য পেরিয়ে তারা সবাই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, প্রত্যেকের কাছে তার ছাইয়ের সমান অংশ বিতরণ করা হবে এবং প্রতিটি অংশে তার জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হবে”।

ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যকে উৎকর্ষের চূড়ান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন মেনিন্দার। হেলেনীয় যুগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ ছিল গ্রীকো-বুদ্ধিজম প্রতিষ্ঠা, যেটি গ্রীক ও বৌদ্ধধর্মের অভূতপূর্ব মেলবন্ধন তৈরীর মাধ্যমে একটি অনন্য সাধারণ শিল্পের জন্ম দিয়েছিল। মেনান্দার খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫ থেকে ১৩০ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেছিলেন। মেনান্দারের মৃত্যুর পর ইন্দো-গ্রিক সাম্রাজ্যের একক সত্তাটি ভেঙে পড়েছিল। তার রাজ্যটি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। বিভক্ত রাজ্যগুলো পরস্পরের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হয়ে গেলে কয়েক প্রজন্ম পর তাদের অতীত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। মেনান্দারের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আগাথোক্লিয়া (বিতর্ক আছে এ নিয়ে) তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে স্ট্রোটোর প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করেছিলেন কিছুকাল। তবে তিনি তার স্বামীর রাজ্যের একাংশ শাসন করতে পেরেছিলেন। বাকি অংশটা ভাগ হয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন শাসকদের কাছে। স্বামীর মতো তিনি যতোটা যোগ্য শাসক ছিলেন তার ছেলে ততোটা যোগ্য ছিল না। মেনান্দারের পুত্র স্ট্রাটো যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তখন সে অযোগ্য প্রমাণিত হয় এবং পদচ্যুত হয়।

পরবর্তীকালের অন্যান্য ইন্দো-গ্রীক রাজাদের সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানতে পারি, তবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তাদের উপস্থিতি দেখা গিয়েছে।

বর্তমান ভারতের মধ্য প্রদেশে অদ্ভূতভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল একটি একশিলা স্তম্ভ, যার নাম ‘হেলিওডোরাস স্তম্ভ’। এই হেলিওডোরাস স্তম্ভ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার যেটি প্রমাণ করে যে, বাইশ শতাব্দী আগেও বৈদিক নীতির পশ্চিমী অনুগামী ছিলো। এতে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, তক্ষশীলার বাসিন্দা দিওনের ছেলে তথা ইন্দো-গ্রীক শাসক অ্যান্টিয়ালসিডাস নিকেফোরোস এর দূত হেলিওডোরাস শুঙ্গ সম্রাট ভগভদ্রের শাসনকালে বিদিশা নগরীতে উপস্থিত হয়ে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এই স্তম্ভ স্থাপন করেন। এই স্তম্ভে হেলিওডোরাসের লেখা ‘বাসুদেব বন্দনা’ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। আর তাদের মুদ্রাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, দুই শতাব্দীব্যাপী শাসনামলে ইন্দো-গ্রীক রাজারা গ্রীক ভাষা ও প্রতীকের সঙ্গে ভারতীয় ভাষা ও প্রতীকগুলোকে সংযুক্ত করেন। আর গ্রীক ও ভারতীয় বিভিন্ন কলাকৌশলের মধ্যে সমন্বয় বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে স্পষ্টতই দৃশ্যমান।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, ইন্দো-গ্রীক রাজ্যগুলো অন্যান্য হেলেনীয় রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুদূর ভারতবর্ষে থেকেও গ্রীক সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রেখেছিল। পাশাপাশি তারা ভারতীয় সংস্কৃতি দ্বারা এবং বিশেষত বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। মেনান্দার বৌদ্ধ ধর্মকে সমর্থন ও সুরক্ষিত করেছিলেন। সেই সময়ে অনেক গ্রীকই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। ইন্দো-গ্রীক শাসকেরা বুদ্ধের শৈল্পিক চিত্রকে কতোটা প্রভাবিত করেছিল তার প্রত্নতাত্ত্বিক নজির মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান। গৌতম বুদ্ধের দৃশ্যমান অবয়বটাও গ্রীকদের এই উপমহাদেশে উপস্থিতির প্রভাবেই গড়ে ওঠে, আগে বুদ্ধের মূর্তিমান স্বরূপ নিয়ে কারও ধারণা ছিলো না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বুদ্ধের মূর্তিতে পরিহিত পোশাক গ্রীক আদলে তৈরী। গ্রীক উপস্থিতির আগে বুদ্ধকে মানব রূপ দিয়ে চিত্রিত করা হয়নি, বরং প্রতীকীভাবে দেখা হতো। ইন্দো- গ্রীকদের প্রভাবই বুদ্ধকে মানব মূর্তিতে উপস্থাপন করেছিল। তারা অ্যাপোল্লোডোটাস ও হারকিউলিসের মতো গ্রীক দেবদেবীদের মূর্তিগুলোকে এর অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করেছিল। সিনকিয়াং এর মাধ্যমে এই গ্রীকো-বৌদ্ধ শিল্পটি চীন, কোরিয়া ও জাপান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।

দুই সংস্কৃতির মিলনে ভারতবর্ষ যে উৎকর্ষ অর্জন করেছে তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতি, যারা ভিন্ন সত্ত্বার অধিকারী হয়েও নিজেদেরকে আমাদের থেকে ভিন্ন মনে করেন নি, যারা আপন করে আগলে নিয়েছেন আমাদের সংস্কৃতিকে। পার্সিয়ান বা মিশরীয় গ্রীকরা তো নিজেদের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়েছিল, তাদের কাছে স্থান পায় নি বাইরের কোনো সংস্কৃতিই। অথচ এই গ্রীক শাসকেরা ভারতীয় দেব-দেবী এবং কৃষ্টি-কলাকে তাদের মুদ্রার মাধ্যমে তুলে ধরেছিল। আমরা যে গ্লোবাল ভিলেজের কথা বলি, তার শুরুটা কিন্তু তখনই হয়েছিল। সেই কোন সুদূর থেকে একদল জনগোষ্ঠী এসে ছড়িয়ে দিয়েছে ভাব-সম্প্রীতি, তৈরী করেছে একাত্মতা এবং ভিন্ন এক সংস্কৃতিকে অধিষ্ঠিত করেছে মর্যাদার আসনে। একেই বলা হয় মেলবন্ধন, একেই বলা হয় ফিউশান। আমাদের অবশ্যই তাদের কথা মনে রাখতে হবে।