অতি প্রাচীনকাল থেকেই স্রষ্টা হিসেবে নারী দেবীর স্বরূপকে বিশ্বাস এবং আরাধনা করা হতো, কেননা গর্ভধারণ, জন্মদান ও লালন-পালন কেবলই একজন নারীর পক্ষেই সম্ভব। ধর্মদেবতা হিসেবে পুরুষতান্ত্রিকতার অনুপ্রবেশের আগে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই নারীকে দেবীমাতার মর্যাদা দিতেন এবং সে সময়ের দেবীপ্রধান ধর্মগুলোর প্রতিনিধিত্বও করতেন একেক জন নারী পুরোহিত।
যখন আদি পৃথিবী নারীর উপাসনা করতো, তখন সমাজে নারীর অবস্থান ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও উঁচু স্তরে আসীন। শুধু পুরোহিত হিসেবেই নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্বের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান ছিলো। তখন পৃথিবী ছিলো ভীষণ শান্তিপূর্ণ। যোদ্ধা সমাজের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত সেই শান্তিপূর্ণ সমাজে আত্মরক্ষার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিলো না।
বর্তমান বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলো, যেমন, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদী ধর্ম -প্রত্যেকটিতেই পুরুষ প্রতিনিধির আবির্ভাবের কথা বলা হয়। এখানে নারী প্রতিনিধির কোনো অস্তিত্ব নেই। সুদূর অতীতেই কেবলমাত্র নারীকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও পবিত্রতার প্রতীক বলে মানা হতো। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ও প্রাচীন শিল্পগুলোতে মাতৃদেবী বা ধরিত্রীদেবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
প্রাচীন গ্রীক পুরাণের আদিম মাতৃদেবী গায়া
আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস অনুযায়ী, পৃথিবী নিজেই ছিলো ঐশ্বরিক মাতৃদেবীর মূর্ত প্রতীক। প্রকৃতির সাথে পৃথিবীর আদি বাসিন্দাদের ছিলো এক অদ্ভূত গভীর সম্পর্ক। তারা পৃথিবীর বুকে মানুষ, গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীকে একটি চক্রাকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবির্ভূত হতে দেখেছেন। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষ পৃথিবীমাতার কোলেই জন্ম নেয়, বংশবৃদ্ধি করে, একটি নির্দিষ্ট সময় পর মৃত্যুবরণ করে এবং পুনর্জন্ম লাভের মাধ্যমে আবারো ফিরে আসে। তারা বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীমাতাই সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন; আকাশ, পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্র, গাছপালা, প্রাণী সমস্ত কিছুই তার ওপর নির্ভরশীল; তিনিই তার সন্তানদের লালন-পালন ও নিরাময় করেন; তিনিই সকল সৃষ্টি ও ধ্বংসের জন্য দায়ী। তারা নিজেদেরকে এবং সমস্ত কিছুকে পৃথিবীমাতার সন্তান জ্ঞান করতেন।
ধরিত্রীকে দেবীমাতা হিসেবে উল্লেখ করার সর্বপ্রথম নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকে বিখ্যাত গ্রীক কবি হেসিওডের ‘থিওগনি’ কবিতায়। হেসিওড চমৎকারভাবে মহাবিশ্বের সূচনার গল্পটি তুলে ধরেছেন তার কবিতায়, যখন দৈব শক্তি বলতে শুধুমাত্র তিনটি ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে নির্দেশ করা হতো- ক্যাওস, ইরোস এবং গায়া। গ্রীক বিশ্বাস অনুযায়ী, তারাই ছিলেন আদিম ত্রয়ী। আর তাদের মধ্যে প্রকৃতির পুনঃর্জাগরণকারী এবং সমস্ত দেবতা ও জীবের জন্মদানকারী মাতা ছিলেন গায়া বা ধরিত্রীদেবী।
উইলেনডর্ফে পাওয়া প্রাচীন দেবীমূর্তি ভেনাস
বিশ শতকের শুরুর দিকে অস্ট্রিয়ার উইলেনডর্ফ গ্রামে খননকাজের মাধ্যমে পাওয়া একটি চার ইঞ্চি সাইজের নারীমূর্তিই ‘উইলেনডর্ফের ভেনাস’ বলে পরিচিত। ধারণা করা হয়, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম নারীমূর্তিগুলোর মধ্যে একটি এবং সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০০ থেকে ২০০০০ সালের মাঝামাঝি প্যালিওলিথিক পিরিয়ড বা পুরাতন প্রস্তর যুগে তৈরী। মূর্তিটির বিশাল বড় স্তন ও পাকস্থলী দৃশ্যমান, কিন্তু প্যালিওলিথিক ভেনাস মূর্তিগুলোর মতোই চেহারাবিহীন। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার উইটকম্বের মতে, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই চেহারার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে শারীরিক গঠনের ওপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা মূলত উর্বরতা, গর্ভাবস্থা, জন্মদান ও সন্তান লালন-পালনের প্রতীক। নিঃসন্দেহে প্রাচীন সময়ে পুরুষের তুলনায় নারীর গুরুত্ব অত্যাধিক ছিলো। কারণ প্যালিওলিথিক সময়ের মূর্তিগুলোর মাঝে নারীমূর্তিগুলোর তুলনায় পুরুষ মূর্তির সংখ্যা অতি নগণ্য।
