একজন আদর্শ সম্রাট কেমন হয়, বলতে পারো কি? আদর্শ সম্রাট সে-ই, যে নিজ সাম্রাজ্যকে সন্তানের মতো আগলে রাখে; নির্ভীক, নিঃসংশয় হয়ে তার বিস্তারে ভূমিকা রেখেই চলে এবং গৌরবের সাথে নিজের সবটুকু দিয়ে তা পরিচালনা করে।

সমুদ্রগুপ্ত বীণা চরিত্রে; Image Credit: upscprelims

আমাকে চিনতে পারছো তো? আমিই সেই শ্রেষ্ঠ সম্রাট, আমিই সমুদ্রগুপ্ত। আমি আমার নামের মতোই বিশাল ও গভীর। সমুদ্রের মতোই আমি চঞ্চল, অস্থির। স্থিরতা আমার স্বভাবে নেই। ‘মহারাজাধিরাজ’, ‘মহাপরাক্রমাঙ্ক’, ‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’, ‘অপ্রতিরথ’, ‘বিক্রমাঙ্ক’ এবং ‘কবিরাজ’ উপাধি অর্জনের নায়ক আমি। আমি পরাজিত নই। আমি পরাক্রমশীল ও অপ্রতিরোধ্য। সংস্কৃত পন্ডিত হরিষেণ ছিলেন আমার সভাকবি, তিনি আমাকে ‘শতযুদ্ধের নায়ক’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ আমি তো দিগ্বীজয়ী যোদ্ধা। আর্যাবর্তের মোট নয় জন রাজা (রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মণ, গণপতিনাগ, অচ্যূত, নাগসেন, নন্দীন, বলবর্মণ) এবং দাক্ষিণাত্যের বারো জন রাজা (কোশলের মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজা, কৌরলের মন্থরাজ, কোত্তরের স্বামীদত্ত, এরন্ডপল্লের দমন, কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপ, অভমুক্তার নীলরাজ, কুস্থলাপুরের ধনঞ্জয়, পৃষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি, বেঞ্জির হস্থিবরমন, পলাক্কের উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের কুবের) আমার কাছে পরাজিত হয়। সমতট বাদে সমগ্র বঙ্গদেশ আমার অধিকারে ছিলো। সিংহলের রাজা মেঘবর্ণও আমার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেছিলো। আমার শক্তিবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে সমতট ও কামরূপসহ পাঁচটি সীমান্তবর্তী রাজ্য এবং মদ্রক, আভির ও কাক উপজাতিদের দ্বারা শাসিত নয়টি গণরাজ্য বিনা যুদ্ধে আমার আনুগত্য মেনে নেয়।

সমুদ্রগুপ্তের গ্রে-কপার-প্লেটের শিলালিপি; Image Credit: whatisindia

সন্তানদের মধ্য থেকে সঠিক ও যোগ্য উত্তরাধিকারী বেছে নিতেও আমি দ্বিধা করি নি। আমি আমার যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যকে (২য় চন্দ্রগুপ্ত) পরবর্তী সম্রাট বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি জানতাম যে আমার বড় ছেলে রামগুপ্ত এর ঘোর বিরোধিতা করবে। ছোট ভাইয়ের (চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য) বাগদত্তা ধ্রুবস্বামিণীর প্রতি অন্যায় আচরণ ও তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করার মাধ্যমে রামগুপ্ত তার ক্রোধের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলো। তবুও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম, কেননা এই প্রতিকূলতাই আমার ছেলে চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যকে একজন দক্ষ ও আদর্শ সম্রাট হতে সাহায্য করবে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা, Image source: Wikimedia

ভারতের স্বর্ণযুগ বলা হয় কোনটিকে জানো তো? গুপ্ত শাসনামলকে। কারণ এই যুগেই ভারত উপমহাদেশ হয়ে উঠেছিলো সমৃদ্ধশালী। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, বাস্তুবিদ্যা, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, গণিত, ধর্ম, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন- প্রত্যেকটি ক্ষেত্রই এ যুগে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিলো। আর্যভট্টের নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। তিনি ছিলেন এই যুগেরই অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী। তিনি আহ্নিক ও বার্ষিকগতি এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ আবিষ্কার করেন। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত কিছু উল্লেখযোগ্য বই- ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’, ‘দশগীতিকা সূত্র’, ‘আর্যভট্টীয়ম’ এবং ‘আর্যসিদ্ধান্ত’ তাঁরই রচনা। বর্তমান হিন্দু সংস্কৃতিও কিন্তু এই স্বর্ণযুগেরই ফসল। বেশ কয়েকটি পুরাণ এবং রামায়ণ ও মহাভারত এই যুগেই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে এক নতুন সাহিত্যের রূপ লাভ করে।

সমুদ্রগুপ্ত, বীণা বাজাছেন; Image Credit- Amar Chitra Katha

ইতিহাসখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যকে কে না চেনে? রোমান সাম্রাজ্যকে সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান পূর্ব (গ্রীকভাষী) এবং পশ্চিম (ল্যাটিনভাষী)- এই দুই ভাগে ভাগ করেন। পশ্চিমের রোমান সাম্রাজ্য যখন পতনের মুখে, তখন ভারতবর্ষে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। এই শক্তিশালী সাম্রাজ্য অন্য কিছু নয়, স্বয়ং গুপ্ত সাম্রাজ্য। আর আমি হলাম এই গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। আমার বাবা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। আমি আমার বাবার প্রথম সন্তান নই, কিন্তু আমার সক্ষমতা তিনি ঠিকই টের পেয়েছিলেন। তাই তো তিনি আমার অন্য ভাইদেরকে শাসনভার না দিয়ে আমার কাঁধে এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই কচ যখন আমার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো, তখন আমি তাকে হত্যা করে সাম্রাজ্য নিজের আয়ত্তে আনতে একটুও কুন্ঠাবোধ করি নি।

