প্রখ্যাত রোমান সেনাপতি ও শাসক জুলিয়াস সিজার ছিলেন একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, একনায়ক ও জনপ্রিয় রোমান সম্রাট। তিনি রোমান রিপাবলিকান নামক ছোট নগর রাষ্ট্র থেকে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল- রোমান প্রজাতন্ত্র। শক্তি, সাহস আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন আশেপাশের মানুষের মন ও বহু অঞ্চল, আর সামরিক শক্তিতে হয়ে উঠেছিলেন অদ্বিতীয়। জুলিয়াস সিজারের জন্ম হয়-১০০ খ্রিষ্টপূর্বে প্রাচীন রোমের সুবুর শহরে এক অভিজাত পরিবারে। ৬ বছর বয়সে তিনি রোমান আইন নিয়ে তার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা শুরু করেন। জুলিয়াস সিজারের বয়স যখন ১৬ বছর তখন তার বাবা হঠাৎ মারা যান়। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর, সেই সময় রোমের শাসক ছিলেন- সুলা। সুলার সাথে তখন সিজারের পরিবারের শত্রুতা।

জুলিয়াস সিজার ১৭ বছর বয়সে রোমের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়েকে বিয়ে করেন। সুলার শাসনের প্রভাব থেকে দূরে থাকবার জন্য তিনি তরুণ বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং রোম ছেড়ে চলে যান। শুরু হয় সৈনিক জীবন,সেখানেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন এবং যুদ্ধে প্রাণ বাঁচানোর কৃতিত্ব স্বরূপ নির্ভীক ক্রাউন পুরস্কার লাভ করেন। এরপর মিলিটারি দূত হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং একটি নৌবহর সুরক্ষার দায়িত্ব পান। সেখানে তিনি কৃতিত্বের সাথেই তার দায়িত্ব পালন করেন।

Caesar, Crassus and Pompey – Wikipedia

এর মধ্যে রোমের শাসক সুলার মৃত্যুর পর জুলিয়াস সিজার রোমে ফিরে আসেন এবং জীবিকার জন্য আইন পেশা বেছে নেন। ব্যতিক্রমী বাগ্নিতা, ভরাট কণ্ঠস্বর আর গর্ভনরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ অবস্থানের জন্য তিনি এই পেশাতেও সাফলতা অর্জন করেন। রোমানরা তাকে খুব ভালোবাসতো।রোমে ফেরার পর তিনি খুব শীঘ্রই সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে পদোন্নতি পান এবং রোম সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হন। এভাবে পম্প এবং ক্রেমাসসহ রোমের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ৪০ বছর বয়সের জুলিয়াস সিজার রোম সরকারের ” কনস্যুল” নির্বাচিত হন। এটা ছিলো রোমের সর্বোচ্চ সরকারি পদ। সরকারি পদে অভিষিক্ত থাকাকালীন সময়ে সিজার দরিদ্রদের ভূমি পুনঃবন্টনে একটি আইন সংস্কারের প্রস্তাব করেন, যদিও এতে অনেকের অমত ছিলো। তবে পরবর্তীতে পম্পের সেনাবাহিনী ও সাসাস এর অর্থ দিয়ে তার প্রস্তাবটি সমর্থিত হয়।

Statue of Julius Caesar as imperator

সিজার জানতেন যে, সরকারি কর্মচারী থাকা অবস্থায় তার আইনি কাজে বিরোধীরা নিরব থাকবে, কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তারা তাকে অভিযুক্ত করবে। জুলিয়াস সিজার এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আত্মমর্যাদা এবং অর্থ দুটোই অপরিহার্য আর তা রাজ্য জয় করার মাধ্যমেই সম্ভব। আর তাই খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ অব্দে কনস্যুল পদে থাকা অবস্থায় সিজার তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে গল প্রদেশে পৌঁছান। সেখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিবাদ ছিলো, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি ক্রমশ গল দখল করে নেন। সম্পদের পাশাপাশি তিনি চার প্রদেশের সার্বভৌমত্বও দখল করেন। কনস্যুল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি গল প্রদেশের চারটি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন। দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এখানেও গলের সকল জনগণের মন জয় করে ফেলেন তিনি। তাই পম্পের পাশাপাশি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান সেনাপতি হিসেবে জুলিয়াস সিজারকে সম্মান জানায় রোমানরা। যখন জুলিয়াস সিজারের কনস্যুল পদের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো,তখন ক্রামাস নিহত হয়। ক্রামাস মারা যাওয়ায় রোমের রাজনৈতিক ও মিলিটারি শক্তির একক অধিকারী হয়ে ওঠে পম্প। পম্প জুলিয়াসকে গলের শাসন ভার ছেড়ে দেন এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রোমে ফেরার জন্য বলেন।

সিজারের সাফল্যে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে পম্প, শুরু হয় গৃহযুদ্ধ । সাধারণ জনগণ সিজারকে আর অভিজাতরা পম্পকে সমর্থন করে। তারা সেনাবাহিনীর পদ ছেড়ে দিতে বলেন জুলিয়াস সিজারকে। সিজার তা প্রত্যাখ্যান করে সৈন্য নিয়ে রোমে আসেন। ৪৯ খ্রিষ্টপূর্বে রোম দখল করেন সিজার। পম্প পালিয়ে মিশরে চলে যায়। সিজার তাকে ধরতে মিশরে যান এবং মিশরের রাজা পম্পকে হত্যা করে তার মাথা খন্ডিত করে সিজারকে উপহার দেন। মিশরের থাকাকালীন অবস্থায় রানী ক্লিউপেট্রার সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সিজারের সহায়তায় ক্লিউপেট্রা মিশরের সিংহাসন জয় করেন। সিজার রোমে ফিরে আসার পর, সিনেট তাকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। তখন সিজার হয়ে যান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন। শাসনভার নেওয়ার পর তিনি রোম শহরকে পুরোপুরি বদলে দেন।

A depiction of Caesar and his army crossing the Rubicon. The Print Collector via Getty Image.

জুলিয়াস সিজার রোমে অসংখ্য বড় বড় অট্টালিকা ও গীর্জা নির্মাণ করেন। তিনি ৩৬৫ দিনে বছর গণনা করে জুলিয়াস ক্যালেন্ডার ও লিপ ইয়ার প্রবর্তন করেন। এছাড়াও জুলিয়াস সিজার রোমে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজ করেন। তিনি দরিদ্রদের ভূমি পুনঃবন্টন করেন, পুলিশ বাহিনী তৈরি করেন, ঐতিহাসিক নগরীর পুনঃনির্মাণ করেন, ট্যাক্স সিস্টেম তুলে দেন। জুলিয়াস সিজার প্রায়ই সিনেটের মতামত না নিয়েই আইন প্রণোয়ন ও পরিবর্তন করতেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নানাবিধ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য রোমান জনগণের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সিজার। সিজারের এই খ্যাতির কারণে তার বিরুদ্ধে আবারও ষড়যন্ত্র করা শুরু হয়। সিনেটরা ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করার, ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাসের নেতৃত্বে সিজারকে হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। ১৫ই মার্চ, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সাল জুলিয়াস সিজার সিনেটে প্রবেশ করলে হঠাৎ তাকে এলোপাথাড়ি ভাবে ছুরির আঘাত করা হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণের কারণে সিজার নিজেকে আত্মরক্ষার কোনো সুযোগ পাননি। ২৩ বার ছুরির আঘাতে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই মহান সম্রাট।

Caesar is set upon by senators on the ideas of March, a key part of the Julius Caesar summary.

সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান সেনাপতির এমন মৃত্যুতে হতবাক হয়ে পড়ে রোমবাসী। সিনেটে পম্পেইয়ের মূর্তির ঠিক নিচেই পড়ে থাকে রোমান ইতিহাসের বীর সেনাপতির নিথর দেহ। আর রোমান প্রজাতন্ত্র হারায় তার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। মূলত জুলিয়াস সিজার ছিলেন একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং দিগ্বিজয়ী সেনাপতি।

Uncovering Caesar’s Body.