সময়টা ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। নিউইয়র্কের একটি হোটেলে চোখাচোখি হয়ে গেলো মা-ছেলের। মা তো মমতাময়ী। ছেলেকে দেখে প্রাথমিক অবস্থায় আবেগঘন হয়ে উঠলেও সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেন তিনি। সামলাতে তাকে হবেই। কারণ যে উদ্দেশ্যে তিনি আজ এখানে এসেছেন, ঠিক সেই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করতেই এসেছেন তার ছেলে। ইতিহাস মাঝে মাঝে সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। আজ নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অবস্থান নেবার পালা এসেছে। এই মুহূর্তে আবেগের তাড়নায় হেরে যেতে পারেন না তিনি। প্রচন্ড শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে তাকে। এক প্রগাঢ় অনুভূতির জোরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। আজ তিনি কোনো মা নন, আজ তিনি শুধুই একজন প্রতিনিধি। দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসীন করাই তার উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের পক্ষে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব দেয়ার জন্য শেখ মুজিবর রহমান পাঠিয়েছেন চাকমা রাজমাতা বিনীতা রায়কে এবং একই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করবার জন্য ২১ সদস্যের একটি দলের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে।
চাকমা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। কিন্তু তবুও এদের উৎপত্তি এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমনের ইতিহাস নিয়ে বহুমত রয়েছে। চাকমারা মূলত হীনযান মতবাদের অনুসারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী। নিজেদেরকে তারা ‘চাঙমা’ বলেও অভিহিত করে থাকে। কেনো তারা নিজেদেরকে ‘চাঙমা’ বলে, তার যথার্থতা খুঁজে না পেলেও আমরা জানি যে, বর্মি ভাষায় ‘চাক’ বা ‘চেক’ শব্দের অর্থ ‘শাক্য’ এবং ‘ম্যাং’ অর্থ ‘রাজা’। সেই অর্থে ‘চাঙমা’ অর্থ দাঁড়ায় ‘শাক্য-রাজবংশীয়’। এ কারণে চাকমারা নিজেদেরকে শাক্য-রাজবংশীয় গৌতম বুদ্ধের উত্তর পুরুষ বলে মনে করে। তবে কারো কারো মতে আবার ‘চম্পকনগর’ এর ‘চম্পক’ থেকে ‘চাঙমা’ নামটির উদ্ভব। বহু প্রাচীনকালে আরাকানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘কুকি ভূমি’ বলা হতো। লামা তারানাথের মতে, মুসলমানদের বিহার বিজয়ের আগে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু কুকি ভূমিতে পালিয়ে যায়। ১৫৫০ সালে পর্তুগীজ নাবিক যোয়া ডি বোরোস তার মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব অববাহিকায় ‘চাকমাস’ নামে একটি জায়গা চিহ্নিত করেন। ধারণা করা হয়, চাকমারা বহু আগে থেকেই এখানে বসবাস করতো। বিরাজ মোহন দেওয়ানের ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ বইতে পাওয়া যায় যে, চাকমারা ১৪১৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশে এসেছিলো। আরও ধারণা করা হয়, মধ্য আরাকানের পাহাড়ী এলাকাতেও তারা বাস করতো। সুগত চাকমা আবার তার বই ‘চাকমা পরিচিতি’ –তে বলেন যে, আসাম-ত্রিপুরা থেকেই চাকমারা এ দেশে এসেছিলো। তবে অধিকাংশ চাকমারা মনে করে, চম্পকনগরই তাদের আদি বাসস্থান। কিন্তু কোথায় এই চম্পকনগর তা স্পষ্ট করে জানা যায় নি। চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন যদিও মনে করেন যে, ভারতের ভাগলপুরের কর্ণপুর রাজ্যের রাজধানীই ছিলো চম্পকনগর।
এই চাকমা জনগোষ্ঠী কিন্তু প্রত্যেক যুগেই নিজেদের স্বায়ত্তশাসনে বহাল ছিলো। মুঘল শাসনামল হোক কিংবা ব্রিটিশ শাসনামল, চাকমারা কখনো নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের সাথে কোনো ধরনের বোঝাপড়া মেনে নেয় নি। ১৬১৬ সাল থেকে মুঘলদের সাথে চাকমাদের কিছু বিরোধ চলতে থাকলেও তা ছিলো সাময়িকের জন্য। পরবর্তীতে ১৭১৩ সালে মুঘলরা নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক করের বিনিময়ে চাকমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে তাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি স্থাপন করেছিলো এবং আর কখনোই চাকমাদেরকে তারা তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে নি। এরপর ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব মীর কাসিম চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর ও বর্ধমান অঞ্চল ব্রিটিশদেরকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিলে নতুন করে ব্রিটিশদের সাথে চাকমাদের আরেকটি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এমনকি ১৭৭০ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত প্রায় চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ব্রিটিশ ও চাকমাদের মধ্যে। কিন্তু এক পর্যায়ে ব্রিটিশরাও চাকমাদের শক্ত অবস্থান টের পায় এবং অবশেষে ১৭৮৭ সালে বছরে চাকমাদের কাছ থেকে ৫০০ মণ তুলা কর হিসেবে পাওয়ার বিনিময়ে ব্রিটিশ-চাকমা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। লর্ড কর্ণওয়ালিস চাকমাদের উদ্দেশ্যে নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, ‘তারা স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত জাতি’।
চাকমা জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেনো, বিতর্কিত ৫০তম চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের জন্ম কিন্তু এই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতেই হয়েছিলো, ১৯৩৩ সালের ১৪ মে। ত্রিদিব রায়ের বাবা ছিলেন ৪৯তম চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায়। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক কেশব চন্দ্র সেনের নাতনি ও ব্যারিস্টার সরল চন্দ্র সেনের মেয়ে বিনীতা সেনের প্রেমে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর বিনীতা সেন ‘বিনীতা রায়’ নামে পরিচিত হন এবং ৪৯তম চাকমা রাণীর মর্যাদা লাভ করেন।
রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সময়েই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং চাকমা সার্কেল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়ে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের এমন অদ্ভূত সিদ্ধান্তের কারণ স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও রাজা নলিনাক্ষ রায় এই সিদ্ধান্তে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। কারণ ভারতীয় কংগ্রেসের নীতি অনুসারে স্বাধীন ভারতে কোনো ধরনের স্থানীয় রাজা, রাজকুমার বা কোনো ক্ষুদ্র রাজ্যকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না –এমনটাই বলা হয়েছিলো। আর চাকমারা কখনোই নিজেদের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ণ হতে দিতে রাজি নয়। সুতরাং ভারতের সাথে থাকলে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ১৯৩৫ সাল থেকে টানা বারো বছর রাজত্বকারী নলিনাক্ষ রায়ের মৃত্যু হলে ১৯৫৩ সালের ২ মার্চ চাকমা সার্কেলের ৫০তম রাজা হিসেবে ত্রিদিব রায় সিংহাসনে বসেন। বিনীতা রায় তখন থেকে রাজমাতার দায়িত্ব পালন করেন। ততোদিনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অস্থির পরিস্থিতি আরও অস্থিরভাবে প্রকাশ হতে শুরু করে দিয়েছে। সেই বছরই ‘আরতি’ নামের একজন অপরূপা সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেন ত্রিদিব রায়। স্ত্রীকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন ঠিকই (যার নমুনা ত্রিদিব রায়ের লেখা ‘দ্য ডিপার্টেড মেলোডি’ থেকে আমরা দেখতে পাই), কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন নিজের ক্ষমতা ও চাকমাদের স্বায়ত্তশাসনকে। আর এ জন্যই মনে-প্রাণে সবসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে গেছেন তিনি।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে শেখ মুজিবর রহমান ত্রিদিব রায়কে আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু এ সময় ত্রিদিব রায়ের কাছে নিজের ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো এবং তিনি শেখ মুজিবর রহমানের এই প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিলো, বাংলাদেশের সাথে থাকলে তিনি নিজের স্বায়ত্তশাসন টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। এ জন্য নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে যোগদান করেন তিনি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সেই নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিলো এবং বাকি দুটি আসনের মধ্যে একটি পেয়েছিলেন ত্রিদিব রায় ও আরেকটি পেয়েছিলেন নূরুল আমীন।
