আকবর বাঙলা দখল করে বুঝলেন, উত্তর ভারতে তার সাম্রাজ্য যে রায়তওয়ারি পদ্ধতিতে সরাসরি রায়তদের থেকে রাজস্ব আদায় করছে, দিল্লি থেকে হাজার ক্রোশ দূরে বংলার ভৌগোলিক এলাকার তাকে সেই পদ্ধতিতে রাজস্ব আদয়ের সুযোগ করে দেবে না। আকবর দেখেছেন বাংলায় তার বাবার হালত কী হয়েছিল। বাংলাতেই হুমায়ুনকে শের শাহের কাছে হেরে কয়েক দশক ভারতের বাইরে থাকতে হয়েছে। মুঘল এমনকী বাংলার নবাবদের বাহিনীতে ইরানী তুরানী ছাড়া ছিল বিশাল সংখ্যায় আফগানি সেনা, যাদের নিয়ে আলিবর্দিকে ভুগতে হয়েছে। মুঘল রণনীতি বিষয়ক ঐতিহাসিক হস গোমানস (Jos Gommans, Mughal Warfare: Indian Frontiers and High Roads to Empire, 1500 1700) লিখছেন আফগানদের মৌলিক চরিত্র ছিল বিশ্বাসঘাতকতার, চোখের নিমেষে আনুগত্য বদল করত। তিনি শের শাহের অনানুগত্যের উদাহরণ দিচ্ছেন চৌসার যুদ্ধে, যেখানে শের শাহ হুমায়ুনের সঙ্গে তৈরি শর্ত ভেঙ্গে পাল্টা আক্রমণ করেন আফগান নায়ক শের শাহ সুরী বিখ্যাত, প্রতিভাধর লুণ্ঠনযোদ্ধা, যিনি মনে করতেন যুদ্ধে যে ‘কোনও রকমের ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, ছলন এবং কৌশল কখনোই অপরাধ নয় এবং…তিনি জানতেন কীভাবে যুদ্ধ শুরু এবং যুদ্ধ শেষের রাশ টেনে ধরতে হয়। গোমানস বলছেন চতুর এই রণনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ, চৌসা (১৫৩৯) যুদ্ধ যেখানে শের শাহ আর হুমায়ুন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার অঙ্গীকার করেছিলেনঃ আফগানেরা কর্মনাশা নদীর হাটুজল তীর ফাঁকা করে দেবে, যাতে হুমায়ুন পিছিয়ে যাওয়ার আগে আফগানদের বিরুদ্ধে আক্রমণের দু’তিন ধাপের যুদ্ধ যুদ্ধ মহড়া দেখাবেন। হুমায়ুনকে হতচকিত করে, শেষ মুহূর্তে শের শাহ পরিকল্পনা বদল করে, সমস্ত চুক্তি ভঙ্গ করে, অসতর্ক মুঘল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে, আফগানেরা যুদ্ধ জিতল। বাংলার ইতিহাস আফগানদের চুক্তিভঙ্গের ইতিহাস। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার ফল আলিবর্দি খান হাড়ে হাড়ে টের পাবেন বর্গি আক্রমনেরভ সময়ে।

মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বো‌চ্চ সীমানা, (১৭০৭ সালে)

শুধু হস গোমানস নয় মুনিস ফারুখি ‘প্রিন্সেস অব মুঘল এম্পায়ার’ অথবা এলিসন ব্যাঙ্কস ফিন্ডলি ‘নুর জাহান’ বইতে মনে করিয়ে দিচ্ছেন মুঘলদের কাছে বাংলা ছিল ‘বুলগাখানা’। বুদ্ধিমন্ত রাজা আকবর ইতিহাসে আফগানদের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বুঝতে পারলেন বিদ্রোহের আঁতুড় ঘর বাংলায় পাঠানো উচ্চপদস্থ আমলারা সুযোগ পেলেই বিদ্রোহী হয়ে কেন্দ্র থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি সুবাদারের সঙ্গে আরেকজন কাছাকাছি স্তরের আরেকজন আমলা দেওয়ানকে পাঠালেন যাতে তারা পরস্পরের ওপরে নজরদারি করতে পারে। যদিও মুঘল আমলা অভিজাত প্রত্যেকেই বাংলায় এসে নবাবি কালে নিজামত থেকে নানানভাবে বিশাল অর্থ দুয়ে নিয়ে গিয়েছে, অথচ কেউই প্রাথমিকভাবে বাংলায় আসতে খুব একটা উৎসাহী ছিল না। বাংলায় চাকরিকে তারা নেসেসারি এভিল ভাবত। আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গির বিরোধী মানসিংহ কিন্তু নতুন পাদশার রোষ থেকে বাঁচতে বাংলার নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে আসেন। আওরঙ্গজেবের চাপে শাহ সুজা কিন্তু বাংলাতেই আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।

