বর্ষণের সময় পাহাড়ি জলের স্রোত নামে বনের ভেতর দিয়ে এ ধরণের ছড়া দিয়ে।

ফরাসী সাহিত্যিক জুল ভার্নের “Around The World in 80 day” অবলম্বনে হলিউডের ছবি হয়েছে একাধিকবার। এর মাঝে সেরা ছবির অস্কার জিতে ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি । এই ছবির অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃশ্য ধারণ করতে নির্বাচন করা হয়েছিলো লাউয়াছড়ার এই ট্রেইন লাইনকে। ভোরের আলোয় ট্রেনের পাশ দিয়ে হেলেদুলে চলতে থাকা বুনো হাতি। চা-বাগান, ঝুড়ি মাথায় চা-বালিকা, কাঁধে বাঁশ বয়ে চলা কৃষক। রেলের সমান্তরাল আঁকাবাঁকা পাহাড়ি ছড়া, ছড়ার জলে জলকেলিরত হাতির পাল।
দেখলেই বুঝা যায়, চেনা যায় – অতি পরিচিত এই লাইনের এই দৃশ্যাবলী, এমনকি পাহাড়ি ছড়ার জলের সেই ঘোলাটে সোনালী রঙ। তার মানে পঞ্চাশের দশকেও এই অঞ্চলে বিচরণ ছিলো মুক্ত বুনো হাতির পালের। বুনো হাতি আর নাই অনেক আগে হতেই। থাকলে চোখে পড়তো। উল্লুক সহ মেছো বাঘ টাঘ বনবিড়াল যা আছে, পালিয়ে বেড়ায় মানুষের ভয়ে । লোক চক্ষুর সামনে আসে না।
শুধু এই ছবির দৃশ্যে নয়, ঢাকা – সিলেট যাত্রায় ট্রেন হতে বাস্তবেই তাকিয়ে দেখার মতো এসব দৃশ্যাবলী। এই ল্যান্ডস্কেপের আকর্ষণেই পরিচালক তাঁর টিম নিয়ে সুদূর আটলান্টিক পাড় হতে ছুটে এসেছিলেন এদেশে।
আর কোন হলিউড টিম ছবি শুটিং এর জন্য এদেশে এসেছে কিনা জানা নেই।
সবই আছে প্রায় আগের মতোই। নেই শুধু বুনো হাতির পাল। দু’একটা যা আছে, পোষা। বিরল উল্লুক সহ আর যা আছে, মনুষ্য চোখে ধরা পড়ে না তা। সাতছড়ি উদ্যানে দেখা মিলেছে বানর আর গিরগিটির, কিন্তু এই লাউয়াছড়াতে শুধুই গাছ আর বন।
তবে উদ্যানেরই একজন বললেন, বাঘ এখনো আছে দু একটা। তবে মানুষের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়
শুনতাম বাঘের গর্জনে নাকি আতংকে সন্তান প্রসব হয়ে যেতো গর্ভবতী নারীদের । উপেন্দ্রকিশোর রায়ের গল্পের বাঘ বোকা হলেও বাস্তবের বাঘ সম্পূর্ণ বিপরীত।
শিকার ধরতে আর শিকারী এড়াতে, ক্ষিপ্রতায় আর সতর্কতায় জুড়ি নেই বাঘের। এই পুঁজি নিয়েই বাঘের টিকে থাকা। জিম করবেটের লিখা হতে এই ধারণা।
জঙ্গলের শুকনো পাতার উপর পাতা পড়লে শব্দ হয়, কিন্তু এর উপর দিয়ে আস্ত বাঘ লাফিয়ে চলে যায় নিঃশব্দে।
বন্দুক থাকলেই বাঘ শিকার করা যেতো, ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। বন্দুক চালনা ছাড়াও শিকারীর থাকতে হতো বাঘের আচার আচরণ নিয়ে গভীর বাস্তব জ্ঞান।
শুধু গুলি করলেই হয় না, বাঘ মারতে গুলি করতে হতো সঠিক স্থানে, মস্তকে। নয়তো আহত বাঘই পরিণত হতো ধুর্ততম মানুষখেকো বাঘে।
তেমনি এক বাঘিনী। নেপালে সাবাড় করে দু’শো লোক। পরে সশস্ত্র নেপালীদের তাড়া খেয়ে পালায় কুমায়ুনে (বর্তমান উত্তরাখন্ড)। দিনের পর দিন চার বৎসরে হত্যা করে আরো দু’শো চৌত্রিশ জনকে। মূলত পাতা কুড়োতে , গোচারনে, ফসল তুলতে বনে যাওয়া বালক, বালিকা, নারী পুরুষরাই ছিলো এর সহজ শিকার।
কাজকর্ম বন্ধ করে দিনরাত বসে থাকতে হয় দ্বার বন্ধ করে।

এই ‘মেছো বিড়াল’, স্থানীয় ভাবে পরিচিত ‘মাউচ্ছা বাঘ’। এটা সতীশ বাবুর চিড়িয়া খানার। আশেপাশের জঙ্গল হতেই সংগ্রহ করা।

