১৮৭০ সাল। মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামের এক উচ্চাভিলাষী জমিদার বাড়িতে আসর বসেছে, আমোদ-ফূর্তির আসর। প্রতিবারের মতো আজও একজন বাইজি এসেছেন, নেচে-গেয়ে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছেন জমিদার বাড়ির পুরুষদের। বাইজি নাচছেন এবং দর্শকরা তার পায়ের কাছে আবির ছুঁড়ে দিচ্ছেন। বাইজির প্রতিটি ছন্দোময় পদক্ষেপের সাথে সেই রঙছটা উড়ে উড়ে এক চমৎকার দৃশ্যের সৃষ্টি করছে। নাচের এই দৃশ্য দেখে শুধু অন্দর ঘরের ব্যক্তিরাই আনন্দ পাচ্ছেন না, আরও একজন দরজার ফাঁক দিয়ে সমস্তটাই দেখছে। লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ দেখা সেই মানুষটি ছিলো একটি চার বছর বয়সী শিশু, তার নাম হীরা। হীরা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে দেখতো সেই নাচ অনুষ্ঠান। যতোই দেখতো, বিস্ময় ও মুগ্ধতা ঘিরে ধরতো তাকে। নিখুঁত অঙ্গ-ভঙ্গিমার মাধ্যমে পরিচালিত নাচ তো কোনো শিল্প থেকে কম কিছু নয়। আর কোনো শিল্পসত্তার প্রকৃত মূল্য দেয়া একজন শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। তাই ছেলেবেলা থেকেই এক সৃষ্টিশীল শিল্পীমন নিয়ে বিলাসবহুল পরিবেশে বেড়ে উঠছিলো হীরা। আমোদই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো না, বিশেষ দিনে বাইজির নাচ পরিবেশন জমিদার বাড়ির সংস্কৃতিরই একটি অংশ ছিলো। তবে নিছক এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছাপ কিছুটা হলেও হীরার জীবনে পড়েছিলো। প্রতিফলনও হয়েছিলো ভীষণভাবে। তাই তো জমিদার বংশের ছোট্ট হীরাই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, হীরালাল সেন।
হীরালাল সেনের জন্ম ১৮৬৬ সালে, মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে। তিনি ছিলেন ঢাকার নামজাদা উকিল চন্দ্রমোহন সেনের ছেলে। হ্যাঁ, এই বাংলাদেশের আলো-বাতাসেই জন্ম নেন এই কিংবদন্তী। মিছে মিছে বলছি না, তাকে কিংবদন্তী বলার যথেষ্ট কারণ কিন্তু রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বাংলার চলচ্চিত্র সর্বপ্রথম হীরালাল সেনের হাত ধরেই এক ধ্রুব আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলো। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকমের সৃষ্টিশীল ও সময়ের চেয়ে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে ছিলো তার প্রতিটি কাজ।
হীরালাল সেন তার জীবনের শুরুটা করেছিলেন ফটোগ্রাফি দিয়ে। ব্রিটিশ ভারতের সেই সময়ে তিনি ছিলেন দেশের এক নম্বর ফটোগ্রাফার। ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ কোম্পানির একটি ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু এতো ছোট পরিসরে আবদ্ধ থাকা তার গন্তব্য ছিলো না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব যার মস্তিষ্কের নিয়মিত ফলাফল, তার যেনো ফটোগ্রাফিতে পরিপূর্ণ শান্তি মিলছিলো না। সময়মতো ঠিকই নিজেকে তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। সিনেমার জগতে তিনি যেনো এক নতুন হীরালালকে পেয়েছিলেন।
একে তো জমিদার বাড়ির সন্তান, টাকা-পয়সার অভাব ছিলো না, তার উপর মা বিধুমুখীর বাধভাঙ্গা স্নেহ হীরালালের স্বপ্নপূরণের পক্ষে এক শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হলো। তবে শুধু মা-ই নন, হীরালাল তার প্রত্যেক প্রয়োজনে সবসময় পরিবারকে পাশে পেয়েছেন। ঢাকার এক সময়ের নামকরা আইনজীবী দাদা গোকুলকৃষ্ণের চোখের মণি ছিলেন তিনি। পরিবার থেকে সবসময়ই তিনি পেয়েছেন আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা। তাই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সফলভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।
প্রথমে ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে বায়োস্কোপের পথে হাঁটতে শুরু করলেন হীরালাল এবং এক পর্যায়ে সিনেমেটোগ্রাফির নেশা পেয়ে বসলো তাকে। হীরালাল বুঝতে পারলেন, তার জায়গা এখানেই। সিনেমেটোগ্রাফির জন্য প্রয়োজন বিশেষ ক্যামেরা আর লাইটিং। মাকে জানালেন যে ক্যামেরা কেনার জন্য টাকা প্রয়োজন। বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রাণপ্রিয় ছেলেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন মা। কেনা হলো হীরালালের সবচেয়ে প্রিয় ক্যামেরা। কিন্তু লাইটিং এর জন্য তো প্রয়োজন বিদ্যুৎ। সেই আমলে তো আর বিদ্যুৎ দুধভাত ছিলো না। তখনকার ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতার ইডেন গার্ডেন এবং হাওড়া স্টেশন ছাড়া কোথাও বিদ্যুৎ সহজলভ্য ছিলো না। কিন্তু হীরালাল সেন দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি অজস্র কাঠিন্য পার করে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করলেন এবং প্রথমবারের মতো উপমহাদেশে চালু হলো সিনেমেটোগ্রাফিতে বিদ্যুতের ব্যবহার।
