১৮৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক সৌম্য, অভিজাত ব্যক্তি তাঁর দশ-এগারো বছরের শান্ত, দীর্ঘকায় ও স্বাস্হ্যবান সন্তানকে নিয়ে হাওড়া থেকে বোলপুরগামী ট্রেনের প্রথম শ্রেণীতে উঠে বসলেন। বালকটির তখনও বারো বছর পূর্ণ হয়নি বলে রেলের নিয়মমতো ভদ্রলোক ছেলের জন্য অর্ধেক (হাফ) টিকিট কেটেছিলেন। ছেলেটিকে দেখলে মনেই হয় না তার বয়স বারো বছরেরও কম। আসলে বয়সের চেয়ে তার বৃদ্ধি কিছুটা বেশিই হয়েছিল। বালকটিরও সেই প্রথম ট্রেন যাত্রা। চোখে মুখে অসীম বিস্ময় নিয়ে সে সব কিছু নিরীক্ষণ করে যাচ্ছিল।

কোনও একটি বড় স্টেশনে গাড়ি থেমেছে। টিকিট পরীক্ষক টিকিট পরীক্ষা করে ছেলেটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ দেখলেন। কিছু একটা সন্দেহ করলেও মুখে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে তিনি আরও একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। উভয়ে গাড়ির দরজার কাছে উসখুস করে আবার চলে গেল। তিনবারের বার সম্ভবত স্বয়ং স্টেশন মাস্টার এসে হাজির হল। ছেলেটির হাফ টিকিট পরীক্ষা করে তিনি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই ছেলেটির বয়স কি বারো বছরের অধিক নহে।’ ভদ্রলোক স্থিতধী স্বভাবের, বাক-বিতণ্ডা পছন্দ করেন না। তাই বিনীতভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে তাঁর ছেলের বয়স বারো বছরের বেশি নয়, বরং অনেকটাই কম। কিন্তু স্টেশন মাস্টার তা মানতে রাজি নন, তিনি বলে বসলেন, ‘ইহার জন্য পুরা ভাড়া দিতে হইবে।’ ক্রুদ্ধ ভদ্রলোকের দুই চোখ জ্বলে উঠল। কথা না বাড়িয়ে তিনি বাক্স থেকে তখনই নোট বের করে দিলেন। হিসেব করে দাম কেটে নিয়ে বাকি টাকা ফেরত দিতে আসলে তিনি সেই টাকা মুঠোয় করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। প্ল্যাটফর্মের মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তা ঝনঝন করে শব্দ করে উঠল। স্টেশম মাস্টার অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। আসলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পয়সা ছুঁড়ে ফেলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, অন্তত পয়সা বাঁচাবার জন্য ছেলের বয়স গোপন করেননি। আর সেই কিশোর যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
( সংকলিত)