পুরষ্কার ঘোষণা, আলমোড়া হতে গুর্খা সৈন্য, শিকারী নিয়োগ – সবকিছু ব্যর্থ হয়ে অসহায় ছিলো নৈনিতালের প্রশাসন। অবশেষে এই বাঘ মারতে ডিপুটি কমিশনার কথা নেন জিম করবেট সাহেবের।
শুরু হয় খোঁজ পেলেই এখানে ওখানে বাঘের পিছু নেয়া। দিনের পর দিন, মাইলের পর মাইল, চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে। চরম উৎকণ্ঠায় গাছের মাচায় উপর নির্ঘুম রাত কাটানো। পরিশেষে বাগে পান একদিন। পর পর তিনটি গুলিতে কাবু হয় এই বাঘ।
অপরিণত কোন ‘সৌখিন’ শিকারীর গুলিতে খোয়া গিয়েছিল বাঘিনীর মূল দাঁতদুটো। ফলে বুনো জানোয়ার শিকারে ব্যর্থ হয়ে মানুষের পেছনে ছুটা। গুলির ক্ষত বয়ে বেড়ানো শিকার করতে অপারগ এই বাঘগুলোই চলে আসতো লোকালয়ে।
এছাড়াও, নরমাংসের স্বাদ পাওয়া কোনো কোন বাঘও আসক্ত হয়ে পড়তো নরমাংসে।
তেমনি ছিলো রুদ্র প্রয়াগের চিতা। এর বিচরণস্থল ছিলো সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘেরা জনপদ গাড়োয়াল। কেদারনাথ থেকে মন্দাকিনী ও বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দার মিলনস্থলই রুদ্রপ্রয়াগ। এর পর হতেই এই দুই নদীর মিলিত ধারা পবিত্র গঙ্গা।
গাড়োয়াল রুদ্রপ্রয়াগ হয়েই যেতে হতো কেদারনাথ বদ্রীনাথ দর্শনে। প্রতি বছর যেতো ষাট হাজার যাত্রী। দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে অতি কষ্টকর সে পথ ।
১৯১৮ সালে হয় ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারী। ফুরসৎ মিলতো না মৃতদের সৎকারের। নিয়ম রক্ষার মুখাগ্নি করে মৃতদেহ ঠেলে ফেলে দিত গিরি খাদে। এসব শবদেহ খাওয়া হতেই নরমাংস খাওয়ার অভ্যাসের শুরু এই চিতার।
প্রথম শিকার ছিলো রুদ্রপ্রয়াগ হতে বারো মাইল দূরের এক গ্রামে। সেই থেকে নাম পড়ে রুদ্রপ্রয়াগের চিতা। ১৯১৮ হতে ২৬, টানা আট বৎসর অপ্রতিরোধ্য তান্ডব চালায় এই চিতা। এই চিতা শিরোনাম হয় আমেরিকা, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বজুড়ে সব সংবাদপত্রে।

এই ‘লজ্জাবতী বানর’ সতীশ বাবুর চিড়িয়া খানার। আশেপাশের জঙ্গল হতেই সংগ্রহ করা।

যোদ্ধা হিসাবে খ্যাতি ছিলো গাড়োয়াল বাসীদের। চারহাজার ছিলো লাইসেন্সধারী বন্দুক। আরো ইস্যু করা হয় তিনশত লাইসেন্স। নগদ দশ হাজার টাকা আর দুটো গ্রাম পুরষ্কার ঘোষণা করা হয় এই চিতাকে মারার জন্য।
কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় শিকার নিয়ে নিমিশে হাওয়ায় মিলিয়া যাওয়া এই চিতা।
এর ত্রাসে বিকেল হতেই পুরো জনপদে নেমে আসতো পৈশাচিক নীস্তব্ধত, দিন থাকতেই তীর্থযাত্রীরা আশ্রয় নিতো আত্রীশালায় নয়তো পথপাশের ঘরবাড়িতে।
তামাক খেতে আসে প্রতিবেশী বন্ধু। দরজাটা ভেজিয়ে মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে বসে দু’জন। ঘর ছিলো অন্ধকার, আলো ছিলো না। বন্ধুর বাড়ানো হাতে হুঁকো টা দিতেজ পড়ে গেলো মাটিতে। শব্দ করে তামাক আর কাঠকয়লার আগুন ছড়িয়ে পড়ে নীচে। দ্রুত ঝুঁকে কম্বল হতে আগুন সরাতে যেয়ে স্তিমিত চাঁদের আলোয় চোখে পড়ে বন্ধুকে তুলে নিয়ে যাওয়া চিতাকে।
ঘুণাক্ষরে টের পায়নি, অথচ কথা বলছিলো এক লহমা আগে। এই তাহলে হাত হতে হুঁকো পড়ে যাওয়ার কারণ!
করবেট সাহেবের গুলিতেই পরিশেষে মারা পড়ে চিতারূপী এই পিশাচ। কিন্তু প্রথমবার দিনের পর দিন চিতার পিছে দৌড়েদৌড়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যেয়ে দ্বিতীয়বার এসে। আড়াই মাসেরও বেশী করবেট সাহেব লেগেছিলেন এই চিতার পেছনে। গুলিতে মারার আগে সায়ানাইড বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো চিতার রেখে যাওয়া খাবারের সাথে মিশিয়ে। এতে কিছুটা কাবু হয়েছিলো এই চিতা। ১৯২৬ সালের দোসরা মে মারা হয় চিতাটিকে।
লাউয়াছড়ায় এখন হয়তো স্থানীয় ‘মাউচ্ছা বাঘ’ নামধারী মেছো বাঘগুলোই টিকে আছে, সহজে যারা লুকোতে পারে। বৃহত্তর সিলেটের গুটিকয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো হাঁস মুরগির খোঁজে এসে পড়ে মেছো বাঘ। এর নমুনা আছে শ্রীমঙ্গলের সতীশবাবুর চিড়িয়াখানায়।