আমরা সবাই-ই জানি যে, এতো বিপুল ভোটে জয়লাভের পরও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে এবং এই ঘটনাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। ত্রিদিব রায় ও নূরুল আমীন উভয়েই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের কিছুকাল আগে ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। ইয়াহিয়া খান ত্রিদিব রায়কে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের নতুন সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের তিন পার্বত্য জেলার স্বার্থ দেখা হবে। আর ত্রিদিব রায়ের বিশ্বাস ছিলো, পাকিস্তানের এতো উন্নতমানের সামরিক বাহিনী এবং চীনের মতো শক্তির সমর্থনের সাথে বাংলাদেশ পেরে উঠবে না। কিন্তু সব সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী সকল কর্মকান্ডের জন্য ত্রিদিব রায় নিজের ছেলে দেবাশীষ রায়কে রাজা ঘোষণা করে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ইয়াহিয়া খানের পতনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৩ সালে ত্রিদিব রায়কে প্রেসিডেন্সি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একজন মুসলমান ব্যক্তিই হতে পারবেন। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগে অসম্মত ত্রিদিব রায় এই সুযোগও হারিয়ে ফেলেন। এদিকে তার মা রাজমাতা বিনীতা রায় স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমি পুনর্গঠন ও ভূমি পুনর্বাসন মন্ত্রী (১৯৭৫-৭৬ সাল) এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (১৯৭৬-৭৮ সাল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্কে যখন ত্রিদিব রায় ও বিনীতা রায়ের দেখা হয়েছিলো, তখনও বিনীতা রায় ত্রিদিব রায়কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করে নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে। কিন্তু ত্রিদিব রায় তাতে রাজি হন নি। তার জীবদ্দশায় তিনি আর কোনো দিনই বাংলাদেশে ফিরে আসেন নি, এমনকি ১৯৭২ সালের দালাল আইনে নিজের নামের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করবার জন্যও না। মি. দেবসরকারের মতে, সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে পাকিস্তানের এক জনগোষ্ঠীর রাজা ভেবেছেন। আর এ জন্যই মি. দেবসরকার তার বইতে ত্রিদিব রায়কে ‘পাকিস্তানের শেষ রাজা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ত্রিদিব রায়ের সিদ্ধান্ত ছিলো আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক। প্রাচীন ইতিহাস এটাই বলে যে, চাকমারা ব্রিটিশ ভারতে সবসময় স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে এসেছে। তারা সবসময় ‘নিজেদের আলাদা রাজত্ব’, ‘নিজেদের আলাদা পরিচয়’ –এই বিষয়গুলোকে ভীষণ প্রাধান্য দিতো। মি. দেবসরকারের গবেষণা অনুযায়ী, ত্রিদিব রায় নিজের রাজত্ব ও রাজপরিবারের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখবার জন্যই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে গেছেন। কিন্তু তার এই নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক চাকমা জনগণই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। এমনকি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ত্রিদিব রায়ের আপন চাচা কোকনদাক্ষ।
পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্তানের হয়ে বহু দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক দেশে তাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও পাঠানো হয়েছে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারেও কাজ করে গেছেন। কিন্তু নিজের জীবদ্দশায় আর কোনো দিনই তিনি নিজের স্বজনদেরকে কাছে পান নি। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইসলামাবাদের ‘চাকমা হাউজ’ -এ মৃত্যুবরণ করেন তিনি। নিজের ভূমিতে শেষকৃত্য পালনের তার শেষ ইচ্ছাও পূরণ করা সম্ভব হয় নি তার ওপর বাংলাদেশের নাগরিকদের চরম অসন্তোষের কারণে। অবশেষে মৃত্যুর দশ দিন পর ইসলামাবাদেই দাহ করা হয় তাকে।
