ভারতবর্ষ বরাবরই প্রাচুর্যের দেশ ছিলো। ভারতে রাজত্ব করে যাওয়া সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে মুঘল সম্রাজ্য একাই এই প্রাচুর্যকে এক বিশেষ মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলো। মুঘল সাম্রাজ্যের চরম উৎকর্ষের সময় বাদশাহ শাহজাহান ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। রাজকোষাগার ছিলো মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত, রূপা ও চুন্নি-পান্নায় পূর্ণ।

সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক সরকার ব্যবস্থা চালু করেন। অন্য দিকে আকবর ইউরোপীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করেন। সে সময় মুঘলদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন ও ঐশ্বর্য দেখে মাথা ঘুরে যেতো বিদেশীদের। ভারতবর্ষের উৎকর্ষতা দেখে আকৃষ্ট হতো অনেকেই। মুঘল সম্রাট উদারতার সাথে এমন বহু জ্ঞানীগুণীকে তাদের দরবারে স্থান দিতেন।

আমরা সাধারণত আরব, আফগানিস্তান ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা থেকে ভারতবর্ষে আগত বিভিন্ন শিল্পীদের গল্প জেনেছি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, রাশিয়ান সম্রাটের কাছ থেকেও দূত এসেছিলেন ভারতবর্ষে এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের দর্শনপ্রার্থী হয়েছিলেন। আজ মুঘল সম্রাটদের সাথে রাশিয়ান জারদের এই বাণিজ্যিক আগ্রহ নিয়েই তবে গল্প করা যাক।

সতেরো শতকের ভারতবর্ষ ছিলো পৃথিবীর বিত্তশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি। আর এই কারণেই রাশিয়ানদেরও আগ্রহ ছিলো ভারতবর্ষ সম্পর্কে জানবার। ইতিমধ্যে মার্কো পোলো ও নিকিতন সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে ভারতবর্ষ সম্পর্কে কিছু বই রচনাও করে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে মার্কো পোলো তার বইতে ভারতবর্ষের রুবি, হীরা, সূক্ষ্ম কাপড় ও ভারতীয় অঢেল সম্পদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেললেন। পরবর্তীতে রাশিয়ান সাহিত্যেও ভারতবর্ষের সম্পদের এই বিবরণকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা শুরু হয়েছিলো। বহু আগে থেকেই ভারতীয় এক দল ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ভারতীয় তুলা, রঞ্জক, পোশাক ইত্যাদি পরোক্ষভাবে রাশিয়ায় পৌঁছে যেতো। পরবর্তীতে ১৬০০ দশকের গোড়ার দিকে রাশিয়ান জারেরা সরাসরি ভারতবর্ষের সাথে ব্যবসা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

১৬৭৬ সাল। কোন এক শরতের দিনে কাসিম ও তার প্রতিনিধিদল কাবুলের গভর্নর মোকাররম খান মীর ইসহাক এর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে তাদের সাক্ষাতের সূযোগ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন কাবুলের গভর্নরকে। আওরঙ্গজেব তখন শাহজাহানাবাদে অবস্থান করছিলেন। সময়ের অভাবের জন্য রাশিয়ান প্রতিনিধির সাথে তিনি দেখা করতে পারেন নি। তবে দেখা করতে না পারলেও নিদের্শনা পাঠিয়েছিলেন কাবুলের গভর্নরের কাছে। রাশিয়ান দূতেরা যেহেতু প্রথমবার তার সাথে দেখা করতে এসেছেন, তাই তাদেরকে যেনো যথাযথভাবে আদর-আপ্যায়ন করা হয় এবং সেই সাথে তারা যেনো নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করে দেবার নির্দেশ দিলেন সম্রাট। সেই সাথে তাদেরকে দুই হাজার টাকাও দিয়ে দিতে বলেছিলেন তিনি।

মুঘল সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করবার এই অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় কাসিম বেশ হতাশাগ্রস্ত হয়ে রাশিয়ায় ফিরে যান। তবে এই ব্যর্থতার পরেও ভারতবর্ষের প্রতি রাশিয়ার আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমে নি। ১৬৯০ এর দশকে রাশিয়ার মসনদে আসীন হওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা পিটার দ্য গ্রেট ভারতীয় ভূমির সম্রাটের প্রতি গভীর আগ্রহের ফলস্বরূপ ১৬৯৫ সালে আরেকটি দল পাঠিয়েছিলেন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে। ঐ দলের প্রধান ছিলেন সেমিয়ন ম্যালেক্সি। পিটার দ্য গ্রেট রাশিয়াতে অবস্থিত ভারতীয় বণিকদেরও বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছিলেন সে সময়।

রাশিয়ার রাজা পিটার দ্য গ্রেট

সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা পিটার দ্য গ্রেট

১৬৯৮ সাল। জানুয়ারি মাসের এক কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন ভারতীয়, পার্সিয়ান ও রাশিয়ান বণিক। সাফাবিদ পারস্যের আব্বাস বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করে জাহাজটি সুরাটের ব্যস্ত বন্দরে এসে পৌঁছালো। তরুণ বণিক ও ভ্রমণকারী সেমিয়ন ম্যালেক্সি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন পিটারের পাঠানো রাশিয়ান দলটিকে। তার ইচ্ছে ছিলো, বেশ কিছু বছর ভারতবর্ষে কাটিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা রকম পণ্য সংগ্রহ করে রাশিয়ায় ফিরে যাবেন। এখানে আসার আগে তিনি পার্সিয়ান, মুলতানি এবং সিন্ধি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।