মাল্টার ঘুমন্ত নারীমূর্তি
কাদামাটির তৈরী এই মূর্তিটি নিওলিথিক পিরিয়ড বা নব্য প্রস্তর যুগে তৈরী হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মাল্টার একটি নিওলিথিক সমাধিস্থল ‘হাই সাফলিয়েনি হাইপোজিয়াম’-এ এই মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছে। একেবারে সাধারণ ভঙ্গিতে কাত হয়ে ঘুমন্ত একটি নারীমূর্তি এটি। যেহেতু এটি একটি সমাধিস্থলে পাওয়া গিয়েছে, তাই ধারণা করা যেতেই পারে যে এটি মৃত্যু কিংবা চিরস্থায়ী নিদ্রার নির্দেশক। তবে মাল্টার প্রাচীন শিল্পকলাগুলো আমাদেরকে ধারণা দেয় যে, তাদের সংস্কৃতিতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন নারী বা দেবীকে উপাসনা করা হতো। সে সময়টাতে পশু শিকারের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে তারা কৃষিকাজের মুখাপেক্ষিতা অর্জন করেছিলো। কিন্তু নতুন জীবনে উদ্ভূত সমস্যাগুলো পুরুষদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলো। নারীরা যেহেতু সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে সক্ষম ছিলেন, তাই চাষাবাস, জীবন ও সৃষ্টির ধারণা নারীর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো। ঠিক একই কারণে পৃথিবীকে নারীর প্রতিরূপ মানা হয় এবং ঐশ্বরিক দেবী জ্ঞান করে তাকে উপাসনা করা হয়।
সাইক্লাডিক যুগের দৈব নারীমূর্তি
অন্যান্য মূর্তি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ধরনের নারীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে, যেগুলোকে সাইক্লাডিক যুগে তৈরী বলে ধারণা করা হয়। মূর্তিগুলো মার্বেল পাথরে তৈরী। নারীমূর্তিগুলোর নগ্ন দেহ, স্তন ও যোনিপথের স্পষ্টতা স্বাভাবিকভাবেই সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা বা উর্বরতার নির্দেশক। আর দৃশ্যমান পেট গর্ভাবস্থার নির্দেশক। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, সাইপ্রাস –এসব জায়গার মতো এই মূর্তিগুলোর দুই হাত বুকের নিচে বৈশিষ্ট্যমূলক ভঙ্গিমায় একত্রে ভাঁজ করে রাখা, যাকে আমরা সাধারণত ‘ফোল্ডিং হ্যান্ডস’ বলে থাকি। এটি মূলত একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতীকী ধর্মীয় মূর্তির অবয়বকে বোঝায়। সে সময়ের ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও দেবী উপাসনার নমুনা পাওয়া যায়। প্রাচীন সময়ে জন্মদানের সময় ও তার পরে মা এবং শিশু মৃত্যুর উচ্চহার বিদ্যমান ছিলো। তাই ধারণা করা হয়, এই সাইক্লাডিক মূর্তিগুলোকে ঐশ্বরিক সুরক্ষার জন্য দেবীকে আহ্বানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
প্রাচীন ক্রীট দ্বীপের সর্পদেবী
সমস্ত সৃষ্টিজগতের মা এবং ধরিত্রীদেবীর ধারণাটি ক্রীট দ্বীপে প্রাচীন মিনোয়ান সভ্যতায়ও প্রচলিত ছিলো। মিনোয়ান সভ্যতার সর্পদেবীর মূর্তিগুলো খ্রিস্টপূর্ব ১৬ শতকে তৈরী। দুই হাতে সাপ ধরে থাকা সর্পদেবীর উন্মুক্ত স্তন যৌনতা কিংবা সন্তানের জন্য দুধ সরবরাহের প্রতীক হতে পারে। তার হাতের সাপগুলো পুনর্জন্ম, পাতাল জগৎ, কিংবা রোগ নিরাময় ক্ষমতার ধারণার সাথে যুক্ত। মিনোয়ান সভ্যতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই সর্পদেবীর মূর্তি। স্থানীয় কৃষি উৎপাদনের একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্রীটের সমাজব্যবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে, মিনোয়ান ধর্ম ও সংস্কৃতিতে নারীর একটি প্রভাবশালী ভূমিকা বিদ্যমান ছিলো।
মিশরীয় দেবী ‘মাআত’