এলাহাবাদ স্তম্ভ; Image Credit: Wikipedia

আমি একজন ‘লিচ্ছবি দৌহিত্র’ বা ‘লিচ্ছবায়’। বৈশালের লিচ্ছবি বংশীয় রাজকন্যা কুমারদেবী ছিলেন আমার মা। আমার বাবা শক্তি ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আমার মা কুমারদেবীকে বিয়ে করেন। আমার মা ছিলেন অনন্য এক নারী। আমি নিজেকে একজন লিচ্ছবি রাজকন্যার সন্তান বলতে গর্ববোধ করি।

আমার শাসনামলে নারীদের ছিলো শিক্ষালাভের পূর্ণ অধিকার। পুরুষ আচার্যের পাশাপাশি মহিলা আচার্যরাও বেদমন্ত্র শিক্ষা দিতেন। এছাড়াও উচ্চবংশজাত নারীরা শাস্ত্রচর্চা ও চৌষট্টি কলাবিদ্যার অনুশীলন করতেন।

শুনেছি, দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য আমাকে নাকি ভারতের নেপোলিয়ান বলা হয়। কিন্তু আমি তো নেপোলিয়ান থেকেও অনেক প্রাচীন। ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিলো আমার অভিষেক। তাই আমি নেপোলিয়ানের পরিচয়ে নয়, বরং নেপোলিয়ান আমার পরিচয়ে পরিচিত হবে।

নেপোলিয়নবোনাপার্ট

আমি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এতোটাই দূরদর্শী ছিলাম যে, উত্তর ভারতবর্ষ জয়ের ক্ষেত্রে আমি উনমূল নীতি এবং দক্ষিণ ভারতবর্ষ জয়ের ক্ষেত্রে গ্রহণ-পরিমোক্ষ-অনুগ্রহ নীতি গ্রহণ করেছিলাম যেনো উপমহাদেশের দুই অংশেই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব হয়। উত্তরে নিজের শক্তি সুদৃঢ় করেই আমি দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হয়েছিলাম।

আমার জীবন ও রাজত্বকালের ইতিহাস জানতে চাও? চারটি শিলালেখ থেকেই জানতে পারবে। এগুলো হলো- এলাহাবাদ প্রশস্তি, মালবের এরানে পাওয়া শিলালেখ, নালন্দায় পাওয়া তাম্রলেখ এবং গয়ায় পাওয়া তাম্রলেখ।

আমার রাজ্যজয় ও রাজত্বকাল সম্পর্কে বহু তথ্য হরিষেণের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ থেকেই জানতে পারবে। কারণ হরিষেণ দিগ্বীজয়ে আমার সঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমার সভাকবি, শান্তি ও যুদ্ধ বিভাগের মন্ত্রী, কুমারমাত্য এবং মহাদন্ডনায়ক।

সমুদ্রগুপ্তের Eran শিলালিপি।

দিগ্বীজয় শেষে আমি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলাম এবং এর স্মৃতি রাখার জন্য আমি স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলাম।

বাংলার সাথে কিন্তু আমার রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক। আমার শাসনামলের আগে বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় নি। বাংলা ছিলো আমার অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। আমার সময়ে প্রজাহিতৈষী কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সম্পদের প্রকাশ ঘটেছিলো; তার সুফল ভোগ করে বাংলা। বাংলা সর্বভারতীয় বাণিজ্যেরও অংশ হয়। এছাড়াও আমার শাসনামলে বাংলায় স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সর্বব্যাপী প্রচলন হয়। স্বর্ণমুদ্রার বহুল প্রচলন বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিলো।

তিনটি প্রধান শাসকদের বিজিত গুপ্ত সাম্রাজ্যের মানচিত্র

আমি ছয় ধরনের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলাম। এগুলো হলো- রাজদন্ড বা ধ্বজধারী, তীরন্দাজ বা ধনুর্ধর, পরশুধারী, বীণাবাদক, বাঘশিকারী এবং অশ্বমেধ। এর মধ্যে ‘রাজদন্ড’, ‘তীরন্দাজ’ ও ‘অশ্বমেধ’- এই তিন ধরনের মুদ্রা বাংলায় প্রচলিত ছিলো। আমার মুদ্রাগুলো লক্ষ করলেই দেখতে পাবে যে আমি ভীষণ শিকারপ্রিয় ছিলাম এবং গান গাইতে ও বীণা বাজাতে বেশ ভালোবাসতাম।

আমি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী ছিলাম ঠিকই, কিন্তু অন্য ধর্মমতকেও সবসময় সম্মান করতাম। বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধুর সাথে ছিলো আামার বিশেষ সখ্যতা। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যমঞ্জুশ্রীকল্প’-তে আমার কথা লেখা আছে। দিগ্বীজয় শেষে অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে আমি ব্রাহ্মণদের দান করেছিলাম।

আমি স্মরণীয় হয়ে আছি অনন্তকাল ধরে, কেবলমাত্র যোদ্ধা কিংবা সুশাসক হিসেবে নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও। আমি একজন কবি এবং একই সাথে সংগীতরসিকও ছিলাম।

আমি হলাম গুপ্ত বংশীয় গৌরব। কিন্তু শুধু গুপ্ত বংশের ইতিহাসেই নয়, আমার অসামান্য প্রতিভার কারণে সমগ্র ভারতবর্ষেই আমি একটি বিশেষ ও গৌরবোজ্জ্বল স্থান দখল করে আছি।