খ্রিস্টপূর্ব ২২৪ সাল। পারস্যে তখন পার্থিয়ান শাসনামল। পার্থিয়ান রাজা চতুর্থ আর্তাবেনাস নিজের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে পার্থিয়া। আর পার্থিয়ার এই দুরবস্থা একজন বিচক্ষণ ও চতুর জেনারেলের দৃষ্টিকে এড়াতে পারে নি। মাত্র সাত বছর বয়স থেকে মিলিটারি ও প্রশাসনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। সক্ষম হয়েছেন দারাবগার্দ দুর্গের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে। এতো যোগ্যতা হবেই বা না কেনো! তিনি তো জরাথ্রুস্টবাদের প্রসিদ্ধ ধর্মযাজক সাসানের নাতি। শুধু তা-ই নয়, তার বাবা হলেন ইশতাখরের রাজকুমার পাপাক এবং মা হলেন শাবানকারেহ উপজাতিদের রাজকুমারী রোদাক। সাসান বংশের এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন জেনারেল পার্থিয়ানদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে বিন্দুমাত্রও দেরী করেন নি। সে সময় ক্ষমতাবান সাসান বংশের অধিকারে ছিলো ইশতাখর, যেখানে মূলত আকেমেনিড সাম্রাজ্যের নিদর্শনগুলো অবস্থিত। তবে পাপাক ইশতাখরের বাইরেও তার নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করতে আগ্রহী ছিলেন। আর এ জন্যই পার্থিয়ানদের সাথে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে সাসানদের। কিন্তু এমন সময় পাপাকের বড় ছেলে শাপুর মারা যান, যা দারাবগার্দের সেই গভর্নর জেনারেলের জন্য শাপে বর হয়ে ওঠে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে খুব সহজেই সাসান বংশের উত্তরাধিকারে পরিণত হন তিনি এবং হরমুজগানের যুদ্ধে শেষ পার্থিয়ান রাজা চতুর্থ আর্তাবেনাসকে পরাজিত করে পারস্যের সিংহাসনে বসেন তিনি। পারস্যের ইতিহাসে আরও একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন সাসান বংশের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী সাসানিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজাধিরাজ আর্তাজারজেস বা আর্দাশির।

৬২০ সিই- তে সাসানিদ সাম্রাজ্য © worldhistory.org
ইতিহাস চিরদিনই ছিলো পক্ষপাতদুষ্ট। পশ্চিমা ইতিহাসের প্রভাবে সব সময়ই আড়াল হয়ে ছিলো পূর্বের ইতিহাস। রোম তথা বাইজান্টাইন সাম্রজ্যের ক্ষমতা ও শক্তির ব্যাপকতার বিষয়ে কে না জানে! তবে প্রাচ্যের ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণের অভাবের কারণে অনেকেই জানে না যে, রোমের মতো এতো শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো পারস্য। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবচেয়ে বেশি মজবুত ছিলো পারস্যের সাসানিদ শাসনের সময়। নাকশে রুস্তমে একটি খোদাইকৃত দেয়ালচিত্রে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, কিভাবে সাসানিদ সম্রাট প্রথম শাপুরের সামনে প্রসিদ্ধ রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ান নতজানু হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সাসানিদরা নিজেদেরকে আকেমেনিড বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী বলে মানতেন। পার্থিয়ানরা ধর্মের ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন বলে তাদের সময়ে পারস্যে জরাথ্রুস্টবাদের প্রভাব কিছুটা কম ছিলো। কিন্তু সাসানিদরা ক্ষমতায় আসার পর আবারো জরাথ্রুস্টবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে সাসানিদ শাসক ও পুরোহিতেরা কঠোর নীতি অনুসরণ করেন। অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য, বিশেষ করে খ্রিস্টানদের জন্য সাসানিদ সাম্রাজ্য খুব সুখকর জায়গা ছিলো না। কারণ সাসানিদদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাইজান্টাইনরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
প্রথম সাসানিদ সম্রাট আর্দাশিরের সময় থেকেই রোম তথা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে সাসানিদদের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এই দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা পারস্যে ইসলামিক যুগের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আর্দাশির বা আর্তাজার্জেসের সময়েই পারস্যের ইরানিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। টেসিফোনকে সাসানিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী করে একটি কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন আর্দাশির এবং রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করেন জরাথ্রুস্টবাদকে।

আর্দাশির © worldhistory.org
আর্দাশিরের মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রথম শাপুর সাসানিদ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। রোমান সম্রাট সেভেরাসের সময়ে আর্দাশির বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে সফল হলেও সেভেরাসকে সম্পূর্ণুরূপে নাস্তানাবুদ করতে পারেন নি। কিন্তু প্রথম শাপুর ছিলেন নাছোড়বান্দা স্বভাবের। তার এই একরোখা স্বভাব রোমানদের উপর বেশ ভারী হয়েছিলো। তার একের পর এক পরিচালিত অভিযানগুলো রোমানদের ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলো। তিনি মেসোপটেমিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল, নিসিবিস ও কারাহ দুর্গ দখল করেছিলেন এবং আর্মেনিয়াকে প্রথম বার সাসানিদ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। রোমানদের সাথে সাসানিদদের ক্রমাগত সংঘর্ষের ক্ষতি এড়াতে রোমান সম্রাট ফিলিপ দ্য আরব প্রথম শাপুরের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় দফায় রোমান-সাসানিদ সংঘর্ষে রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ানকে যুদ্ধবন্দীতে পরিণত করার ঘটনাটি প্রথম শাপুরের প্রতি সাসানিদ সাম্রাজ্যের জনগণের মনে এক চমৎকার আস্থার জন্ম দিয়েছিলো। এ ছাড়াও প্রথম শাপুরের সময়ে কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন সাসানিদদের আত্মবিশ্বাস ও সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছিলো বহুগুণ।
প্রথম শাপুরের পরে তার ছেলে প্রথম হরমুজদ বসেন সাসানিদ সিংহাসনে। তাকে সবচেয়ে সাহসী সাসানিদ সম্রাট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনেকে তাকে একজন উন্নত মানসিকতার শাসক মনে করেন, কারণ তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না। আর তার এই উন্নত মানসিকতাই তার দ্রুত ক্ষমতাহীন হবার প্রধান কারণ।
এরপর ক্রমে ক্রমে প্রথম বাহরাম, দ্বিতীয় বাহরাম, তৃতীয় বাহরাম, প্রথম নার্সেহ, দ্বিতীয় হরমুজদ, দ্বিতীয় নার্সেহ, দ্বিতীয় শাপুর, দ্বিতীয় আর্দাশির, তৃতীয় শাপুর, চতুর্থ বাহরাম, প্রথম ইয়াজদেগার্দ, পঞ্চম বাহরাম, দ্বিতীয় ইয়াজদেগার্দ, তৃতীয় হরমুজদ, প্রথম ফিরোজ, ভালাশ, প্রথম কাভাদ, জামাসপেস, প্রথম খসরু, চতুর্থ হরমুজদ, দ্বিতীয় খসরু, ষষ্ঠ বাহরাম, দ্বিতীয় কাভাদ, তৃতীয় আর্দাশির, প্রথম সরফারায, তৃতীয় খসরু, বোরান, দ্বিতীয় সরফারায, দ্বিতীয় ফিরোজ, আজারমিদোখত, চতুর্থ খসরু, ষষ্ঠ হরমুজদ এবং তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ সাসানিদ সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন।
দ্বিতীয় শাপুরকে বলা হয় শাপুর দ্য গ্রেট। তাকেই শ্রেষ্ঠ সাসানিদ সম্রাট হিসেবে মানা হয়। পারস্যের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক এবং তার সময়েই সাসানিদ সাম্রাজ্য উন্নয়নের চূড়ায় উপনীত হয়েছিলো।
চতুর্থ বাহরামের সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, রোমান সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াসের মৃত্যুর পর পূর্ব ও পশ্চিম অংশে আর্মেনিয়ারর বিভাজন। স্বভাবতই এই বিভাজনের ফলে আর্মেনিয়ার পশ্চিম অংশ রোমের অধিকারে, আর পূর্বাংশ সাসানিদ নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিলো। আর প্রথম হরমুজদের পর একজন শান্তিপূর্ণ সাসানিদ সম্রাট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রথম ইয়াজদেগার্দ। ধারণা করা হয়, তার সময়েই রোম ও সাসানিদদের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলো।

