ভারতের হাওড়া শহরে কিশোর কবি সুকান্তের মূর্তি

সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ। আর কবিতা হল তার মুখপাত্র। তাই তো সমকালীন সামাজিকতা, প্রতিকূলতা, জাতির চেতনা, সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনার প্রকাশ ঘটে কবিতার মধ্যে। এর যথার্থ প্রতিফলন আমরা খুঁজে পাই সুকান্ত রচনাবলীতে। কবি নিজের পরিচয় দেন :

“আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃংখল দুই হাতে।”
( কবিতা : রবীন্দ্রনাথের প্রতি)
 
একদিকে পৃথিবী জুড়ে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণহুঙ্কার। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্বতন্ত্রভাবে ভারতবর্ষের বুকে নতুন উদ্যমে সঞ্চারিত করে তুলেছে এক মহাবিদ্রোহের অভিঘাত। সব মিলিয়ে জনজীবনের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। এমন পরিস্থিতিতে আগমন ঘটে কবি সুকান্তের। সালটা ছিল ১৯২৬, ১৫ই আগস্ট। কলকাতার কালীঘাটের মহিম হালদার স্ট্রীটে মাতামহের ৪৩ নং বাড়িতে জন্ম হল এই অগ্নিপুত্রের। পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায়। কিন্তু ভাগ্যান্বেষণে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে। পিতা নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মা সুনীতি দেবীর সপ্তম সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। পিতার স্বল্প আয়ের কারণেই সম্ভবত মা লক্ষ্মীর কৃপা কখনোই তাঁদের গৃহে পড়েনি। দীর্ঘদিনের অসচ্ছলতার গ্লানি কাটাতে একদিন তিনি কলম তুলে নেন। কিন্তু বাস্তব যেখানে রূঢ়, কলম কি সেখানে প্রণয় কাহিনী লেখার দুঃসাহস দেখাতে পারে? তাইতো ব্যথিত কলম শোনায় তার আর্তনাদ :
 
“হে কলম! তুমি কত ইতিহাস গিয়েছ লিখে
লিখে লিখে শুধু ছড়িয়ে দিয়েছে চতুর্দিকে।
তবু ইতিহাস মূল্য দেবে না,
কত লাঞ্ছনা, খাটুনি গিয়েছে লেখকের হাতে
ঘুমহীন চোখে অবিশ্রান্ত অজস্র রাতে।
তোমার গোপন অশ্রু তাইতো ফসল ফলায়
বহু সাহিত্য বহু কাব্যের বুকের তলায়। “
(কবিতা: কলম)
 
যাই হোক, বালক সুকান্তকে ভর্তি করা হল বেলেঘাটায় কমলা বিদ্যামন্দির নামক প্রাথমিক স্কুলে। পড়াশোনার পাশাপাশি মোটামুটি ন-দশ বছর বয়স থেকেই কবিতা লেখার সূত্রপাত। সেই সময় ‘সঞ্চয়’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করলেন। তাঁর লেখা কবিতা ওই সময় ‘শিখা’ নামে একটি পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। ছাপা অক্ষরে তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘বিবেকানন্দের জীবনী’ প্রকাশিত হয়েছিল শিখা পত্রিকায়। সুকান্তের বয়স যখন মাত্র দশ-এগারো বছর, তখন ‘রাখাল ছেলে’ নামক একটি রূপক গীতি চিত্র রচনা করেন। এছাড়াও ‘মধু মালতী’ ও ‘সূর্য প্রণাম’ নামক দুটি চিত্র রচনা করেছিলেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ হলে সুকান্ত ভর্তি হলেন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাই স্কুলে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বন্ধু অরুণাচল বসুর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন হাতে লেখা পত্রিকা- ‘সপ্তমিকা’। এঁদের যৌথ প্রচেষ্টার ফসল শিক্ষক নবদ্বীপচন্দ্র স্মৃতিকথন থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতা- ‘শতাব্দী’ । বয়স তাঁর কাছে ছিল নিতান্তই একটি সংখ্যা মাত্র। কবির বয়স তখন বারো কি তেরো; সময়, প্রতিকূলতা এমনকি ভাবনার গণ্ডী পেরিয়ে তিনি হাত বাড়ালেন আঠারোর নিশানায়, লিখলেন :
 
“আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে ভাঙতে চায় পথের বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয় _
আঠারো বছর বয়স জানেনা কাঁদা।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।”
(কবিতা: আঠারো বছর বয়স)
 
সুকান্ত ছিলেন মার্ক্সবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী। ১৯৪৪ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে (কমিউনিস্ট পার্টিতে) যোগ দেন। একদিকে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এই তরুণের হৃদয় সমাজসেবামূলক কাজে নিযুক্ত হওয়া থেকে তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। তারই প্রতিফলন আমরা দেখি তাঁর কবিতায়:
 
“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব – তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি –
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
( কবিতা: ছাড়পত্র)
 
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী হওয়ায় তিনি তখন পার্টির কাগজ বিক্রি করতেন। এই কাগজ বিক্রি করতে গিয়ে চারপাশের মানুষের আরও অনেক আছে চলে আসেন তিনি। ভারতবর্ষ তখন পরাধীন দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অপমান বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:
 
“অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি!
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম।
অবাক পৃথিবী! সেলাম তোমাকে সেলাম!”
(কবিতা: অনুভব)
 
শুধু যুদ্ধ নয়, মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ সরকারের ক্রমবর্ধমান অত্যাচার এবং তৎকালীন কিছু ধনী সমাজের দ্বারা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মন্বন্তরে। দুর্ভিক্ষপীড়িত অগণিত বুভুক্ষু মানুষের হৃদয়বিদারক চিৎকারে সমব্যথী হয়ে অসহায় রূপকের আড়ালে কবি বলে ওঠেন:
 
“আশ্রয়ে যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত –
তবুও সহানুভূতি জানালোনা সেই বিরাট শক্ত ইমারত।”
(কবিতা: একটি মোরগের কাহিনী)
 
দুর্ভিক্ষের সঙ্গে সঙ্গ দিল ঝড়, বন্যা ও মহামারী। মানুষের মৃতদেহের মিছিলে মহানগরী পরিণত হল মহাশ্মশানে। অত্যাচারী শাসক সেদিকে একবার ফিরেও তাকালো না। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় কবি রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করলেন সেই কাহিনী :
 
“তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরে তাকাও না পিছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তো জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত,
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত,
ঢেকে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্বত, অত্যাচারী পদধ্বনি
(কবিতা: সিঁড়ি)
 
শেষে একসময় ধৈর্য্যের সব বাঁধ ভেঙে গেছে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কবির কলম গর্জে ওঠে :
 
“শোন্‌ রে মালিক, শোন্‌ রে মজুতদার
তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড় –
হিসাব কি দিবি তার?…
…আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।”
হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও কবি আশাবাদী। তাই তো কবির কবিতায় অঙ্কুরিত বীজ ও আগামীতে বনস্পতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
“জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
আমিতো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;
আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা
উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা;
তারপর দীপ্ত শাখা মেলে দেবো সবার সম্মুখে,
ফোটাবো বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে।
ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই – জানি আমি ভাবি বনস্পতি,
বৃষ্টির
পরাধীন ভারতের দুঃখ, দুর্দশা আর অত্যাচারের কাহিনী জর্জরিত তাঁর ক্ষুদ্র জীবন কাহিনী। স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সুদিন কখনো আসেনি তাঁর। তবুও বুক ভরা আ, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি।”
(কবিতা: আগামী)
 
এই আশাবাদী, দুর্জেয় কবিও হার মেনেছেন কঠিন বাস্তবতার কাছে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের অন্বেষণে হারিয়ে গেছে তার কাব্যিক মানসিকতা। যে চাঁদ আর জোৎস্নাকে ঘিরে নাজানি কত কবির কত কবিতা আর রোমান্টিকতার সৃষ্টি; সেই চাঁদ -ই শেষমেষ রূঢ় বাস্তবের প্রেক্ষাপটে কবির কবিতায় ধরা দেয় অপ্রাপ্ত ক্ষুধানিবারক এক টুকরো ঝলসানো রুটি রূপে :
 
“প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা –
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী- গদ্যময় :
পূর্ণিমা- চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।”
 
একদিকে সহজাত কবিসত্তা আর অন্যদিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অসহনীয় পরিশ্রম থাবা বসায় কবির ব্যক্তি জীবনে। আস্তে আস্তে ভেঙে পড়তে থাকে তাঁর শরীর। প্রথমে ম্যালেরিয়া এবং তারপর আবার মারণব্যাধি যক্ষা বাসা বাঁধে তাঁর শরীরে। নিষ্ঠুর বাস্তবের করালগ্রাস এই অদমনীয় দরিদ্র কবিকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেই দেয় মৃত্যুর সীমানায়। ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র একুশ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হয়। ‘কিশোর কবি’ অভিধায় ভূষিত হলেও সুকান্ত কবিতা সমকালীন সময়ের প্রাসঙ্গিকতা ছাপিয়ে বলিষ্ঠতার নিরিখে কালোত্তীর্ণ। তবে দুঃখের বিষয়, প্রকাশিত কোনো কাব্য দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। তাই সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর বিষয়ে বলেছেন – “কবি হওয়ার জন্যেই জন্মেছিল সুকান্ত। কবি হতে পারার আগেই মরলো সে। দ্বিগুণ দুঃখ হয় তার জন্য।”
 
পরাধীন ভারতের দুঃখ, দুর্দশা আর অত্যাচারের কাহিনী জর্জরিত তার ক্ষুদ্র জীবন কাহিনী। স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সুদিন কখনো আসেনি তার। তবুও বুক ভরা আশা ছিল। আর দুচোখে ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ঠিকানা কবি রেখে গেছেন স্বাধীন ভারতে, মুক্ত স্বদেশে।
 
“বন্ধু আজকে বিদায়!
দেখছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,
ঠিকানা রইল,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা করো।”
(কবিতা : ঠিকানা)
 
লেখা – Nargis Rumi
ডিজাইন – Rajdeep Singha Roy
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel