বড়শশীর রাস্তার পাশের মন্দিরটায় প্রতি সোমবার সকাল সকাল একটি মন্ত্র শোনা যায়,
অজং শাশ্বতং কারণং কারণানাং,
শিবং কেবলং ভাসকং ভাসকানাম্ ,
তুরীয়ং তমঃপারমাদ্যন্তহীন,
প্রপদ্য পরং পাবনং দ্বৈতহীনম্
– শ্রীমদ্ শষ্করাচার্য, বেদসার শিবস্তোত্রম্
পুরোহিত মশাই এর মন্ত্র ধ্বনি উচ্চারণের সাথে সাথে যেন তাল মিলিয়ে পাতা নড়ছে উত্তর পাশে থাকা বেলগাছটার। আর আলতো ছোয়া দিয়ে গাঁ ঘেঁষে বয়ে চলা ঝিরঝিরে বাতাসটা। এর মধ্যে গ্রামের মেয়েরা আটপৌরে লাল পার সাদা জমিন শাড়ি পরে পুজোর থালায় ধুতরো ও আকন্দ ফুল পাঁচ রকমের ফল নিয়ে হাজির। পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণ, পুজার উপকরণ ও প্রতিমার ( শিবলিঙ্গ) অবয়ব দেখে বুঝা যায় এটি শিব মন্দির।
শিব সনাতন ধর্মের পৌরাণিক যুগের দেবতা। তবে বেদ মতে ধারণা করা হয় শিবের আদি রূপ রুদ্র। বৈদিক যুগে শিবকে নিম্ন শ্রেণির দেবতা হিসাবে গণ্য করা হতো।তাকে বনপতি,পশুপাখির দেবতা হিসাবে পুজো করা হতো। বেদ শেষ পর্বে এবং বেদ পরবর্তী তে শিবকে প্রধান দেবতা হিসাবে পুজো করা হতো। শিব ছিলেন শ্মশানচারী, উদাসীন, জটাধারী, ধ্যানমগ্ন। এমন শ্মশানচারী শিব এর প্রেমে পড়েন দেবী দূর্গা। রাজা দক্ষ দেবী দূর্গার পিতা এ প্রেম -বিবাহ মেনে নেয় নি। কারণ শিব ছিলেন উদাসীন, শ্মশানচারী, ধ্যানগ্রস্ত। স্বভাবতই এমন মেয়ে পত্নী কোন পিতা চায় না।
হিন্দু ধর্মের ১৮টি পুরাণের মধ্যে স্কন্দ পুরাণ একটি। সেই স্কন্দ পুরাণে কাশি উঃ ৮৮তে বর্ণিত আছে রাজা দক্ষ একটি যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। ভোলানাথ শিব রাজা দক্ষের জামাই ছিলেন। উক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানে মুনি-ঋষিগণ ও অন্যান্য দেবতাগণ নিমন্ত্রিত হলেও রাজা দক্ষ জামাই তথা দেবী দূর্গা (পার্বতী /মহামায়া) এঁর স্বামী ভোলানাথ শিব নিমন্ত্রিত ছিলেন না। এ কথা শিবের সহধর্মিনী জানা মাত্রই ক্ষোভে দেহ ত্যাগ করেন। শিব তাঁর সহধর্মিনীর মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে তাঁর সহধর্মিনীর শব দেহটি কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর সর্বস্তরে উন্মাদের ন্যায় ঘুরতে থাকেন এবং প্রলয়ের সৃষ্টি করেন। সে মুহূর্তে স্বর্গের রাজা বিষ্ণুদেব তা সহ্য করতে না পেরে স্বর্গ হতে একটি সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করেন। চক্রের স্পর্শে শবদেহটি ৫২/৫১টি খন্ডে বিভক্ত হয়। শবের ৫২টি খন্ডের মধ্যে বাংলাদেশে পড়ে ০২টি খন্ড। একটি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে এবং অপরটি পঞ্চগড় এর বদেশ্বরীতে। মহামায়ার খন্ডিত অংশ যে স্থানে পড়েছে তাকে পীঠ বলা হয়। বদেশ্বরী মহাপীঠ এরই একটি।
যুগ যুগ ধরে মানুষ ভোলানাথ আর দেবী দূর্গার প্রেমকে স্মরণ করেছে পুজোর মাধ্যমে। সনাতন ধর্মাবলম্বী মেয়েরা ভোলানাথ শিব এর মতো বর পাওয়া জন্য প্রতি সোমবার এ পুজো এবংশিবরাত্রিতে ব্রত পালন করে শিবলিঙ্গে জল ঢালে। যাতে কোন বিপদে বা সারা জীবন পাশে থাকে এবং প্রয়োজনে প্রলয়ঙ্কারী হয়ে ওঠে। তাইতো সনাতন ধর্মে মেয়েরা স্বামীকে পরমেশ্বর হিসেবে মানে। তারই বিশ্বাস আর ধারণে বদেশ্বরী মহাপীঠ এ পুজা করা হয় গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিয়ে।
লেখক: জেরিন আক্তার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