প্রাচীন মিশরের শিল্প ও সংস্কৃতিতে মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। সেই সাথে মিশরীয়রা নারীর স্বরূপ দেবীরও উপাসনা করতো। কারণ একমাত্র নারীরই উর্বরতা, ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ এবং বুকের দুধ সরবরাহের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মিশরীয় দেবী ‘মাআত’ সত্য, ন্যায়বিচার, ভারসাম্য রক্ষা ও মহাজাগতিক সম্প্রীতির প্রতিনিধিত্ব করে। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতেন, দেবী ‘মাআত’ এর সহায়তায় মহাবিশ্ব এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। দেবী ‘মাআত’ মাথায় উটপাখির পালক পরিধান করেন। তার উপাসনাকারীরা বিশ্বাস করতেন, পরকালে তার পরিহিত সাদা পালকটির সাথে আরেক পাল্লায় মৃত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড ওজন করা হবে এবং হৃৎপিণ্ডের ওজন পালকের তুলনায় হালকা হলেই কেবল সেই ব্যক্তি ওসিরিসের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের অনুমতি পাবেন।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার রাতের রাণী
দুটি সিংহের পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই নারী মূর্তিটির পাখিসদৃশ পা ও নখর এবং দুটি পাখা স্বাভাবিকভাবেই কোনো দৈব ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। নগ্ন এই নারী মূর্তিটির মাথায় রয়েছে একটি মুকুট, গলায় নেকলেস এবং উভয় হাতের কব্জিতে ব্রেসলেট। দুই হাত দিয়েই দেবী ধরে রেখেছেন দুটি রড এবং দুটি রিং। আসল ভাস্কর্যটিতে মূর্তিটি লাল রঙে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডটি কালো রঙে চিত্রিত করা হয়েছিলো।
পন্ডিতদের মতে, এই নারী মূর্তিটি প্রাচীন মেসোপটেমীয় দেবী লিলিথ, কিংবা ইরেশকিগাল, কিংবা ইশতার; যাদেরকে অ্যাসিরীয়, ফিনিশিয়ান এবং ব্যবিলনীয়রা পূজা করতো। মূর্তিটি উর্বরতা, যৌন প্রেম ও নারীত্বের আশীর্বাদের প্রতিনিধিত্ব করবার পাশাপাশি আরও একটি গাঢ় অর্থ বহন করে। আর তা হলো, ঐশ্বরিক নারীত্ব কেবল জীবনের ধারণার সাথেই নয়, যুদ্ধ ও মৃত্যুর সাথেও যুক্ত ছিলো। প্রকৃতিতে যেমন জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্র বিদ্যমান, তেমনটা এই দেব-দেবীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিলো বলে বিশ্বাস করা হতো।
প্রাচীন সাইপ্রাসের হাত উঁচিয়ে রাখা দেবী
পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশ সাইপ্রাসের বিভিন্ন মন্দিরে বিভিন্ন সময় খনন করে পাওয়া যায় এই মূর্তিগুলো। ধারণা করা হয়, স্থানীয় বাসিন্দারা পূজা করতেন এই দেবীর। ক্রীট দ্বীপের বাসিন্দারা সাইপ্রাসে ভূমধ্যসাগরীয় দেবীর ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। ফিনিশিয়ানদের আগমনের পর স্বর্গের রাণী খ্যাত দেবী অ্যাস্টার্টের পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি থেকে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীতে সাইপ্রাসে এই দেবীর পূজা শুরু হয়। এই মূর্তিটির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো, এর হাত ওপরের দিকে তুলে রাখা, খুব সম্ভবত এই ধারণাটি ক্রীটের সংস্কৃতি থেকে প্রভাবিত। কারণ ক্রীটের সর্পদেবীর মূর্তিতেও আমরা দেখতে পাই যে, তার হাত উপরের দিকে তুলে রাখা। এই নারী মূর্তিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। সম্ভবত মূর্তিটি বিশেষ কোনো পূজার জন্য প্রস্তুত কোনো নারী পুরোহিতের রূপে স্বয়ং দেবীর অবতারকে নির্দেশ করে।
রেফারেন্সঃ
- The Divine Feminine: 8 Ancient Forms of the Great Mother Goddess – The Collector.com
- The World Began With Chaos, Eros, and Gaia- advaya.co
- নগ্নতার জন্য ফেসবুকে ঠাঁই নেই ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প কীর্তি’র – zeenews
- The Sleeping Lady: a unique Maltese icon – Artsandculture
- মাল্টা সংস্কৃতি – এনসাইক্লোপিডিয়া
- A Subterranean Neolithic Masterpiece -The Ħal Saflieni Hypogeum
- Aegean Civilizations: The Emergence of European Art