মীরার জীবনে যত জটিলতা ঘনিয়েছে, তার দুঃখ দেখে অনুতপ্ত হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলে রথীন্দ্রকে লিখেন, ‘ ওর জীবনের প্রথম দন্ড তো আমিই ওকে দিয়েছি। বিয়ের রাতে মীরা যখন নাইবার ঘরে ঢুকেছিলো তখনি একটা গোখরো সাপ ফনা ধরে উঠেছিলো— আজ আমার মনে হয়, সে সাপ যদি তখনি ওকে কাটতো তাহলে ও পরিত্রান পেতো।’
মীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে, পোষাকি নাম ছিলো অতসীলতা।বাবা- মা, দাদা- দিদি’দের সাথে স্নেহ ভালবাসায় দিনগুলি তার আনন্দেই কাটছিলো কিন্তু একের পর এর মৃত্যুর কারনে তা অচিরেই হারিয়ে গেলো। এই কারনে তাকে কখনও থাকতে হয়েছে জ্ঞানদানন্দিনী, মাধুরীলতা এবং রাজলক্ষী দেবীর তত্বাবধানে।
পরে তার স্থায়ী ঠিকানা হয় শান্তিনিকেতনের ‘মালঞ্চ’।
দিদি’দের মতো তার শিক্ষা শুরু হয় বাড়িতে।লরেন্স সাহেব শেখাতেন ইংরেজি আর কার্তিকচন্দ্র নান শেখাতেন ছবি আঁকা।তার সেলাই শেখার জন্য বিদেশি মেমও খোঁজা হয়েছিলো।কবি তাকে ইংরেজীতে চিঠি লিখতে উৎসাহিত করতেন। জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন কবির বন্ধু, মীরা তারও খুব প্রিয় পাত্রী ছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসুর ইচ্ছা ছিলো ভাগ্নে অরবিন্দমোহনের সাথে মীরার বিয়ে দেওয়ার। মৃনালিনী দেবী হবেন তার বেয়ান, ঠাট্টা তামাশা করে দেনা পাওনা নিয়েও কথা বলতেন, কবিও নির্মল আনন্দ উপভোগ করতেন।
মৃনালিনী দেবীর মৃত্যুর পর কবি মেয়ের জন্য ব্রাহ্মন কুলের মধ্যে পাত্র দেখা শুরু করলেন। অসমের তরুণরাম ফুকনের সাথেও মীরার বিয়ের কথা হয়েছিলো।
কবির জীবনের বড় ভুল ছিলো প্রিয়দর্শন তেজস্বী যুবক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গাপাধ্যায়কে মীরার পাত্র হিসাবে নির্বাচন করা। নগেন্দ্র সাধারন ব্রাহ্মসমাজের সাথে জড়িত ছিলেন, তিনি আমেরিকা যাবার উপায় খুঁজছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, নগেন্দ্র’র সাথে মীরার বিয়ে দিয়ে তাকে আমেরিকায় পাঠাবেন।
আমেরিকা যাওয়া হবে জেনে নগেন্দ্র আদি ব্রহ্মসমাজের নিয়ম মেনে মীরাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন।
কিন্তু বিয়ের সময়ই বিরোধের বাস্প ঘনিয়ে ওঠে। আদি ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মনের উপবীত ধারন অবশ্যকর্তব্য। সাধারন ব্রহ্মসমাজের নিয়ম উপবীত বর্জন।
নগেন্দ্রকে নতুন করে উপবীত ধারন করানো হলো, কিন্তু তিনি ‘ বাবার স্বহস্তদত্ত পৈতা’ ফেলে দিলেন। এসব কথা মাধুরীলতা তার ভাই রথীন্দ্রকে বিবাহ বাসরের বর্ণনা দিতে গিয়ে চিঠিতে লিখেছিলেন।
এরপরের বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানে লোকাচারের সময় নগেন্দ্র অত্যন্ত খারাপ ব্যাবহার করেন।
‘বরের অসভ্যতায় আমাদের পর্যন্ত লজ্জ্বাবোধ হয়েছিলো, সব কাজেরই সীমা আছে কিন্তু নগেন্দ্রের বেহায়াপনার সীমা নাই’ লিখেছেন মাধুরীলতা।
মহর্ষি ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও বাঙ্গালীর লোকাচার বর্জন করেননি, এতোদিন সেই নিয়মই চলে আসছিলো।
মীরা ছিলেন এদেশের সবচেয়ে পরিশীলিত পরিবারের সন্তান। তার পিতার শিক্ষা ছিলো — স্বামী যে তার চেয়ে সব বিষয়ে শ্রেষ্ঠ সেটা মেনে নেওয়া। এটিও মাধুরীর চিঠিতে পাওয়া যায়। মীরাও নগেন্দ্রকে জানিয়েছিলেন যে, নিজেকে তিনি ‘ পাড়াগেঁয়ে মেয়ে’ ‘কুনো’, ‘মেঠো মেয়ে’ প্রভৃতির উপমা দিয়ে লিখেছেন, ‘ আমি কোন কাজ করবার পক্ষে অযোগ্য, অক্ষম, সেজন্য আমাকে নিয়ে তোমার অনেক ভুগতে হবে। তবে আমার একমাত্র আশা আছে যে, আমি যতই অযোগ্য হই, অপটু হই, তুমি আমাকে শিখিয়ে নিবে।’
