১৮৭৯ সাল। মেসোপটেমিয়া বা বর্তমান ইরাক থেকে অ্যাসিরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ও কূটনীতিবিদ হরমুজদ র‍্যাসামের নেতৃত্বে উদ্ধার হলো পিপার মতো দেখতে ছোট্ট একটি বস্তু। কিন্তু আকৃতিতে ছোট হলেও এটি যে কোনো যেনোতেনো জিনিস নয়, তার প্রমাণ এর গায়ের খোদাই করা ৪৪ লাইনের লেখাগুলো। অবাক হচ্ছেন? সত্যিই এতো ছোট একটি সিলিন্ডার আকৃতির প্রত্নবস্তুতে ৪৪ সারিতে খোদাই করা হয়েছে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিল, যা না জানলে হয়তো পৃথিবীর প্রাচীনতম সাম্রাজ্যের ও প্রাচীনতম মহান শাসকের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোকিত হওয়া কখনোই সম্ভব হতো না। মাটির তৈরী এই সিলিন্ডারটির বয়স বর্তমানে ২৫৫০ বছর। হ্যাঁ, ঠিক ২৫৫০ বছর আগেই গড়ে উঠেছিলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম সুবিশাল আকিমেনিড সাম্রাজ্য, গড়ে উঠেছিলো একজন মহান শাসকের হাত ধরে। এই মহান শাসক আর কেউ নন, রাজাদের রাজা সাইরাস। আর ১৮৭৯ সালে উদ্ধারকৃত সেই ছোট্ট সিলিন্ডারটিই বিখ্যাত ‘সাইরাস সিলিন্ডার’।

সাইরাসের সিলিন্ডার হিসাবে খ্যাত লিপিটি তার সম্পর্কে জানার অন্যতম উৎস © Wiki Media

১৯৩০ সাল। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ আন্দ্রে গোদার্দ এর নেতৃত্বে খনন শুরু হয় পার্সেপোলিসে। পার্সেপোলিস ছিলো ইরানের দ্বিতীয় শাসক বংশ আকিমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী। খননের সাথে সাথে উদ্ধার হতে লাগলো একের পর এক বিস্ময়। নির্দিষ্ট কোনো এক জাতি নয়, মিললো নানান জায়গা থেকে আসা বহুজাতিক অস্তিত্বের প্রমাণ। খোদাই করা পোর্ট্রেইটগুলোতে পার্সেপোলিসের শাসনকর্তা ও সেখানকার অধিবাসীদের ছবি ছাড়াও পাওয়া গেলো হাতির দাঁতের তৈরী জিনিসপত্র হাতে ইথিওপিয়ান অধিবাসী, লম্বা টুপি পরিহিত শিয়া অধিবাসী, ঘোড়ার গাড়িতে বসা অ্যাসিরীয় অধিবাসী, গাধার পিঠে ভ্রমণরত ভারতীয় অধিবাসীদের ছবিসহ প্রায় ২৩ ধরনের জাতিগত বৈচিত্র্য। হ্যাঁ, এরই সাথে মিললো প্রমাণ, পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে বিশাল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের প্রমাণ। উদ্ধারকৃত প্রায় ৩০ হাজার টুকরো ছোট ছোট কাদামাটির তৈরী ট্যাবলেটই বলে দিলো কতোশত না বলা রহস্য! সেই সাথে পাওয়া গেলো পৃথিবীর সবচেয়ে অপরিচিত ইলামাইট ভাষার দুটি শিলালিপি। ঠিক সাইরাস সিলিন্ডারের মতোই এই ট্যাবলেটগুলোর কিউনিফর্ম লিপিতে এবং প্রাপ্ত শিলালিপিগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে হাজার হাজার বছর আগের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের অজানা সব ইতিহাস। সুতরাং শুধু পারস্যবিরোধী গ্রীক পন্ডিতদের মুখের কথায় নির্ভর করে থাকার দিন অবশেষে শেষ হলো। এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পারসিয়ানদের নিজেদের লেখা ইতিহাসের দিকে।

খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সাল। আনশানে তখন অভিজাত বংশীয় সাইরাসের শাসন চলছে। তারই ছেলে ক্যামবিসেসের স্ত্রী মিডিয়ার রাজকন্যা মান্দানা। ক্যামবিসেস ও মান্দানার জীবনে এলো এক নতুন অধ্যায়, তাদের ছেলের জন্মের মাধ্যমে। নবজাতক শিশুর নাম রাখা হলো তার দাদার নামে, দ্বিতীয় সাইরাস। ছোট্ট পাহাড়ি নগরী আনশানের জীবন ছিলো খুব সাদামাটা। সেখানে নৈতিকতা শিক্ষার গুরুত্ব ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাই ছেলেবেলা থেকেই আনশানের সবাই পেতো ন্যায়-নীতির হাতে-কলমে শিক্ষা। এমনই একটি অহিংস পরিবেশে দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে ছোট্ট সাইরাস।

জন্মেছিলেন গোত্রীয় রাজা হিসাবে, রেখে যান সুবিশাল সাম্রাজ্য © Wiki Media

খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯ সাল। বাবা ক্যামবিসেসের পর উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত হন দ্বিতীয় সাইরাস। ‘সাইরাস’ নামে পরিচিত হলেও তার নামের আসল উচ্চারণ ছিলো ‘কুরুশ’। প্রাচীন ইরানের গোত্রীয় আইন ভেঙে তিনি গড়ে তোলেন আকিমেনিড সাম্রাজ্য। তার পূর্বপুরুষ ‘আকিমেনিস’ এর নাম অনুসারেই সাম্রাজ্যের নামকরণ করেন সাইরাস। ইরানের ছোট্ট ফার্স নগরী শাসন করতে করতে এক পর্যায়ে সাইরাস বুঝতে পারলেন পৃথিবীর নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছে দুঃশাসন আর নৈরাজ্য। এমনকি তার নিজের নানা অস্টিয়াজেস যে বিশাল মিডিয়া শাসন করছেন, সেখানেও রয়েছে প্রজাদের চরম অসন্তোষ। তিনি উপলব্ধি করলেন, কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে এই নৈরাজ্যের কবল থেকে নির্দোষ জনগণকে মুক্ত করবার জন্য। তাই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বয়ং তার নানা।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৩ সাল। অস্টিয়াজেসের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন সাইরাস। দুই দফায় চলে যুদ্ধ। সাইরাসের বিশ্বাস ছিলো, মিডিয়া যতো বিশালই হোক না কেনো, ন্যায়ের ধারায় প্রতিষ্ঠিত তার সেনাবাহিনী সেই বিশালতারও ঊর্ধ্বে। সাইরাস পরাজয়ের ভয়ে ভীত ছিলেন না। আর হয়তো এ কারণেই দুই দফা যুদ্ধ শেষে পরাজিত ও বন্দী হন নানা অস্টিয়াজেস এবং বিজয়ীবেশে মিডিয়ার সিংহাসনে বসেন সাইরাস। বিশাল মিডিয়া অধিকারের পর আকিমেনিড সাম্রাজ্য পায় এক নবরূপ। দ্বিতীয় সাইরাস হয়ে ওঠেন ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’।

মিডিয়া অধিকারের পর সাইরাস তার রাজধানী একবাটানা থেকে সরিয়ে নেন প্যাসারগাদেইতে। প্যাসারগাদেইতে প্রতিষ্ঠিত হয় আকিমেনিড সাম্রাজ্যের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রাজধানী। বিরল সৌন্দর্যে সাইরাস সাজিয়ে তুলেন প্যাসারগাদেইকে, নির্মাণ করেন এক অভিনব শহর।

