১৮৫৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের অসফলতার পেছনে কলকাতার বাবু ও ঢাকার নবাবদের বিরোধীতায় কী দায়ী? জানেন কি? আমরা দুইটি পর্বে সেই গল্প বলবো। আজ প্রথম পর্বে কলকাতার বাবুদের গল্পটি বলছি। তবে তার আগে ইংরেজদের ভারতে আসার কিছু কথা বলে নেয়া যাক। ১৬০০ সালে ভারতে বৃটিশরা প্রথম আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে বাণিজ্য করতে রাণী এলিজাবেথের সনদ নিয়ে। তারা মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে এবং পরে হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মাধ্যমে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। বাংলার সুবাহদার শাহ শুজার কাছ থেকে বার্ষিক নামমাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পায় ইংরেজরা। এর ফলে জব চার্নক ১৬৯০ সালে কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুরের জমিদারি ক্রয় করে ফ্যাক্টরি স্থাপন করার মাধ্যমে কলকাতা শহরের ভিত্তি গড়েন। জব চার্নককে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বলা হতো। সম্প্রতি, কলকাতা উচ্চ আদালত এক আদেশে এই তথ্য ভুল ঘোষণা করেছেন। জানা যায়, কোম্পানির কাসিমবাজার কারখানায় জব চার্নক ১৬৫৮ সালে প্রথম একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগদান করেছিলেন। তিনি ১৬৯০ সালে সুবেদার ইব্রাহিম খানের সাথে সমঝোতা করে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত জলাভূমি বেষ্টিত সুতানটি গ্রামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি নির্মাণ করেন। এরপর থেকেই বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়। এ ঘটনা সমূহের পথ ধরেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপিত হয় এবং ১৭০০ সালে এটি একটি স্বাধীন প্রেসিডেন্সিতে রূপান্তরিত হয়।
১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোলকাতা দখল করে নিলে লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কোলকাতা পুনরায় দখল করেন । পরে লর্ড ক্লাইভ চন্দননগর দখল করার পরে সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব থেকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, এবং জগৎ শেঠদের সাথে ষড়যন্ত্র করেন এবং ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে কোম্পানি শাসনের সূচনা করেন। লর্ড রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি এবং ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সূচনাকারী। ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানীর এই শাসন স্থায়ী ছিল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইনমতে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ব্রিটিশরাজ প্রবর্তন করেন এবং রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতের সম্রাজ্ঞী হন। পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্যমে এই উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তার করার পর এই শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে ইংরেজরা তৈরি করে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ (Divide and Rule) নীতি। এই নীতির প্রধান শিকার হয়েছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত সকল দিক দিয়েই মুসলিমরা এর প্রথম শিকার হয়। অন্যদিকে, ধুরন্ধর ইংরেজরা অতি সূক্ষ্মভাবে হিন্দুদের দিয়ে নিজেদের কাজ উদ্ধার করে। এমনকি, ইংরেজদের এই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ নীতির ফাঁদে পা দেন কলকাতার অনেক উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিভাবান হিন্দু বাবুরা। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ মূলতঃ হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে শাসন করার নীতি গ্রহণ করে ইংরেজরা নির্বিঘ্নে পরবর্তী একশো বছরের শাসন চালিয়েছে। তাদের দোসর হয়েছিল কলকাতার সুবিধাভোগী হিন্দুরা। এদিকে ইংরেজরা দেখল, মুসলমানদের কোণঠাসা না করলে এবং মুসলমানদের যুগকে অন্ধকার যুগ প্রমাণ করতে না পারলে, তাদের দেশ দখলকে জাস্টিফাই করা সম্ভব হবে না। তাই তারা নবাবী শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রপাগান্ডা চালালো।
এমনকি তারা নবাবের চরিত্রে বিভিন্ন কলংক দিতে থাকলো। কিন্তু তারা যে, নবাবকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, তা স্বীকার করে না। তবে, কর্মচারী আবদুল করিমকে লেখা রানী ভিক্টোরিয়ার চিঠিতে লেখা ছিল- ‘নবাবকে হত্যা করা ঠিক হয়নি’। জানা যায়, ভারতবর্ষের প্রতি রানী ভিক্টোরিয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তখন গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠান মহা ধুমধামে পালন করা হচ্ছিল। এই সময় রানী এক বছরের জন্য দুজন ভারতের কর্মচারী পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। তখন আবদুল করিমকে রানীর লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল। আবদুল করিম রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে খুবই প্রিয় হয়ে ওঠেন। রানী ভিক্টোরিয়া ১৩ বছর ধরে ‘মুন্সী’ করিমকে প্রায় প্রতিদিন চিঠি লিখতেন। রানী-মুন্সী সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে খুব বেশি দিন আগে নয়। ব্রিটিশ রাজকীয় আর্কাইভ ও ফ্রেডেরিক পনসোনবির ১৯৫১ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথা থেকে প্রথম নজড়ে আসে এই বিষয়টি। আসলে ভারত উপমহাদেশ প্রাচীনকাল থেকেই শাসকগোষ্ঠী আর লুটেরাদের আকাঙ্ক্ষার স্থান ছিল। উর্বর মাটি, অজস্র প্রাকৃতিক সম্পদের আধার, এই এলাকায় পর্তুগিজ থেকে শুরু করে ফিরিঙ্গী, ইংরেজরা পর্যন্ত এসে হামলে পড়েছিল। যাইহোক, ফিরে যায় মূল গল্পে।
১৮৫৭ সাল। সিপাহী বিদ্রোহ। শুধু হঠাৎ মঙ্গল পান্ডের ইংরেজ সাহেবকে আক্রমণ নয়, এনফিল্ড রাইফেলসহ সিপাহীদের ক্ষোভের কারণ লুকিয়ে ছিল বৃটিশদের উপর দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও বৈষম্যে। সারা ভারতেও সিপাহীরা নড়েচড়ে উঠেছে এবং নানা সাহেব, আজিমুল্লাহ খাঁন, তাঁতিয়া টোপিরা সিপাহী বিদ্রোহের জোড়ালো নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে ইংরেজরা ভয়ে শিহরিত। তার সাথে সাথে কলকাতার বাঙালি বাবুরাও ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে তারা সিপাহী বিদ্রোহের বিরোধীতা করে বসলো। কিন্তু কেন? আজ ১৭০ বছর পর সেই পুরোনো প্রশ্ন আবার দানা বেঁধেছে মানুষের মনে। আজ আমরা জানবো সেই কলকাতার বাবুদের কলংকতম ইতিহাসের কিছু দিক।
রাজধানী কলকাতা নিয়ে ইংরেজদের যেমন একটা আলাদা নজর ছিল তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি কারণে কলকাতার বড়োলোক বাবুদেরও বড়ো মায়াময় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল কলকাতার সাথে। কলকাতা এমনই স্পর্শকাতর মহানগরী। তাই কলকাতায় ব্রিটিশদের দুরবস্থায় বাবুদের মাথায় হাত। যদিও ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু বিদ্রোহের সময়কালে কলকাতার অধিকাংশ বাবুরা সরাসরি ছিলেন ব্রিটিশরাজের পক্ষে। তারা বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থাশীল ছিলেন না। তারা ভয় পাচ্ছিল যদি বিদ্রোহী সিপাহীরা কলকাতা আক্রমণ করে তাদের ধনদৌলত লুট করে? দুশ্চিন্তায় বাবুদের আর ঘুম হয় না। ইংরেজদের ছায়াতলে থেকে কলকাতার বাঙালি বাবুরা তীলে তীলে নিজেদেরকে জাতে তুলেছে, অনেক কষ্ট করে অর্থকড়ি, সম্পদ জমা করেছে।
সিপাহী বিদ্রোহের আগুনে যদি সব শেষ হয়ে যায়, এই ভয়ে তারা ইংরেজদের শরণাপন্ন হলো এবং ইংরেজদেরকে সব রকম সাহায্য সহযোগীতা করার আশ্বাস দিল । পাইকপাড়ার রাজবাড়ি থেকে শুরু করে, শোভাবাজার রাজবাড়ি, দত্তবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, ঘোষবাড়ি, মিত্রবাড়ির বাঙালিবাবুরা পারলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তারা প্রতিদিনই সভা-সমিতি, মিটিং করছে এবং ব্রিটিশদের দালালী করছে। কিন্তু একবারের জন্যেও তারা ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করার কথা ভাবলো না। বিশেষত, এই নতুন গজিয়ে ওঠা বড়োলোক ও মধ্যবিত্ত বাঙালিবাবুরা ছিলেন হিন্দু ধর্মের লোক। অন্যদিকে, বিদ্রোহী সিপাহীদের অধিকাংশ ছিলেন মুসলমান। আবার যাদের কাছ থেকে ইংরেজরা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে তারা ছিলেন মোঘল অর্থাৎ মুসলমান। তাই কলকাতার হিন্দু বাঙালি বাবুরা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত নয়।
ব্রিটিশরা যখন বাঙালি বাবুদের বাড়ি পাহারার ব্যবস্থা করলেন, তাদের কৃতজ্ঞতা আরো বেড়ে গেল। তারা এবার ভাবলো ইংরেজদের জন্য তাদের কিছু তো করা উচিত। সেজন্য কলকাতার রামগোপাল মল্লিকের বাড়িতে রীতিমত সভা বসলো। সেই সময়ের মান্যগণ্য বাবুরা সবাই জড়ো হলো। সেখানে তারা ঠিক করলো, তারা ব্রিটিশকে সব রকমের সাহায্য করার জন্যে প্রস্তুত থাকবে। এই বিরাট অপসিদ্ধান্ত আবার ফলাও করে ১৮৫৭ সালের ২৬ মে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, রাজেন্দ্র দত্ত, হরচন্দ্র ঘোষ, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমুখ বড়ো বড়ো বুদ্ধিজীবিরা। এই আনুগত্য প্রদর্শনের সভা পরে আরো একাধিক হয়েছিল বলে জানা যায়। আসলে কলকাতার বাঙালি বাবুদের এই একেবারে চুপ থাকা ও বিরোধীতা করার পেছনে কি কারণ ছিল, তার হদিশ ইতিহাস দেয় না।
তথ্যসূত্রঃ
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সিপাহী বিদ্রোহ এবং একটি ঐতিহাসিক অবিচার, ঢাকা, ২০১৭।
অলিউর রহমান, সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস, বাংলাদেশ, ২০১৭।