অথচ বাংলা বহুকাল ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা বাণিজ্যর ভরকেন্দ্রে অবস্থান করছিল। মুঘলেরা যেহেতু ব্যবসা বাণিজ্যকে বেশ গুরুত্ব দিত এবং নিজেরা সওদা ও ইখাসে অংশ গ্রহণ করত, তাই তাদের কাছে দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের সঙ্গে উত্তর ভারত এবং সেখান থেকে তুর্কি বা মধ্য এশিয়ায় ভারতের কারগরি পণ্য রপ্তানির সূত্রের ঠিক মাঝখানে বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে জুড়ে রাখা খুব জরুরি কাজ ছিল। বাংলা এবং বাংলার কারিগরি বহুকাল ধরে মুঘল রাজত্বে সমাদর অর্জন করেছিল। আকবরের বিদেশী নারীদের জেনানা মহলের নাম ছিল বাঙালি জেনানা [হারেম]। তা ছাড়া বাংলা থেকে যাওয়া বিশাল অঙ্কের রাজস্বের হাতছানি তো ছিলই।

মোগল হেরেমের রমণী

অর্থমন্ত্রী টোডরমল্লকে দিয়ে বাংলার রাজস্ব আদায়ের সূত্র তৈরি করে তিনি সেই আদায়ের দায় সঁপেদিলেন জমিদারদের স্থানীয় আদায় কাঠামো নির্ভর করে। আকবর যে সুবা সমীক্ষা করালেন তার বর্ণনা রয়েছে আবুল ফজল প্রণীত ‘আইনিআকবরি’তে। চট্টগ্রাম থেকে গড়হি বা তেলিয়াগড়ি – গঙ্গা এবং রাজমহল পাহাড়ের মিলনস্থলে – আজকের কাটিহার। মোট দূরত্ব চারশ ক্রোশ। উত্তরে পাহাড় থেকে দক্ষিণের মন্দারণ সরকার[আজকের গড় মন্দারণ হুগলিতে] অবদি একশ ক্রোশ, পরে ওডিসা যুক্ত হলে আরও তেতাল্লিশ ক্রোশ এবং চওড়টা ২৩ ক্রোশ জুড়ল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যু দিন ১৭০৭এ ৩ মার্চ থেকে পলাশীর দিন ২৩ জুন ১৭৫৭ অবদি, বাংলা যদিও নামেমাত্র মুঘল সুবা রইল, কিন্তু বাস্তবিক অঞ্চলটা স্বশাসিত এলাকা হয়ে উঠেছিল। সম্রাটের অভয় হস্ত মাথায় নিয়ে বাংলায় এসে বেশ কিছু পরিবর্তন আনলেন অওরঙ্গজেবের প্রিয় জাফর খান, মুর্শিদকুলি খান। আকবরি আমলে সুবা বন্দোবস্ত হওয়ার দিন থেকে বাংলা সুবায় যে নিজামত তৈরি হল, অর্থাৎ নিজাম বা নবাবের দপ্তর তৈরি হল, সেখনে দিল্লি থেকে কাজ পাওয়া বহু নিজাম সরাসরি বাংলায় থেকে প্রশাসন চালাতেন না, অধিকাংশই বাংলায় সহকারী রেখে দিল্লি/আগরার/লাহোরের দরবারে সময় কাটাতেন। এই প্রবণতা চলেছে আজিমুশ্বানের সময় ১৭১৭ অবদি। মুঘল রাজত্বে দেখা গিয়েছে বহু সুবার পরিচালনার দায় এক ব্যক্তির ওপর অর্ষাত। স্বভাবিকভাবে সেই গুরুত্বপূর্ণ অভিজাতকে সহকারী রেখে কাজ চালাতে হত। এই সহকারীরা নিজামত চালাতেন, এবং এদের বলা হত নবাব। এদের কর্ম্পদ্ধতির ওপর কেন্দ্রিয় সরকারের কার্যত নিয়ন্ত্রণের লাগাম পরানো থাকত না, কারণ অধিকাংশ ছিলেন সম্রটের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। প্রশাসনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল নিজামত দপ্তর থেকে দেওয়ানি প্রশাসনে বিভেদ। আগেই বলেছি আকবরি আমলের তত্ত্ব ছিল, উচ্চতম দুই ক্ষমতবান দপ্তরকে প্রতিযোগী করতে পারলে তাদের উভয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ সহজ হয় এবং প্রশাসনিক নির্দেশগুলি পালন করানোর কাজও অনেকটা সুগম হয়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর এক দশক পর, নিজামি আর দেওয়নির বিভেদ ঘুচে গেল। নিজামতে পদ পাওয়ার শর্ত হল সম্রাটকে নিয়মিত ঠিক সময়ে রাজস্ব দিয়ে যাওয়া। নিজামেরা মুঘল দরবারে উকিল রেখে নজরানা এবং পেশকাশ পাঠিয়ে নিজেদের কাজকর্ম করিয়ে নিত। অনেক সময় সুবায় নিজাম পদ পেতেও দরবারি উকিলেরা সাহায্য করতেন। সুবায় নিজামেরা ছিলেন সর্বময় কর্তা, আকবরের সময় তাদের সিপাহসালার বলা হত, ১৭ শতক থেকে সুবাদার। নাজিম এবং সুবাদার পদ নামটি যৌথভাবে বহুকাল ব্যবহার হয়েছে। সিপাহসালার হলেন সেনা বাহিনীর প্রধান। মুঘল আমলে তারা একের পর এক এলাকা দখল করতেন এবং সেই এলাকায় তারাই মূলত প্রশাসন চালাতেন। নাজিম শব্দের অর্থ হল, প্রদেশের সুরক্ষা এবং আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করা প্রধান আমলা। আদতে নিজাম বা নায়েব হলেন সুবায় কাজ করা সহকারী আমলা। প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজ দেখা ছাড়াও সুবার নিরাপত্তা এবং ফৌজদারি মামলার দায়িত্বে থাকতেন তিনি। যে রাজকীয় ফরমানে তিনি নিযুক্ত হতেন তার নাম ছিল ফরমানইসাবাতি। এছাড়াও সম্রাট তাকে অন্যান্য খেতাব এবং উপাধিতে ভূষিত করতেন।