১৮৯৮ সাল। দুই ভাই মতিলাল ও দেবকীলাল এবং ভাগ্নে কুমারশঙ্কর গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে হীরালাল শুরু করলেন ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ এর যাত্রা। আস্তে আস্তে ডালপালা মেলে ছোট্ট সেই উদ্যোগ বিরাট সম্পদে পরিণত হতে লাগলো। হবেই বা না কেনো? হীরালাল সেনের সৃজনশীলতা তো সেই যুগের বিস্ময় থেকে কম কিছু ছিলো না। সেইবার প্রথমবারের মতো চলমান চিত্র প্রদর্শনের প্রচলন করলেন হীরালাল।
১৯০৩ সাল। প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখার স্বাদ পেলো এই দেশের মানুষ, নাম ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’। ১৯০৫ সাল। হীরালাল তৈরী করলেন প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘গ্র্যান্ড প্যারিওটিক ফিল্ম’। ১৯১২ সাল। প্রথম নিষিদ্ধঘোষিত রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘দ্য ভিজিট ফিল্ম’-ও তিনিই বানিয়েছিলেন। এমনকি বিজ্ঞাপন তৈরীতে সিনেমার ব্যবহারও হীরালাল সেনই সর্বপ্রথম করেছিলেন।
হীরালাল সেনের জীবনের এক স্বর্ণ অধ্যায় ছিলো স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে বিয়ে। হেমাঙ্গিনী দেবী নিজেও বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে। কিন্তু স্বামীর ভালো ও খারাপ উভয় সময়েই বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন তিনি। এমনকি তখনকার সুখ্যাত চিত্রনায়িকা কুসুমকুমারীর সঙ্গে প্রণয় সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পরও হীরালালকে ছেড়ে যান নি তিনি। হেমাঙ্গিনী যেমন স্বর্গসুখ নিয়ে হীরালালের জীবনে এসেছিলেন, তেমনি কুসুমকুমারীও এসেছিলেন ধ্বংস নিয়ে। হীরালালের জীবনে কুসুমকুমারীর প্রবেশ আস্তে আস্তে তার সব প্রিয়জনকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যদিও ভুলগুলো হীরালালেরই বেশি ছিলো। এক সময়ের বিত্তশালী হীরালাল সেন সর্বস্ব হারিয়ে শেষ সময়ে পুড়েছিলেন দারিদ্র্যের আগুনে। দারিদ্র্য তার উপর এতোটাই জেঁকে বসেছিলো যে, শখের ক্যামেরাটিও বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। তার এমন দুঃসময়েও সমস্ত কিছু নীরবে সহ্য করে থেকে গিয়েছেন শুধু একজন, স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবী।
কোলকাতায় অনেকটা সময় পার করলেও হীরালাল সেনের জন্ম ও বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই দেশের সঙ্গে। মানিকগঞ্জের সরিষাক্ষেতগুলো যেনো আজও দৌড়ে বেড়ানো দুরন্ত এক হীরার গল্প বলে আমাদের। স্নিগ্ধ কোনো চাঁদনি রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মেতে থাকতো সে। ঢাকার জিন্দবাহার লেনের গলিটা যেনো আজও হীরালালের সুরে কথা বলে। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ এর সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন হীরালাল সেনের ফুপাতো ভাই। হীরালালের মেয়ে প্রতিভা সেনের দেবরের পুত্রবধূই ছিলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন।
প্রচণ্ড রকমের সৃজনশীল ও প্রতিভাবান হীরালাল সেন একাধিক নতুন ধারণার সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু এই উপমহাদেশ ও এই বাংলার মানুষ তাকে মনে রাখে নি। হয়তো কিছুটা ভাগ্যের নির্মমতা, কিছুটা তার নিজের ভুল, কিংবা হয়তো প্রিয়জনের হৃদয়ের নীরব রক্তক্ষরণই প্রকৃতির প্রতিশোধ হয়ে হানা দিয়েছিলো তার শেষ জীবনে এবং মুছে দিয়েছিলো তার সমস্ত কীর্তি। হ্যাঁ, ১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মরণব্যাধি ক্যান্সার ও দারিদ্র্যের রোষানলে দীর্ঘকাল ভুগে মৃত্যু হয় হীরালাল সেনের, আর তার মৃত্যুর দুই দিন আগেই তার ভাই মতিলাল সেনের রায়বাগান স্ট্রীটের বাড়িতে দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হীরালালের তোলা ছবির সম্পূর্ণ মজুদ।
কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে হীরালাল সেনের জীবনের ভুলগুলো তাকে দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেয় নি। জায়গা দেয় নি ইতিহাসও। উপমহাদেশের গর্ব, বাংলার গর্ব, এই দেশের গর্ব যে ব্যক্তিটি, তাকে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে কখনোই স্মরণ করা হয় না। আসলে কি এতোটা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তিনি? নাকি সাধারণ মানুষই তার প্রকৃত বিবেকবোধ হারিয়ে অকৃতজ্ঞতার আসনে ইচ্ছেকৃতভাবে বসে আছে? বাস্তবতা যা-ই হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো সৃষ্টিকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি সেই সৃষ্টির পেছনের স্রষ্টাকেও অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। হীরালাল সেনের অবদান এক চিরন্তন সত্য, একমাত্র সঠিক ইতিহাসের অবতারণা ও গভীর কৃতজ্ঞতাবোধই এমন হারিয়ে যাওয়া রত্নের স্বরূপ আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে পারবে।
রেফারেন্সঃ