পুরোহিত রাজা মৃত্যুবরণ করেছেন। চারিদিকে শোকের ছায়া। মোচেদের রাজা তো ছিলেন প্রজাদের কাছে ডেমিগড, অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক দেবতা। রাজা যখন সামনে দিয়ে যেতেন, কেউ তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেতো না। মাথা নিচু করে থাকতো প্রত্যেকে। প্রতি মুহূর্তে প্রজারা পূজা করতো সামনে থাকা মোচে রাজাকে। সেই পরম পূজনীয় রাজার মৃত্যুতে প্রজাদের মন বিষাদে ছেয়ে গেছে। কিন্তু বিষাদগ্রস্ততাকে তো প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। মৃত্যুর পরের জীবনই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। পরকালের জীবনের প্রতি তারা প্রচন্ড রকমের বিশ্বাসী। তাই কোনোরকম ভুল-ত্রুটি হওয়া চলবে না। তারা ভালো করেই জানে যে, শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন মোচে রাজা এবং মিলিত হবেন নিজের স্বজনদের সঙ্গে।
মমিকৃত মৃতদেহটিকে রাখা হয়েছে পিরামিডের প্রাসাদে। টিম টিম করে জ্বলছে মশালের আলো। রাজার অন্তিম যাত্রার পথকে পবিত্র করবার কাজেই নিয়োজিত আছে প্রত্যেকে। রাজার শবটিকেও প্রস্তুত করা হচ্ছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। প্রত্যেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ, সামরিক প্রধান, বিজ্ঞ ও পন্ডিতগণ এবং উপদেষ্টামন্ডলী উপস্থিত আছেন রাজার মৃতদেহের পাশে। সামরিক প্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টা ভালো করেই জানেন, তারাও সমাধিস্থ হতে চলেছেন প্রভুরই পাশে। আগামীকালই তাদের মৃত্যু কার্যকর করা হবে। কিন্তু তাদের মনে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। বরং নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছেন তারা। এমন সুযোগই বা ক’জন পায়? নিজেদের প্রভুর শবযাত্রার সঙ্গী হতে পারাটাই যেনো তাদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের ব্যাপার।
মোচেরা বিশ্বাস করে, তাদের মাকড়শা দেবতা জাল বুনে সমগ্র মানব সম্প্রদায় ও পৃথিবীকে আবদ্ধ করে রেখেছে। তিনিই পরলোকের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন সম্মানিত রাজাকে। মাকড়শা দেবতা যেনো খুব সহজেই রাজার আত্মাকে চিনে নিতে পারেন, সে জন্য রাজার চেহারায় লেপে দেয়া হচ্ছে লাল রঙের পবিত্র সিনেবার। তার সমস্ত মুখমন্ডল ঢেকে দেয়া হলো সোনার তৈরী মুখোশ দিয়ে, বাইরের জগৎ থেকে চিরতরে আলাদা করে দেয়া হলো তার চেহারাটি। তার সমস্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও অলংকারাদি তার সাথে দেয়া হয়েছে কি না, সেটিও নিশ্চিত করা হলো।
প্রজারা ভীষণ ভালোবাসে তাদের রাজাকে। তাদের শোক আর বিলাপে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সমগ্র দেশবাসী এসেছে রাজাকে বিদায় জানাবার জন্য, শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে উপহারও এনেছে সাথে। রাজাকে তো আর খালি হাতে বিদায় দেয়া যায় না। রাজার জন্য নিয়ে আসা উপহারের বিশাল অংশ রঙিন নকশা করা মৃৎপাত্রে ছেয়ে আছে। সেসব মৃৎপাত্রে খোদাই করা হয়েছে চমৎকার সব কথাচিত্র। মোচেদের শিল্পীসত্ত্বার যে তুলনা হয় না, তারই প্রমাণ এসব মৃৎপাত্র।
১৯৮৭ সাল। প্রত্নতত্ত্ববিদ ওয়াল্টার আলভা ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত, ভীষণ অসুস্থ। একদিন নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলেন তিনি। এমন সময়ে হঠাৎ স্থানীয় থানা থেকে ফোন এলো। থানার পুলিশ প্রধান তাকে অবিলম্বে থানায় দেখা করতে বললেন। তাদের কাছে নাকি লুট করা কিছু প্রত্নসামগ্রী পৌঁছেছে। এ বিষয়েই আলভার মতামত চাইছেন তারা। ফোন রেখে প্রায় লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন ওয়াল্টার আলভা। এক মুহূর্তও দেরী করা চলবে না। উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তিনি। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কাশতে কাশতে থানায় পৌঁছলেন তিনি।