মীরার এই সরল স্বীকারাক্তিকে নগেন্দ্র কোন গুরুত্ব দেননি, হয়তো সত্যি ভেবে স্ত্রীকে অবজ্ঞাই করেছিলেন।তাদের মাঝে দুরত্ব বাড়তে থাকে। পূত্র নীতীন্দ্র ও কন্যা নন্দিতার জন্ম হয় কিন্তু নগেন্দ্রের কোন পরিবর্তন হয়নি। তিনি দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ তাকে নানাধরনের কাজের ভার দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি অসম্ভব খরচ করে, ঋনের বোঝা বাড়িয়ে, আত্মীয়- স্বজনদের সাথে কদর্য ব্যাবহার করে সবার জীবনে অশান্তি নিয়ে আসেন।
মাধুরীর সাথে মীরার সম্পর্কও তিক্ত হয়ে ওঠে।বিয়ের আগে পর্যন্ত যে মীরা দিদির স্নেহছায়ায় ছিলেন, দিদির মৃত্যুর পর তার মনে কোন রেখাপাত করলো কিনা সেটা তার লেখা ‘স্মৃতিকথা’ পড়ে বোঝার উপায় নাই, সেখানে দিদির কথা খুবই কম।
ক্রমে মীরার সাথে নগেন্দ্রের বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কবি এতে দুঃখ পেয়েছেন, তিনি মীরাকে সব শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলেছেন। মীরাকে শিখিয়েছেন— ‘ মেয়েরা দিন- রাত্রি জীবনকে যে ভাবে হালকা করে দেখে, যে রকম সংকীর্ণভাব থেকে সমস্ত বড় জিনিসকে বিকৃত করে তোলে, জগতে যে সকল বড় শক্তি কাজ করছে তার সম্পর্কে সম্পূর্ন থেকে দিন- রাত কেবল হাসিগুজব নিয়েই হো হো করে কাটায় তার থেকে তোদের রক্ষা করার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি— আশাকরি আমার সে চেষ্টা ব্যর্থ হবেনা।’
যদিও ভিন্ন প্রসঙ্গে লেখা চিঠি, তবুও কবি তার মেয়েদের মনটি যে উঁচু তারে বাঁধার চেষ্টা করেছেন সেটা বেশ বোঝা যায়।
প্রথমদিকে তিনি হয়তো নগেন্দ্রকে বোঝাতে চেয়েছেন। নারীর প্রতি পুরুষের অশ্রদ্ধা ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের ব্যাখা করতে চেয়েছেন এভাবে, ‘ মেয়েদের পরে অশ্রদ্ধা ও নিষ্ঠুরতার কারন, আমাদের মনের বুদ্ধিগত বিকাশের কার্যে তাদের সাহায্য আমরা অল্পই পেয়েছি।কেবল আমাদের খাওয়ানো পরানো, কেবলমাত্র আমাদের দেহের প্রয়োজন সাধনে তাদের সেবা পাই বলেই এক জায়গায় তাদের মূল্য আমাদের কাছে ভিতরে ভিতরে খুব কমে যায়।’
কবি নিজে একথা বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয়না, কারন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা কোনওদিনই সামান্যা নারীদের সমপর্যায়ভুক্ত ছিলেননা।
কবি তার স্ত্রী মৃনালিনীর কাছ থেকে মানষিক সহায়তা পাননি তা নয়, বরং স্ত্রীর মৃত্যুর পর বার বার তিনি অনুভব করেছিলেন, ‘ এমন কেউ নেই যাকে সব কথা বলা যায়!’
মীরা কয়েকবার শান্তিকেতনে ফিরে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথকে চিন্তামুক্ত করার জন্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নগেন্দ্রকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশিক্ষা ও গবেষণা বিভাগটি গড়ে তোলার চাকরি দিয়েছিলেন।
নগেন্দ্র যখন জোর করে মীরাকে কলকাতা নিয়ে যেতে চেয়েছেন তখন রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘ মীরার সাথে তোমার লেশমাত্র বিচ্ছেদ হয়, এ আমার কিছুতেই ইচ্ছাসম্মত নয়, এর দায়িত্ব নেয়াও আমার পক্ষে কঠিন। তবুও আমাকে পরম দুঃখে এটা স্বীকার করতে হচ্ছে। এবার মাদ্রাজে যখন দেখলাম মীরা তোমাকে ভয় করে, তোমার কাছ থেকে প্রকাশ্য অপমানের সংকোচে একান্ত সংকোচিত হয়, তখন স্পষ্ট দেখতে পেলুম,তোমাদের দুজনের প্রকৃতির মুল সুরে মিল নেই। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কোন জীবনযাত্রা বহন করতে যদি প্রস্তুত হতে হয়, তবে সে চিন্তা আমার পক্ষে করা দুর্বিষহ। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটেছে সেতো বাইরের জিনিষ নয়। বাইরে থেকে জোর করে শাষন করে, ভয় দেখিয়ে জোড়া দেবার চেষ্টা সে আমার দ্বারা কিছুতেই হতে পারেনা।কারন তার মতো নীচতা ও নিষ্ঠুরতা আর কিছু নেই।’