২৩ জুন বর্ষার রাতে সিরাজ হেরে পলাশীর প্রান্তর থেকে পালালেন রাজ্য উদ্ধারের আশায় পাটনার দিকে। দাদপুরে মীরজাফরকে ক্লাইভ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বললেন। রাতে মীরজাফর সৈন্য সামন্ত নিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরলেন। সিরাজের সঙ্গী বিশ্বস্ত খোজা, বেগম লুৎফা, শিশু কন্যা উম্মে জোহরা এবং আরও দু চারজন মহিলা দাস দাসী। উদ্দেশ্য পাটনা। বিশ্বাসাঘাতকদের বিরুদ্ধে পরের যুদ্ধ প্রস্তুতি।
মীরজাফর সিরাজের পিছনে সেনা লেলিয়ে দিয়েই জেনানা মহলের খাজাঞ্চির আট কোটি টাকা লুঠ করতে গেলেন গোপনে। আজকের হিসেবে ৪৮০০০ কোটি টাকা। একা সাহস হল না। এই সিন্দুকের খবর যারা জানতেন মীরজাফর, আমীর বেগ খাঁ, রামচাঁদ আর নবকৃষ্ণের মধ্যে এটা ভাগ হল। লুঠটা ক্লাইভ জানতেন না। সিরাজের ফিরে আসার ভয়ে ক্লাইভের গাধা মীরজাফর মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসতে চাইছিলেন না। তিনি কুরসে আজম প্রাসাদেই অন্তরীণ ছিলেন ২৯ জুন পর্যন্ত। মুর্শিদাবাদের সিংহাসন এই কয় দিন ফাঁকা থাকল।
২৫ জুন মোহনলাল ও অন্যান্যরা বন্দী হলেন। মোহনলালকে রায়দুর্লভ বিষ দিয়ে হত্যা করলেন। ২৯এ ক্লাইভ ২০০ গোরা সৈন্য ও ৩০০ সিপাই নিয়ে মুর্শিদাবাদ শহরের মনসুরগঞ্জ প্রাসাদ হিরাঝিলে পৌঁছলেন। ক্লাইভ, মীরজাফরকে সিংহাসনে হাত ধরে বসালেও তার ভয় কাটে নি। মিরজাফর, ক্লাইভ, ওয়ালস, লুসিংটন, রামচাঁদ আর শোভাবাজার রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা মুন্সি নবকৃষ্ণ গেলেন খাজাঞ্চিখানায়। ছিল ১,৭৬,০০০ টাকার রূপো এবং ২,৩০,০০০ সোনার টাকা, দুটি লোহার সিন্দুক ভর্তি সোনার বাট, চার সিন্দুক হিরে জহরত ও দুটি সিন্দুকে চুনি পান্না। অনেকে বলেন পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা প্রাসাদ থেকে ৬২,০০০০০ টাকা লুঠ করে।
২ জুলাই। সিরাজ তখন গোবরনালা ছেড়ে রাজমহলের দিকে যাচ্ছিলেন পাটনা যাওয়ার উদ্দেশ্যে, যে রাস্তায় ১৭ বছর আগে তার দাদু আলিবর্দি পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন। পাটনায় তখন বিশাল নবাবি ফৌজ রাখা ছিল। সিরাজের স্বপ্ন পাটনা থেকে বিশাল বাহিনী এনে বাংলা উদ্ধার। মুর্শিদাবাদের অনতি দূরে সিরাজের ভৃত্যরা ক্ষুধার্ত শিশু কন্যার জন্য রান্না করছিলেন। দানা শা ফকির সিরাজের জুতোর হিরে দেখে নবাবকে চিনতে পারেন। মীরকাসেমকে খবর দেন। তাকে আটকে রেখে মীরজাফরের বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু দানসাও বাঁচেন নি। মীরকাসেম, বেগম লুৎফার শরীর থেকে কয়েক কোটি টাকার মনি রত্ন ছিনিয়ে নেয়। বহু অপমান ও অমর্যাদায় সিরাজ গঙ্গার ফেরত পথে মুর্শিদাবাদে এনে ছোট কুঠুরিতে বন্দী করে রাখা হল। মিরণকে সিরাজ হত্যার দায়িত্ব দেন মীরজাফর।
রাত্রিতে সেই ঘরে কয়েকজন ঢুকে পড়ে। নবাব নামাজ পড়ার আগে ওজু করার জন্য জল চাইলেন। কলসির জল তার মাথায় ঢেলে দেওয়া হল। সিরাজ লুটিয়ে পড়লেন। মহম্মদী বেগ সিরাজের শরীরে একের পর এক ছুরির আঘাত করলেন। সিরাজের দাদু আলিবর্দি খান মহম্মদী বেগকে একসময় প্রতিপালন করেছিলেন । মুর্শিদাবাদে সিরাজ আসার তিন ঘণ্টার মধ্যে সেই ঘরে সিরাজের মৃত্যু হয়। ইংরেজরা মহম্মদী বেগকে হত্যা করে গঙ্গার জলে ফেলে দেয়।
৩ জুলাই সিরাজের দেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে মুর্শিদাবাদ শহর ঘোরানো হয়। তার অনিন্দ্যসুন্দর রক্তাক্ত দেহখানা যখন শহরের পথে হাতির পিঠে নিয়ে বেগমের প্রাসাদের সামনে আনা হলে সিরাজের মা আমিনা বেগম তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আছাড়িপিছাড়ি কাঁদলেন। তাকে মারতে মারতে সরিয়ে নিয়ে গেলেন স্বামী খাদেম হোসেন খান।
রাজ্যের হাল ধরলেন ক্লাইভের গাধা মিরজাফর। যিনি তার প্রভু আলিবর্দির উপাধি মহাবৎ জঙ্গ নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে নাম কিনলেন ক্লাইভের গাধা। সিরাজের ফিরে আসার তার এতই ভয় তাকে তাড়া করছিল যে তিনি সিংহাসনে বসতে আক্ষরিক অর্থে ক্লাইভের হাত ধরেন।
পলাশীর কয়েক বছরের মধ্যেই পলাশী লুঠের অর্থ ভোগ করতে কেউই বেঁচে রইলেন না। রাজ্য দখলে কৃতজ্ঞ ইংরেজরা অধিকাংশ ষড়ীকে মেরে ফেলে না হয় অপদস্থ করে ভিখারী করে।
সিরাজ আজ খোশবাগে দাদু আলিবর্দীর পাশে সমাহিত।বাঙলার স্বাধীনতা সিরাজে সমাধির সঙ্গে সমাহিত হল।
বাংলায় বিশ্বাসঘাতকতার অন্য নাম হল মিরজাফর —