থানায় একটি টেবিলের সামনে তাকে বসতে দেয়া হলো। টেবিলের ওপর কাগজে মুড়িয়ে রাখা সোনার তৈরী দুটি বড় আকারের চীনাবাদাম, একটি সোনার মুখোশ এবং আরো বেশ কয়েকটি জিনিস। এগুলো দেখে মুহূর্তের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে গেলো আলভার শরীর। তিনি নিশ্চিত, বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা খুঁজে পাবার সন্ধিঃক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। কোনো এক বৃহত্তর আবিষ্কার যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।
হাস্যকর হলেও সত্যি, এতো গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রীর খবরটা কিন্তু চোর নিজে এসেই পুলিশকে দিয়েছিলো। হ্যাঁ, কয়েকজন টুম্ব রবারই খুঁজে বের করেছিলো এসব মহামূল্যবান জিনিস। কিন্তু প্রকৃতি নিজেও হয়তো চাচ্ছিলো ইতিহাসের উন্মোচন করতে। তাই তো সেই টুম্ব রবারদের নিজেদের মধ্যেই লেগে গেলো ঝগড়া। তাদের এই অন্তঃর্কলহের জের ধরেই একজন টুম্ব রবার এসে নিজে থেকেই সমস্তটা জানায় পুলিশকে এবং পুলিশ জানায় ওয়াল্টার আলভাকে। সেই চোরের কাছ থেকেই কিন্তু জানা যায় যে, কোথা থেকে পেয়েছে তারা এসব প্রত্নসামগ্রী। আর দেরী না করে আলভা শুরু করে দেন তার কাজ। শুরু হয় খনন।
খুঁড়তে খুঁড়তে প্রথমেই মিললো বসে থাকা একটি মৃতদেহ, যার পায়ের পাতা কেটে ফেলা হয়েছে। অনেকেই ভাবলো, আলভা যা খুঁজছিলেন, তা হয়তো পেয়ে গেছেন। হয়তো এই কঙ্কালই তার গন্তব্য। কিন্তু না, আলভা ঠিকই বুঝেছিলেন, নিশ্চয়ই কোনো রাজার সমাধিকে পাহারা দেবার জন্যই এই লোকটিকে রাখা হয়েছিলো এবং তার পা দুটোও কেটে ফেলা হয়েছিলো যেনো এক মুহূর্তের জন্যও রাজাকে একলা রেখে সে কোথাও চলে যেতে না পারে। আলভা অনুমান করেছিলেন, হয়তো আরেকটু খুঁড়লেই কোনো রাজাকে পেয়ে যাবেন তিনি। তবে আলভা ও তার দল তখনো জানতেন না যে, কতো বড় সারপ্রাইজ তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। অবাক হয়ে তারা আশেপাশে রাখা একের পর এক মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব সম্পদ প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন।
আরো একটু খুঁড়তেই পাওয়া গেলো কতোগুলো কাদামাটির পাত্র এবং একটি বর্গাকৃতির চেম্বার। চেম্বারের কেন্দ্রেই একটি কাঠের প্রকোষ্ঠ, যেটি ছিলো মূলত একটি সারকোফেগাস। সারকোফেগাসের এক কোণায় ওপরের দিকে আরো একজন লোকের কঙ্কাল। এই লোকটারও পা দুটো কাটা। তার মাথায় ছিলো তামার তৈরী একটি হেলমেট এবং হাতে ছিলো বর্ম। এবার কেন্দ্রের সেই সারপ্রাইজটি দেখবার পালা।
আলভার জন্য অপেক্ষা করে ছিলো অদ্ভূত এক বিস্ময়। পেরুর উত্তর উপকূলে হুয়াকা রাজাদা বা সিপানের কাছে আবিষ্কৃত হলো এক আশ্চর্য সমাধি, যেখানে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় শায়িত আছেন মৃত মোচে রাজা। ঠিক কেন্দ্রেই শায়িত ছিলেন তিনি। তাকে ঘিরে রয়েছে আরো বেশ কিছু সমাধি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো ৩৫ থেকে ৫৫ বছরের মাঝামাঝি। তার সাথে থাকা চোখ ধাঁধানো সব সম্পদই বলে দেয়, এই ব্যক্তি মোচেদের কাছে ঈশ্বরের সমতুল্য ছিলেন। তাই সদ্য আবিষ্কৃত এই সমাধিস্থলের নাম দেয়া হলো ‘লর্ড অফ সিপান’।
গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, লর্ড অফ সিপানকে সমাহিত করা হয়েছিলো খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে। সোনা, রূপা ও তামার তৈরী বহুমূল্যবান অলংকার দিয়ে সাজানো ছিলো তার দেহ। মাথায় ছিলো পালকযুক্ত বিশাল অর্ধচন্দ্রাকৃতি হেড্রেস, মুখে মুখোশ, গলায় ছিলো চমৎকার নেকলেস, নাকে ও কানে ছিলো রিং। মুখে দেয়া মুখোশটি ধর্মযাজক বা যোদ্ধার প্রতিকৃতি নির্দেশ করে। চীনাবাদামের আকৃতিতে তৈরী তার সোনা ও রূপার নেকলেস জীবনের চক্রকেই নির্দেশ করে। সোনার মাধ্যমে সূর্য দেবতার পৌরুষত্ব এবং রূপার মাধ্যমে চাঁদের দেবীর নারীত্বের কমনীয়তাকে তুলে ধরা হয়। সেই সাথে সোনা ও রূপা আসলে জীবন-মৃত্যুর চক্রকেও তুলে ধরবার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে নেকলেসটি চীনাবাদামের আকৃতিতেই কেনো তৈরী করা হলো, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নি। হয়তো মোচেদের জীবনে বাদাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য বলে বিবেচিত হতো।