সময়টা ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। নিউইয়র্কের একটি হোটেলে চোখাচোখি হয়ে গেলো মা-ছেলের। মা তো মমতাময়ী। ছেলেকে দেখে প্রাথমিক অবস্থায় আবেগঘন হয়ে উঠলেও সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেন তিনি। সামলাতে তাকে হবেই। কারণ যে উদ্দেশ্যে তিনি আজ এখানে এসেছেন, ঠিক সেই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করতেই এসেছেন তার ছেলে। ইতিহাস মাঝে মাঝে সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। আজ নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অবস্থান নেবার পালা এসেছে। এই মুহূর্তে আবেগের তাড়নায় হেরে যেতে পারেন না তিনি। প্রচন্ড শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে তাকে। এক প্রগাঢ় অনুভূতির জোরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। আজ তিনি কোনো মা নন, আজ তিনি শুধুই একজন প্রতিনিধি। দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসীন করাই তার উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের পক্ষে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব দেয়ার জন্য শেখ মুজিবর রহমান পাঠিয়েছেন চাকমা রাজমাতা বিনীতা রায়কে এবং একই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করবার জন্য ২১ সদস্যের একটি দলের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে।
চাকমা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। কিন্তু তবুও এদের উৎপত্তি এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমনের ইতিহাস নিয়ে বহুমত রয়েছে। চাকমারা মূলত হীনযান মতবাদের অনুসারী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী। নিজেদেরকে তারা ‘চাঙমা’ বলেও অভিহিত করে থাকে। কেনো তারা নিজেদেরকে ‘চাঙমা’ বলে, তার যথার্থতা খুঁজে না পেলেও আমরা জানি যে, বর্মি ভাষায় ‘চাক’ বা ‘চেক’ শব্দের অর্থ ‘শাক্য’ এবং ‘ম্যাং’ অর্থ ‘রাজা’। সেই অর্থে ‘চাঙমা’ অর্থ দাঁড়ায় ‘শাক্য-রাজবংশীয়’। এ কারণে চাকমারা নিজেদেরকে শাক্য-রাজবংশীয় গৌতম বুদ্ধের উত্তর পুরুষ বলে মনে করে। তবে কারো কারো মতে আবার ‘চম্পকনগর’ এর ‘চম্পক’ থেকে ‘চাঙমা’ নামটির উদ্ভব। বহু প্রাচীনকালে আরাকানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘কুকি ভূমি’ বলা হতো। লামা তারানাথের মতে, মুসলমানদের বিহার বিজয়ের আগে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু কুকি ভূমিতে পালিয়ে যায়। ১৫৫০ সালে পর্তুগীজ নাবিক যোয়া ডি বোরোস তার মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব অববাহিকায় ‘চাকমাস’ নামে একটি জায়গা চিহ্নিত করেন। ধারণা করা হয়, চাকমারা বহু আগে থেকেই এখানে বসবাস করতো। বিরাজ মোহন দেওয়ানের ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ বইতে পাওয়া যায় যে, চাকমারা ১৪১৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশে এসেছিলো। আরও ধারণা করা হয়, মধ্য আরাকানের পাহাড়ী এলাকাতেও তারা বাস করতো। সুগত চাকমা আবার তার বই ‘চাকমা পরিচিতি’ –তে বলেন যে, আসাম-ত্রিপুরা থেকেই চাকমারা এ দেশে এসেছিলো। তবে অধিকাংশ চাকমারা মনে করে, চম্পকনগরই তাদের আদি বাসস্থান। কিন্তু কোথায় এই চম্পকনগর তা স্পষ্ট করে জানা যায় নি। চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন যদিও মনে করেন যে, ভারতের ভাগলপুরের কর্ণপুর রাজ্যের রাজধানীই ছিলো চম্পকনগর।
এই চাকমা জনগোষ্ঠী কিন্তু প্রত্যেক যুগেই নিজেদের স্বায়ত্তশাসনে বহাল ছিলো। মুঘল শাসনামল হোক কিংবা ব্রিটিশ শাসনামল, চাকমারা কখনো নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের সাথে কোনো ধরনের বোঝাপড়া মেনে নেয় নি। ১৬১৬ সাল থেকে মুঘলদের সাথে চাকমাদের কিছু বিরোধ চলতে থাকলেও তা ছিলো সাময়িকের জন্য। পরবর্তীতে ১৭১৩ সালে মুঘলরা নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক করের বিনিময়ে চাকমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে তাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি স্থাপন করেছিলো এবং আর কখনোই চাকমাদেরকে তারা তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে নি। এরপর ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব মীর কাসিম চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর ও বর্ধমান অঞ্চল ব্রিটিশদেরকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিলে নতুন করে ব্রিটিশদের সাথে চাকমাদের আরেকটি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এমনকি ১৭৭০ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত প্রায় চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ব্রিটিশ ও চাকমাদের মধ্যে। কিন্তু এক পর্যায়ে ব্রিটিশরাও চাকমাদের শক্ত অবস্থান টের পায় এবং অবশেষে ১৭৮৭ সালে বছরে চাকমাদের কাছ থেকে ৫০০ মণ তুলা কর হিসেবে পাওয়ার বিনিময়ে ব্রিটিশ-চাকমা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। লর্ড কর্ণওয়ালিস চাকমাদের উদ্দেশ্যে নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, ‘তারা স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত জাতি’।
চাকমা জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেনো, বিতর্কিত ৫০তম চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের জন্ম কিন্তু এই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতেই হয়েছিলো, ১৯৩৩ সালের ১৪ মে। ত্রিদিব রায়ের বাবা ছিলেন ৪৯তম চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায়। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক কেশব চন্দ্র সেনের নাতনি ও ব্যারিস্টার সরল চন্দ্র সেনের মেয়ে বিনীতা সেনের প্রেমে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর বিনীতা সেন ‘বিনীতা রায়’ নামে পরিচিত হন এবং ৪৯তম চাকমা রাণীর মর্যাদা লাভ করেন।
রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সময়েই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং চাকমা সার্কেল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়ে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের এমন অদ্ভূত সিদ্ধান্তের কারণ স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও রাজা নলিনাক্ষ রায় এই সিদ্ধান্তে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। কারণ ভারতীয় কংগ্রেসের নীতি অনুসারে স্বাধীন ভারতে কোনো ধরনের স্থানীয় রাজা, রাজকুমার বা কোনো ক্ষুদ্র রাজ্যকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না –এমনটাই বলা হয়েছিলো। আর চাকমারা কখনোই নিজেদের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ণ হতে দিতে রাজি নয়। সুতরাং ভারতের সাথে থাকলে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ১৯৩৫ সাল থেকে টানা বারো বছর রাজত্বকারী নলিনাক্ষ রায়ের মৃত্যু হলে ১৯৫৩ সালের ২ মার্চ চাকমা সার্কেলের ৫০তম রাজা হিসেবে ত্রিদিব রায় সিংহাসনে বসেন। বিনীতা রায় তখন থেকে রাজমাতার দায়িত্ব পালন করেন। ততোদিনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অস্থির পরিস্থিতি আরও অস্থিরভাবে প্রকাশ হতে শুরু করে দিয়েছে। সেই বছরই ‘আরতি’ নামের একজন অপরূপা সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেন ত্রিদিব রায়। স্ত্রীকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন ঠিকই (যার নমুনা ত্রিদিব রায়ের লেখা ‘দ্য ডিপার্টেড মেলোডি’ থেকে আমরা দেখতে পাই), কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন নিজের ক্ষমতা ও চাকমাদের স্বায়ত্তশাসনকে। আর এ জন্যই মনে-প্রাণে সবসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে গেছেন তিনি।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে শেখ মুজিবর রহমান ত্রিদিব রায়কে আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু এ সময় ত্রিদিব রায়ের কাছে নিজের ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো এবং তিনি শেখ মুজিবর রহমানের এই প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিলো, বাংলাদেশের সাথে থাকলে তিনি নিজের স্বায়ত্তশাসন টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। এ জন্য নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে যোগদান করেন তিনি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সেই নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিলো এবং বাকি দুটি আসনের মধ্যে একটি পেয়েছিলেন ত্রিদিব রায় ও আরেকটি পেয়েছিলেন নূরুল আমীন।