যাত্রা শুরুর তিন বছর পর রাশিয়ার সেই দলটি সুরাটে পৌঁছান (বিভিন্ন দেশে যাত্রা-বিরতি নিয়েছিলেন তারা)। ম্যালেক্সি আগে থেকেই জানতেন, সম্রাটের সাথে দেখা করার সূযোগ খুব সহজে পাওয়া যাবে না। তাই তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে বোরহানপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে তিন মাস সুরাটের একটি সরাইখানায় অবস্থান করেন।

বোরহানপুরের আশেপাশেই ছিলো সম্রাটের একটি সামরিক ক্যাম্প। বোরহানপুর পৌঁছে সম্রাটের এক কোষাধ্যক্ষের সাথে দেখা করেন ম্যালেক্সি। তার পরিচয় পাবার পর সেই কোষাধ্যক্ষই সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে ম্যালেক্সির সাক্ষাৎ করানোর ব্যবস্থা করে দেন।

ওদিকে প্রথম বার রাশিয়ানরা এসে ফিরে যাবার পর বহুদিন পার হয়েছে। সেই সাথে রাশিয়ানদের সম্পর্কে সম্রাটের মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। সম্রাট ফরমানের মাধ্যমে রাশিয়ান বণিকদেরকে সম্রাজ্যের যে কোন জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য করবার অনুমতি দিয়ে দেন। বোরহানপুরে তিন মাস অবস্থান করে ম্যালেক্সি ও তার সহযোগীরা রাশিয়া থেকে আনা পণ্যগুলো ভারতবর্ষের মাটিতে বিক্রি করে দেন। তাদের এই বিনিময়ের মাধ্যম ছিলো রৌপ্য মুদ্রা।

রাশিয়ার এই প্রতিনিধিদলটির মাধ্যমে আমরা আওরঙ্গজেবের সম্পর্কে বেশ চমকপ্রদ কিছু তথ্য পেয়েছি। ম্যালেক্সির দলের একজন সদস্য আন্দ্রেই সেমিয়েনভ ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আওরঙ্গজেবের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হচ্ছে, “ধূসর দাঁড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ।  সারা শরীরে সাদা পোশাক, মাথায় সাদা পাগড়ি। শুক্রবার নামাজের জন্য যখন তিনি মসজিদে যেতেন, সামনে থাকতো হাতি ও বাদ্যযন্ত্রীরা। সিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে, খঞ্জনি বাজিয়ে, রঙিন পতাকা নেড়ে সম্রাটের আগমনবার্তা জানানো হতো। সম্রাট তার ঝকঝকে পালকিতে বসে নামাজের জন্য মসজিদে যেতেন। সাথে থাকতো তার পুত্র ও দরবারি অভিজাতেরা।”

বোরহানপুরে কয়েক মাস থাকবার পর রাশিয়ান বণিকেরা আগ্রায় পৌঁছান। সেমিয়নভের কাছে আগ্রার সৌন্দর্য ছিলো খুবই মনোমুগ্ধকর। দেয়ালঘেরা আগ্রা ফোর্ট, প্রাসাদ, অফিস এবং মসজিদ সবকিছুই খুব দৃষ্টিনন্দন লেগেছিলো তাদের কাছে। প্রাসাদের দেয়ালের চারপাশে ছিলো পরিখা খনন করা। পরিখার পানিতে মাছ ও কচ্ছপ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। বেলে পাথরের তৈরী অপূর্ব দালানগুলো তাদের মধ্যে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলো।

ভারতবর্ষের মানুষ সম্পর্কে রাশিয়ানদের মতামত ছিলো, ভারতীয়রা অত্যন্ত ভদ্রলোক ও বন্ধুভাবাপন্ন। ভারতীয়দের শান্ত ও স্নেহময় ব্যবহার মুগ্ধ করেছিলো সেমিয়নভকে। ভারতবর্ষ থেকে তারা নিয়ে গিয়েছিলেন মসলিন ক্যালিকো ও শুষ্ক রঞ্জক।

ভারতবর্ষ থেকে রওয়ানা হবার পর ইস্পাহানি পৌঁছে রাশিয়ান দলটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সেমিয়নভ পারস্যেই থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু ম্যালেক্সির ভাগ্য খারাপ ছিলো। তিনি আর নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন নি। ফেরার পথেই তিনি ও তার সম্পূর্ণ দল প্লেগে মারা গিয়েছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর পারস্যের শাহ সরকার তাদের মালামালগুলো রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

 আলেক্সি একজন রাশিয়ার যে মুঘলদের সময় এসেছিলো

আলেক্সি মিখাইলোভিচ

রাশিয়ার সরকার ধরেই নিয়েছিলেন যে, ঐ প্রতিনিধিদলের প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। পরবর্তীতে ১৭১৬ সালে রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেট ভারতবর্ষ সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সন্ধান করছিলেন এবং সেই সময় সেমিয়নভ রাশিয়ার নতুন রাজধানী সেইন্ট পিটার্সবার্গে গিয়ে ম্যালেক্সির অভিজ্ঞতার গল্পগুলো সবার সাথে আলোচনা করেন। তাদের এসব গল্প শোনার পর রাশিয়ান সিনেটের সদস্যগণ ভারতবর্ষ সম্পর্কে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং নতুন করে ভারতবর্ষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করে থাকেন। মুঘলদের ঐশ্বর্য যে সে সময় পুরো বিশ্বের বিস্ময় ছিলো, তা-ই প্রমাণ করে ভারতবর্ষের প্রতি রাশিয়ানদের এমন কৌতুহল।

 

রেফারেন্সঃ

When India was a ‘land of diamonds’, Russian tsars eagerly tried to build ties with Aurangzeb