প্যাসারগাদেইকে সাজানো হয়েছিল সর্বোচ্চ সৌন্দর্য দিয়ে; © Wiki Media

খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৮ সাল। পারস্যের শক্তি সম্পর্কে ঠিকভাবে অবগত না হয়েই পারস্য আক্রমণ করে বসেন লিডিয়ার রাজা ক্রিসাস। নিয়তি যেনো নিজের হাতে লিডিয়াকে সাইরাসের হাতে তুলে দেয়। পরাজিত হন রাজ্যবিস্তারের স্বপ্ন নিয়ে আসা ক্রিসাস। আর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির চেয়ে সাম্রাজ্যের উন্নয়নে অধিক মনোনিবেশকারী সাইরাস যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো জয় করে বসলেন লিডিয়াকে। এটি কি শুধুই ছিলো সাইরাসের জনবলের কৃতিত্ব, নাকি বিজয়ই ছিলো এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের নিয়তি, তা তো কেবল সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালের দিকে ব্যাক্ট্রিয়া অধিকার করেন সাইরাস। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৩৯ সালে জয় করেন ব্যবিলন। তখন ব্যবিলনের রাজা নেবুনিদাসের দুঃশাসনের বেড়াজালে অতিষ্ঠ ছিলো ব্যবিলনের জনগণ। এই দুঃসহ জনগণের কাছে দেবদূতের মতো সাইরাসের আগমন ঘটলো। তারা সানন্দে গ্রহণ করে নিলো মুক্তিদাতা রাজাকে। আর প্রজাদের ঘৃণার কারণে নিরুপায় নেবুনিদাস পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পেলেন না। ব্যবিলন অধিকারের পর মহাপ্রাণ সাইরাস ইহুদীসহ সমস্ত বন্দীদের নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিলেন। ব্যবিলনকে করা হলো শীতকালীন রাজধানী।

ব্যবিলন বিজয়ের পরই নির্মাণ করা হয় ‘সাইরাস সিলিন্ডার’। বিশেষজ্ঞদের দাবি অনুযায়ী, এই সাইরাস সিলিন্ডারটিই পৃথিবীর প্রথম মানবাধিকার সনদ। পারস্য সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় স্বকীয়তা, সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের কথা তিনটি প্রাচীন ভাষায় (প্রাচীন পারসিক ভাষা, ইলামাইট ভাষা ও ব্যবিলনীয় ভাষা) খোদাই করা হয়েছে সাইরাস সিলিন্ডারে। পরবর্তীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সাইরাস সিলিন্ডারে লিখিত নীতিমালায় অনুপ্রেরণা পেয়েছে। আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে পছন্দনীয় ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন ডিলেনো রুজভেল্টের সংগ্রহে সাইরাসের জীবন নিয়ে লেখা একজন গ্রীক লেখকের একটি বই ছিলো। তিনি বলতেন, যে কোনো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আগে সাইরাস সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিটি মানুষের স্বকীয়তা ও মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার এই ধারণা সেখান থেকেই এসেছে। আর এ জন্যই সাইরাসকে আমরা ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’ বলে থাকি।

ব্যাবিলন তাকে সাদরে গ্রহণ করে মুক্তিদাতা হিসাবে © Wiki Media

সে সময় প্রতিটি জাতির প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে একটি সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো, একটি সুরক্ষিত ও স্থায়ী জীবন লাভের আকাঙ্ক্ষা। তারা স্বপ্ন দেখতো এমন এক পৃথিবীর, যেখানে সবাই থাকবে ঐক্যবদ্ধ ও নিশ্চিন্ত। আর এমন জীবন তৎকালীন পারস্যকে উপহার দিয়েছিলেন মহান শাসক সাইরাস। ঐক্যবদ্ধ জগৎ গঠনের এই ধারণাকে বর্তমানে ‘আকিমেনিজম’ বলা হয়।

সাইরাস সিলিন্ডারে খোদিত আছে সাইরাসের ব্যবিলন জয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী। এই সিলিন্ডারে লেখা তথ্যমতে, ব্যবিলনের দেবতা মারদুককে অস্বীকার করার জন্য নেবুনিদাসকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে দেবতা মারদুকের নির্দেশেই সাইরাস ব্যবিলনের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। আসলে পুরো ব্যাপারটাই ছিলো ব্যবিলনের জনগণের সান্নিধ্য লাভের পক্ষে সাইরাসের গ্রহণ করা একটি কৌশলমাত্র।