সিপানের সেই সমাধিস্থলে পা কাটা লোক দুজন এবং রাজার মৃতদেহসহ তার চারপাশে মোট বারোটি মৃতদেহ পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে গৃহপালিত প্রাণী, কিশোরী মেয়ে, শিশু ও যোদ্ধাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কঙ্কাল মিলেছে। অনুমান করা হয়, রাজাকে পরকালে সঙ্গ দেবার জন্য তাদের অনেকেই স্বেচ্ছামরণ গ্রহণ করেছিলেন।
রাজার সমাধির মাথার কাছে ছিলো নয় থেকে দশ বছর বয়সী এক শিশুর কঙ্কাল। আরেক পাশে ছিলেন তার তিনজন স্ত্রী। আরো ছিলেন দুই জন স্বনামধন্য পুরুষ যোদ্ধা। এ ছাড়াও রাজার প্রিয় কুকুরটিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছিলো তার সঙ্গে। ছিলো দুটি ভেড়াসদৃশ প্রাণীর দেহও, যাদেরকে সম্ভবত উৎসর্গ করা হয়েছিলো।
লর্ড অফ সিপান আবিষ্কারের পর এই ধরনের আরও চৌদ্দটি সমাধির হদিস মিলেছিলো সিপানে এবং এসব সমাধিতে পাওয়া প্রত্নসামগ্রী ও অলংকারাদির সংখ্যা এতো বেশি ছিলো যে, এগুলো সংরক্ষণের জন্য আলাদা একটি জাদুঘরই তৈরী করতে হয়েছিলো।
লর্ড অফ সিপানের আবিষ্কারের এই গল্পটি কিন্তু হাওয়ার্ড কার্টারের মিশরের তুতানখামেনের পিরামিড আবিষ্কার থেকে কোনো অংশে কম নয়। পেরুর চিত্রকলার প্রধান অংশ হিসেবেই আবির্ভাব হয়েছিলো এক সময়ের এই মোচে সভ্যতার। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে গড়ে ওঠা এই মোচে জাতি রাজনৈতিকভাবে নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করতে না পারলেও অন্যান্য বেশ কিছু বিশেষত্ব তাদেরকে অমর করে রেখেছে। তাদের দৃষ্টিনন্দন ইট দিয়ে তৈরী নিখুঁত সব স্থাপত্য ও পাত্রে আঁকা চিত্রগুলোর মধ্যেই চমৎকারভাবে ফুটে উঠতো তাদের জীবনাচার ও ধর্মীয় রীতিনীতি। কৃষিভিত্তিক জাতি মোচে। সুপ্রাচীন সেই সময়ে তাদের কৃষিকাজের উন্নত কলাকৌশল ও সেচ ব্যবস্থার দক্ষতা অবাক করবার মতো ছিলো। মোচেরা সিরামিকের তৈরী পাত্রগুলোর নিচের অংশ কোনোরকম চাকার সাহায্য ছাড়াই অদ্ভূত দক্ষতায় শুধুমাত্র হাত ব্যবহার করেই সমতল বানিয়ে ফেলতো। বিস্ময়কর হলেও তামার কোনো অলংকারকে সোনার পানি দিয়ে ধোয়ানোর বা সোনার প্রলেপ দেয়ার প্রক্রিয়াটি আসলেই তাদের জানা ছিলো, ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতির যে জ্ঞান আমরা এই আঠারো-উনিশ শতকে এসেও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছি। সোনা, রূপা ও অন্যান্য ধাতু দিয়ে তৈরী তাদের শিল্পকর্মগুলোর সৌন্দর্য ছিলো অতুলনীয়।
মোচে সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলো ইনকা সভ্যতারও একশো বছর আগে থেকে। পেরুর সভ্যতার অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছিলো, যখন স্পেন তাদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলো এখানে। তাদের লুটপাটের ফলে ইতিহাসের প্রাচীন নিদর্শনগুলোর অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়াও এসব আদি সভ্যতার কোনো বোধগম্য লিখিত ভাষাও ছিলো না। তাই বহু দিন আমরা তাদের সম্পর্কে জানতে পারি নি। লর্ড অফ সিপানের আবিষ্কার যেনো হঠাৎ করেই আমেরিকার ইতিহাসে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা, তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। এটি ছিলো আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ সমাধি। আবিষ্কারের পর পরই একদম বাতাসের আগে খবর পৌছে গিয়েছিলো সারা বিশ্বে। মোচেদের ধাতুবিদ্যা ও নিখুঁত নকশা তৈরীর কৌশল বিস্ফোরিত চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলো পৃথিবী। সামাজিক কাঠামো ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে তারা যে কতোটা অগ্রসর হয়েছিলো, তা সহজভাবেই অনুমান করতে পেরেছিলো সবাই। তবে এতো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তুতানখামেনের মতো প্রচারণা পায় নি লর্ড অফ সিপান।
রেফারেন্সঃ