আমরা সবাই-ই জানি যে, এতো বিপুল ভোটে জয়লাভের পরও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে এবং এই ঘটনাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। ত্রিদিব রায় ও নূরুল আমীন উভয়েই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের কিছুকাল আগে ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। ইয়াহিয়া খান ত্রিদিব রায়কে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের নতুন সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের তিন পার্বত্য জেলার স্বার্থ দেখা হবে। আর ত্রিদিব রায়ের বিশ্বাস ছিলো, পাকিস্তানের এতো উন্নতমানের সামরিক বাহিনী এবং চীনের মতো শক্তির সমর্থনের সাথে বাংলাদেশ পেরে উঠবে না। কিন্তু সব সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী সকল কর্মকান্ডের জন্য ত্রিদিব রায় নিজের ছেলে দেবাশীষ রায়কে রাজা ঘোষণা করে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ইয়াহিয়া খানের পতনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৩ সালে ত্রিদিব রায়কে প্রেসিডেন্সি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একজন মুসলমান ব্যক্তিই হতে পারবেন। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগে অসম্মত ত্রিদিব রায় এই সুযোগও হারিয়ে ফেলেন। এদিকে তার মা রাজমাতা বিনীতা রায় স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমি পুনর্গঠন ও ভূমি পুনর্বাসন মন্ত্রী (১৯৭৫-৭৬ সাল) এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (১৯৭৬-৭৮ সাল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্কে যখন ত্রিদিব রায় ও বিনীতা রায়ের দেখা হয়েছিলো, তখনও বিনীতা রায় ত্রিদিব রায়কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করে নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে। কিন্তু ত্রিদিব রায় তাতে রাজি হন নি। তার জীবদ্দশায় তিনি আর কোনো দিনই বাংলাদেশে ফিরে আসেন নি, এমনকি ১৯৭২ সালের দালাল আইনে নিজের নামের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করবার জন্যও না। মি. দেবসরকারের মতে, সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে পাকিস্তানের এক জনগোষ্ঠীর রাজা ভেবেছেন। আর এ জন্যই মি. দেবসরকার তার বইতে ত্রিদিব রায়কে ‘পাকিস্তানের শেষ রাজা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ত্রিদিব রায়ের সিদ্ধান্ত ছিলো আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক। প্রাচীন ইতিহাস এটাই বলে যে, চাকমারা ব্রিটিশ ভারতে সবসময় স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে এসেছে। তারা সবসময় ‘নিজেদের আলাদা রাজত্ব’, ‘নিজেদের আলাদা পরিচয়’ –এই বিষয়গুলোকে ভীষণ প্রাধান্য দিতো। মি. দেবসরকারের গবেষণা অনুযায়ী, ত্রিদিব রায় নিজের রাজত্ব ও রাজপরিবারের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখবার জন্যই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে গেছেন। কিন্তু তার এই নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক চাকমা জনগণই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। এমনকি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ত্রিদিব রায়ের আপন চাচা কোকনদাক্ষ।
পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্তানের হয়ে বহু দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক দেশে তাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও পাঠানো হয়েছে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারেও কাজ করে গেছেন। কিন্তু নিজের জীবদ্দশায় আর কোনো দিনই তিনি নিজের স্বজনদেরকে কাছে পান নি। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইসলামাবাদের ‘চাকমা হাউজ’ -এ মৃত্যুবরণ করেন তিনি। নিজের ভূমিতে শেষকৃত্য পালনের তার শেষ ইচ্ছাও পূরণ করা সম্ভব হয় নি তার ওপর বাংলাদেশের নাগরিকদের চরম অসন্তোষের কারণে। অবশেষে মৃত্যুর দশ দিন পর ইসলামাবাদেই দাহ করা হয় তাকে।
প্রথম প্রকাশঃ Manab Zamin