ইতিহাসের পাতায় নারীর ভূমিকা স্বীকৃত হয়েছে বারংবার। সে হোক মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর, ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ শাসক চতুর্থ হেনরি কিংবা ফ্রান্সের ষোড়শ লুই ; উনাদের সবারই জীবনে নারীর (অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রীর) এক বিশেষ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। যা তাঁদের নিজ জীবন, রাজ্য,রাজমহলের সাথে সাথে বিশ্ব ইতিহাসকেও প্রভাবিত করেছে চমৎকারভাবে।

আজ গল্প করা যাক ষোড়শ লুই এর সুন্দরী স্ত্রী কে নিয়েই — যিনি কি না  ফরাসি বিপ্লবে কলকাঠি নাড়েন। কি? আগ্রহ হয় না জানতে কিভাবে এক রমনী এমন এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের পেছনে অন্যতম কারণের জন্ম  দেন! চলুন তবে, জেনে নেই প্রভাবশালী সেই নারী আসলে কে আর কিভাবে তিনি ভূমিকা রাখেন ফরাসি বিপ্লবে।

তিনি হলেন অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা, মারি আন্তোনেত; সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার কন্যা। আন্তোনেত বাহ্যিক সৌন্দর্যে যতটা প্রশংসনীয় ছিলেন,বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে ততটাই ছিলেন  আনাড়ি। ভোগ বিলাসিতা এবং সহজেই প্রভাবিত হওয়া –তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য।  মারী আন্তোনেত ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অতঃপর তিনি ফরাসি রাজদরবারে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেন। ফ্রান্সের রানী হলেও তিনি ফরাসিদের জনস্বার্থ থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ অসম্পৃক্ত। ফ্রান্সের জনগণের প্রতি বিন্দু মাত্র সহানুভূতি ছিল না তাঁর, অথচ তিনিই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা।

মারি আন্তোনেত ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ নারী

মারি আন্তোনেতের একটা ছবি, ১৭৭৫

ষোড়শ  লুই এর সময়ে ফ্রান্স ছিল সংকটাপন্ন অবস্থায়। দেশ পরিচালনা করতে রাষ্ট্র বিশাল অংকের ঋণের বোঝা কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রীয় আয় ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করা দায়।কত পরিকল্পনা, কত সমাধান রাজার অর্থ সচিবগণ (টার্গো ,নেকারের প্রচেষ্টা উল্লেখ্যযোগ্য)  এক এক করে উপস্থাপন করেন। তবে তা পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। স্ত্রী প্রীতিতে অন্ধ রাজা এসব বাস্তবায়নের জন্য যতটা গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল তার কিয়দংশও দেন নি। দেবেন-ই বা কিভাবে! তাঁর অর্ধাঙ্গিনী যেখানে  অসম্মতি জানিয়েছেন সেখানে তো বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা করাও গুরুতর অপরাধের শামিল। তাই নাহ্?

ষোড়শ  লুই মারি আন্তোনেত স্বামী

ষোড়শ  লুই

দেখা যায়, একদিকে সমগ্র ফ্রান্স নিদারুণ অর্থ সংকটে, আর অন্যদিকে সৌন্দর্য প্রেয়সী রানী আন্তোনেতের সে কি চোখ ঝলসানো বিলাসিতা! বাজারে আহত নতুন নতুন সকল দামী রত্নে নিজেকে সাজানো চাই তাঁর। সাজসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ,আচার-আচরণ সকল ক্ষেত্রে রানীর আভিজাত্য ছিল পুরো বিশ্বের নিকট ঈর্ষনীয়।রানীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন ৫০০জন দাসদাসী।
অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধের এই রানী মারি’র যে বিচিত্র কেশবিন্যাস, আমার ধারণা কদাচিৎ বর্তমান কোনো তারকার এরূপ কেশবিন্যাসের অভিজ্ঞতা থেকে থাকতে পারে। দেখো,মাথায় যেন এক জাহাজ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। প্রতিনিয়ত সুদক্ষ শিল্পীর তৈরি অত্যন্ত ব্যয়বহুল পোশাক শোভা পেত । তাঁর এ বিলাসব্যাসন শূন্য রাজকোষকে যেন উপহাস করছিল। তথাপি রানীর ব্যয়বহুল জীবনযাত্রা বিন্দুমাত্রও ব্যাহত হয়নি। রাষ্ট্রীয় ব্যয় যত বৃদ্ধি পায়, তৃতীয় শ্রেণির উপর ততই অধিকহারে কর আরোপিত হয়।অভিজাত এবং যাজক শ্রেণি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির হওয়াতে তারা ছিলেন সকল প্রকার কর হতে মুক্ত। অতএব, অবশিষ্ট বঞ্চিত শ্রেণিটি(তৃতীয় শ্রেণি) ছিল প্রচন্ডভাবে নিষ্পেষিতও। এসব কারণে রানী মারি আন্তোনেত  ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত রানী।জনগণ তাঁকে “অস্ট্রীয় মহিলা” বলে অভিহিত করতো।এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই নয় কি?