তেহরানের আদালতে খসরু-এর মূর্তি © worldhistory.org
সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও জ্ঞানী সাসানিদ সম্রাট ছিলেন প্রথম খসরু। সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তার পারদর্শিতা ছিলো অতুলনীয়। পারস্যের ইতিহাসে তাকে একজন আদর্শ শাসকের মর্যাদা দেয়া হয়। সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জুন্দিশাপুর একাডেমী প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ভাবা যায়! প্রাচীন পৃথিবীর প্রথম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সাসানিদ আমলে! ১৯৫৫ সালে এই জুন্দিশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, যা সাসানিদ আমলের জ্ঞানার্জনের পরিধি সম্পর্কে একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে।
জানা যায়, ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলামের দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে প্রাথমিকভাবে ছয়টি চিঠি পাঠিয়েছিলেন ছয়টি সাম্রাজ্যে। এর মাঝে পারস্যে পাঠানো চিঠিটি পড়েছিলেন সাসানিদ সম্রাট দ্বিতীয় খসরু।
সাসানিদ সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট হলেন তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ, যিনি মাত্র আট বছর বয়সে সম্রাট হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আরবীয় মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু রোমানদের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ-সংঘাতে দুর্বল হয়ে পড়া সাসানিদরা শক্তিশালী ইসলামিক গোষ্ঠীর সাথে পেরে উঠতে পারেন নি। তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ৬৫২ সালে দীর্ঘ চারশো বছরের সাসানিদ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
পারস্যের সংস্কৃতি, ধর্ম ও সম্পদগুলোর প্রাচীনত্বকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য প্রদানকারী ও ধারণকারী দীর্ঘস্থায়ী পার্সিয়ান সাম্রাজ্য ছিলো সাসানিদ; প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান সাম্রাজ্যগুলোর একটি। সাসানিদদের মতো আর কোনো পার্সিয়ান শাসকই নিজেদের ঐতিহ্যকে এতো গুরুত্ব দেন নি। আকেমেনিড শাসনামলের প্রাচীন ধর্ম জরাথ্রুস্টবাদকে তারা ব্যতীত এতোটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখেন নি আর কেউই।

প্রথম ইয়াজদেগার্দ; Image Source: Wikimedia Commons
রোমান সাম্রাজ্যের কথা উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই মস্তিষ্কে দ্রুত খেলে যায় কিছু বাক্য –জুলিয়াস সিজারের বিজয়, ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির প্রেমকাহিনী, অগাস্টাসের বাণিজ্যিক জয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কি এক অদ্ভূত মেগালোমেনিয়া এই রোমান! বিশাল সুপরিচিত ও ক্ষমতাশীল এই রোমান সাম্রাজ্যকেও এক হাত দেখিয়ে দেবার মতো যোগ্যতার ছাপ রেখে গিয়েছেন সাসানিদরা, পদে পদে ঠোকর খাইয়েছেন তাদেরকে। কিন্তু আদৌ কি কখনো রোমানদের গল্প ছাপিয়ে প্রাচ্যের এসব পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের গল্প উঠে এসেছে লোকমুখে? ইসলামাইজেশনের মতো একটি ঘটনা কি করে এতো সহজে প্রচ্ছন্ন করে দিলো এতো সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও যোগ্যতাসম্পন্ন পারস্যের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে? আব্বসিড খিলাফতের স্বর্ণযুগও তো তাদেরই অবদান। অধিকাংশ বিখ্যাত মুসলিম নামগুলোও তো পারস্য থেকেই এসেছে। অথচ ইসলাম এসে বৈধ করে দিলো পারস্য-সংস্কৃতি ধ্বংসকারী আলেকজান্ডারকেও। কি নির্মম ভাগ্য!
নববর্ষ উদযাপনের রীতি থেকে শুরু করে চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণাও আমরা শিখেছি সাসানিদদের থেকে, যা এখনো পর্যন্ত আমরা ধারণ করে চলেছি। এই অমূল্য অবদানগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। আমাদেরকেই সংরক্ষণ করতে হবে প্রাচীন ও প্রাচ্যের ঐতিহ্যগুলোকে।

সাসানিদ মুদ্রায় দ্বিতীয় খসরু © Encycloaedia Iranica
রেফারেন্স:
- Sasanian Empire
- History of The Sassanid Empire – Rome’s Biggest Rivals (224–651 c.e.)
- প্রাক ইসলামিক যুগে প্রধান পরাশক্তি (পর্ব-১): সাসানিদ সাম্রাজ্য
- Ardashir I
- Emperor Valerian—The Stepping Stool Of Persia
- List of Rulers of the Sasanian Empire