ব্যবিলন জয়ের আগেই সাইরাস আয়োনিয়া, পার্থিয়া, ব্যাক্ট্রিয়া, সাকাই, গান্ধার, আর্মেনিয়া ইত্যাদি অধিকার করেছিলেন। ৭০ বছর বয়সের মধ্যে তিনি মধ্য এশিয়ার বিশাল এক অঞ্চল আকিমেনিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সাইরাস সিলিন্ডার থেকেই জানা গেছে, রাজারা নিজে থেকেই সাইরাসের অধীনস্থতা মেনে তাকে কর দিতেন। শান্তিপূর্ণ রাজ্য দখলের জন্য সাইরাস যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, তা তার আগে কেউ কখনো করেন নি। সাইরাস বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধানের কাছে শুধু কর দাবি করতেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের সিংহাসন থেকে বিচ্যুত করতেন না। এতে শান্তিও বজায় থাকতো এবং বিনা যুদ্ধে তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিও হচ্ছিলো পুরোদমে।

সাইরাসের রাষ্ট্রে ক্রীতদাস প্রথা ছিলো না, প্রত্যেককে কাজের বিনিময়ে দেয়া হতো উপযুক্ত পারিশ্রমিক। তিনি তার সাম্রাজ্যে প্রদেশভিত্তিক প্রশাসন বা ‘সত্রপি’ এর ধারণা চালু করেছিলেন। প্রত্যেক প্রদেশ-প্রধানকে বলা হতো ‘সত্রপ’। সত্রপরা রাজধানীতে কর পাঠাতেন এবং রাজধানী থেকে তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য পেতেন সামরিক সহায়তা। আর সত্রপদের উপর বিনা হস্তক্ষেপে নজরদারির জন্য প্রত্যেক প্রদেশে নিয়োগ করা হতো একজন প্রতিনিধি।

সাইরাস শুধু সত্রপদেরকে নিজ নিজ অঞ্চল শাসনে স্বকীয়তা ও স্বাধীনতাই দেন নি, তিনি নিজেও তাদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন। গ্রীক পন্ডিতদের মতে, ভিনদেশী প্রথা নাকি সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেছিলো পার্সিয়ানরা। হয়তো এর শুরুটাও হয়েছিলো সাইরাসের হাত ধরেই। তবে এ সমস্তই কিন্তু ছিলো তার নিজের সাম্রাজ্যের স্বার্থে। অপরকে আপন করে নেয়ার মাধ্যমে তিনি প্রজাদের হৃদয়ে স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন নিজের সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ শক্তির আসনে বসাতে।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে সাইরাস বিস্ময়কর উদারতা দেখিয়েছেন © Wiki Media

সাইরাস রাষ্ট্রের সবাইকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ এমন কোনো উপাসনালয় বা দলিল ইরানে পাওয়া যায় নি, যা সাইরাসের নিজস্ব ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিতে পারে। তবে অধিকাংশের ধারণা, সাইরাস ছিলেন জরাথ্রুস্টবাদে বিশ্বাসী, যদিও তখন জরাথ্রুস্টবাদ কতোটা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ছিলো তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। তবে সাইরাস যে ধর্মেরই অনুসারী হোক, তার গুরুত্ব এতোটাই বেশি যে খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ‘বাইবেল’ –এও তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি মুসলমানদেরও একটি বড় অংশ তাকে ‘কোরআন’-এ উল্লেখিত ‘যুলকারনাইন’ বলে বিশ্বাস করেন। প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক শাসনকর্তাও সাইরাসকে বসিয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে, গ্রহণ করেছেন তার প্রণীত রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি।

সাইরাসের রাজ্যশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিলো বাগান। বাগান নিঃসন্দেহে সৌন্দর্যের অতুলনীয় প্রতীক। তবে সাইরাসের জন্য এটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় নীতি। বাগান তৈরীর মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তার সৃষ্টি করার ক্ষমতা, প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন গড়ে তোলার পারদর্শিতা। তখন বাগানকে বলা হতো ‘প্যারাডাইসিয়া’, যেটি থেকেই মূলত ‘প্যারাডাইস’ বা ‘স্বর্গ’ এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাইরাসের জীবনে বাগান এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, বাগানে কাজ না করে তিনি খাবার গ্রহণ করতেন না। কারণ বাগানই একমাত্র জায়গা যেখানে জীবনেরা জন্ম নেয় এবং যেখানে প্রকৃতির অমূল্য উপাদান পানি তাদেরকে সতেজতা দান করে।