এই ‘বন বিড়াল’, স্থানীয় ভাবে পরিচিত ‘বন টলা’। এটা সতীশ বাবুর চিড়িয়া খানার। আশেপাশের জঙ্গল হতেই সংগ্রহ করা।

কিন্তু চল্লিশ – পঞ্চাশের দশকেও এখানে বিচরণ ছিলো বড় বাঘের। এই বন থেকে মৌলভীবাজারের স্বর্গীয় সুরেশ হালদার মহাশয়ের শিকার করা বড়বাঘের ছবি ছিলো তাঁর সিলেট শিবগঞ্জ সেনপাড়ার বাসায়। আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে ভূস্বামী দের বাড়ির বৈঠক খানায় ঝুলতো হরিণের শিংওয়ালা খুলি। তবে বাঘ শিকার ছিলো বিরল ঘটনা।
ভাওয়ালের মেজ কুমারের শিকার করা বাঘের সাথে তুলে রাখা ছবি আছে ঢাকা যাদুঘরে।
উঁচুনিচু পাহাড়ি টিলার দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক চিরহরিৎ বনরাজি সাফ করতে করতে এখন ঠেকেছে সংরক্ষিত এই লাউয়াছড়া, সাতছড়ি আর রেমা কালেঙ্গায়
এই লাউয়াছড়াতে চোখে পড়ে সারি বাঁধা বেশ কিছু বিরল মহিরূহ। বৃটিশরা পরীক্ষামূলকভাবে এগুলো লাগিয়েছিলো ১৯২০ সালে।
১৮৯৬ তে ( ১৮৯৬–৯৮) আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের রেল লাইন হয় লাউয়াছড়ার বুক চিড়ে।
সোয়াশো বৎসর আগের কথা। বাঘ, সরিসৃপ আর মশকের বিচরণ স্থল ছিলো এই অরণ্য। শত লোভেও জেনে শুনে স্থানীয়রা আসতোনা অরণ্য মাঝে।
‘গাছ হিলায়েগা তো পয়সা মিলেগা’ বলে প্রলুব্ধ করে সারা ভারত থেকে আনা হয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে, যারা এখনো আছে এদেশের চা বাগানে। এই চা পরিবহন করতে তাদেরই দাবীতে শুরু হয় এই লাইনের কাজ।
বিশ্বজুড়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যের জায়গায় জায়গায় তখন বসছে রেল লাইন। উদ্দেশ্য বানিজ্য বিস্তার। তেমনি শ্বাপদসংকুল অরণ্যের বন জঙ্গল কেটে।
কিন্তু জন্তুদের শান্তির আবাসে এই উপদ্রব এরা সহ্য করবে কেন?

লাউয়া ছড়া উদ্যানে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে করা মানব স্থাপনা

১৮৯৮ সালে কেনিয়াতে কাজ চলছিলো উগান্ডা-মোম্বাসা রেল লাইনের। কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দুই সিংহের কারণে। দিন নেই রাত নেই, হাওয়ার মতো এসে তুলে নিয়ে যেতো শ্রমিকদের। নিরুপায় হয়ে লন্ডন থেকে পাঠানো হয় এক মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার কর্নেলকে।
কিন্তু শ্রমিকদের নিকট এই দুই সিংহ পরিগনিত হত আলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ঈশ্বর প্রেরিত ‘দেও’ হিসাবে!
এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত ছবি The Ghost and the Darkness মাইকেল ডগলাস, ভাল কিলমার, ওমপুরি অভিনীত। শ্বাসরুদ্ধকর এই সিনেমা।
এই লাউয়াছড়ায় সিংহ না থাক, বড় বাঘ ছিলো। বাঘের পেটে, সাপের ছোবলে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় কতো শ্রমিক হয়তো মারা গেছে, রেকর্ড নাই।
তবে দর্শনার্থীর ভীড়ে, মনুষ্য নির্মিত স্থাপনায় ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে বন্যপ্রাণীর নিজস্ব জগৎ। বিপন্ন করছে এই জঙ্গলের একান্ত নিজস্ব অবশিষ্ট গুটি কয় বিরল প্রাণী।
সুত্রঃ এডওয়ার্ড জেমস করবেট, চম্পাবতের মানুষখেকো বাঘিনী ( ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন); ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্র প্রয়াগ।
Contributed By: তপন রায়