এতক্ষণ আলোচনা হলো রানীর ব্যক্তিগত ব্যয়ের প্রভাব সম্পর্কে। তিনি কিন্তু এতেই ক্ষান্ত হন নি।অল্পদর্শিতা এবং রাজনৈতিক বিষয়ে একেবারে অনভিজ্ঞ, নির্বোধ মহারানী রাজ্যের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভিমত দিতে তৎপর ছিলেন।এমনকি রাজাকে যেকোনো সিদ্ধান্তে পরামর্শ দিয়ে  নিজ প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন তিনি।ফ্রান্সের জনগণের দূর্ভাগ্য যে,তাদের ভাগ্য ছিল এমন এক দূর্বল চিত্তের রাজার হাতে এবং এমন নীতিজ্ঞানবর্জিত রানীর হাতে সমর্পিত।

মারি আন্তোনেত

মারি আন্তোনেত ও তার বড় সন্তানের সাথে

এক্ষেত্রে রাজদরবারে বসবাসরত অভিজাতদের একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে যেন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সে উদ্দেশ্যে রানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হয়।রানীকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করতো তারা।রাজার অনুগ্রহে প্রাসাদের সর্বোচ্চ বিলাসিতা ভোগ করতো এই বিশেষ গোষ্ঠী। রাজার বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী— টার্গো,নেকার এবং ক্যালন পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের এবং ঋণ পরিশোধ করে রাজকোষকে স্থিতিশীল  অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক এবং কার্যকরী প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হন রাজার নিকট।তবে রাজা রানীর পরামর্শে সকাল প্রকার সংস্কার প্রত্যাহার করেন,পদচ্যুত করেন তাঁর  অর্থমন্ত্রীদের।অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করতে সেই প্রাসাদে অবস্থানরত রাজার পারিষদ এবং বিশেষ গোষ্ঠীই রানীকে ইন্ধন যোগায়, যা বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গের কাজ করে। রানীর খামখেয়ালিপনা ফ্রান্সের বিপ্লবকে করে ত্বরান্বিত।শীঘ্রই ফ্রান্স বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়।

সত্যি!  ধন্য রাজা ষোড়শ লুই—বলতেই হয়। ফ্রান্সের যখন চরম বিপর্যয়কাল চলছে,তখনও এই রাজ্য অভিভাবক কেবল আদর্শ স্বামীর ভূমিকাকেই বেছে নেন।অবশেষে হতভাগ্য জনগণের দূর্গতি চরমে পৌঁছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফ্রান্সের জন সাধারণ সকল অন্যায়, অসমতার বিরুদ্ধে বিপ্লবে ফেটে পড়ে। তারা ফরাসি বিপ্লবের মূল চেতনা — “সাম্য,স্বাধীনতা  এবং ভ্রাতৃত্ব ” এ স্লোগানকে সফল করতে হয় বদ্ধপরিকর। শুরু হয় ইতিহাসের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং সূদুর প্রভাব বিস্তারী “ফরাসি বিপ্লব “।

মারি আন্তোনেত গ্রেপ্তার

১৭৯১ সালের জুন মাসে ভারেনেস-এ পাসপোর্ট রেজিস্ট্রারের বাড়িতে ষোড়শ  লুই এবং তার পরিবারের গ্রেপ্তার

বিপ্লব সফল হলে বিপ্লবীরা প্রতিবিপ্লবীদের শাস্তি হিসেবে গিলোটিনে হত্যার বিধান করে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে।এরই প্রেক্ষিতে,  তাঁর প্রতি জনগণের ঘৃণা এবং তীব্র ক্ষোভের কারণে রানী মারি আন্তোনেতকে গিলোটিনে প্রাণ দিতে হয়। সুতরাং, এই প্রচন্ড প্রভাব বিস্তারকারী রানীকে বাদ দিয়ে আমাদের ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস আলোচনা রয়ে যায় অসম্পূর্ণ।