সাইরাস দ্য গ্রেট আকিমেনিড সাম্রাজ্যকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার আগেই খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। সাইরাসের জন্ম নিয়ে যেমন বহু মিথ প্রচলিত আছে, তেমনটাই আছে তার মৃত্যু নিয়েও। অনেকে বলেন, যাযাবর জাতি সিথিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি নিহত হন। আবার অনেকে বলেন, বৃদ্ধ বয়সে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিলো। তবে সেটা যা-ই হোক না কেনো, সাইরাস কিন্তু নিজের সমাধি নিজেই নির্মাণ করে গিয়েছিলেন প্যাসারগাদেইতে। তার সমাধিতে স্পষ্টভাবে খোদাই করা আছে, “আমি সাইরাস, একজন আকিমেনিড এবং এশিয়ার রাজা”। বিশাল পার্সিয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংস করা গ্রীকবীর আলেকজান্ডারও সাইরাসের সমাধিতে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। বর্তমানে এই স্মৃতিস্তম্ভটি ইউনেস্কো স্বীকৃত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

প্যাসারগাদেইতে সাইরাসের সমাধি © Wiki Media

প্যাসারগাদেইতে একটি স্তম্ভের ওপর চমৎকার একটি মুকুট পরিহিত এবং পেছনে প্রতীকী পাখাবিশিষ্ট একজন রাজার খোদাই করা ছবি পাওয়া যায়, যেটিকে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরাই সাইরাসের একমাত্র অবয়ব বলে মনে করেন। তার এই প্রতীকী অবয়বের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং সাইরাস সিলিন্ডার থেকে পাওয়া তার আচরণগত যৌথতা থেকে এমনটাই মনে হয় যে, তিনি আসলে শুধু পারস্যের সম্রাট হতে চান নি, পারস্যের আঙিনায় অবস্থান করে তিনি হতে চেয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীর সম্রাট। সমগ্র বিশ্ব নিয়ে স্বপ্ন যিনি দেখতে পারেন, নিঃসন্দেহে তার দূরদর্শিতার পরিমাপ করা দুরূহ।

সাইরাসের মৃত্যুর পর বিশাল আকিমেনিড সাম্রাজ্য ২৫০ বছর পর্যন্ত শৌর্য-বীর্যের সাথেই রাজত্ব করেছিলো। পরবর্তী আকিমেনিড সম্রাট ডেরিয়াস দ্য গ্রেট আকিমেনিড সাম্রাজ্যকে মিশর থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তার সময়ে সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো পার্সেপোলিসে, যেটি সূর্যের নিচে সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর বলে খ্যাত। পার্সেপোলিস ছিলো পারস্য সভ্যতার প্রাণ। যে সুবিশাল শতস্তম্ভের প্রাসাদ ডেরিয়াস পার্সেপোলিসে গড়ে তুলেছিলেন, তার সমতুল্য কোনো স্থাপনা আর একটিও হয় নি। আর তাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী নগরী পার্সেপোলিসও পেয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা।

সাইরাসের পরে সাম্রাজ্য প্রসারিত হয় তিন মহাদেশব্যাপী © Wiki Media

সাইরাসের গড়ে তোলা সুবিশাল এই আকিমেনিড সাম্রাজ্যের পতন হয় গ্রীকদের হাতে। আর গ্রীক ইতিহাসে পারস্য জাতিকে আমরা চিনেছি বর্বর ও অসভ্য জাতি হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীতে উদ্ধার হওয়া প্যাসারগাদেই এবং পার্সেপোলিসের দলিলগুলো কি সেই বিষয়ের সত্যতা তুলে ধরে? অবশ্যই না। আকিমেনিড সাম্রাজ্যের প্রকৃত ইতিহাস বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী, একজন মহান শাসকের সাথে তাল মিলিয়ে একটি সুসভ্য ও বিনীত রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাহিনী, সেই মহান শাসক যিনি সাধারণ একটি জনপদকে অল্প সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

রেফারেন্সঃ