মুঘল সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ সৈনিক।

সুবাদারের কাজ ছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সুরক্ষা দপ্তর এবং গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ করা। কৃষি কাজ বিস্তৃতির জন্যে সেচ, রাস্তা, সরাই, বাগান/উদ্যান, চিকিৎসা কেন্দ্র, কুঁয়ো, হ্রদ ইত্যাদি তৈরি করা। তার দায়ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখা এবং শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটানো। সেনার নানা কাজে নজরদারি করা। যে কোনও ঘটনা মুঘল দরবারে জানাতে হত। সাধারণ মানুষের নানান বিষয় নিয়ে তাকে সতর্ক থাকতে হত। ঘোড়ায় চড়া এবং বন্দুকবাজী/তীরান্দাজী জানতে হত। সময়ে সময়ে তিনি এক দল দূরদর্শী এবং দক্ষ মানুষের সাহায্য নিতেন। সে কোনও সময় বদলীর আদেশের জন্যে তাকে তৈরি থাকতে হত। সুবায় যে কোনও আমলা/কর্মচারীর কাজ ছিল তাকে যে কোনও উপায়ে সাহায্য কর। সুবাদার এবং সম্রাটের মধ্যে পার্থক্য ছিল, দরবারে সুবাদার চৌকিতে বসার অনুমতি পেতেন না(সূত্র আহকমইআলমগিরি, যদুনাথ সরকার, অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ)। অধীনস্থ থেকে সিজদা এবং কুর্ণিশ নেওয়র অধিকারী তিনি ছিলেন না। শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা ছিল।

দেওয়ান ছিলেন সুবাদারের অধীন। বিভিন্ন সময়ে দেওয়ান শব্দের ভিন্ন ভিন্ন মানে করা হয়েছে। এক সময়ে জমিদারি ব্যবস্থপনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাকে দেওয়ান বলা হত। সুবার দেওয়ান সম্রাটের হাসবুলহুকুমের মার্ফৎ নিযুক্ত হতেন। তার নিয়োগপত্রে কেন্দ্রিয় দেওয়ান ব উজিরউলমুলকের ছাপ্পা থাকতে হত। কিন্তু তিনি যেহেতু সরাসরি কেন্দ্রিয় দরবার দ্বারা নিযুক্ত, তাই বাস্তবে সুবার নাজিম বা সুবাদারের অধীনস্থ থাকতেন না। আওরঙ্গজেবের সময় সুবার দেওয়ান আর সুবাদারের দায়িত্ব আলাদা করে ন্যস্ত ছিল। সালিমুল্লাহ বলছেন সুবার রাজস্ব আদায়ের দায় ছিল দেওয়ানের। সুবার নাজিম অথবা সুবাদারের কাজ ছিল শান্তি শৃংখলা রক্ষা এবং অবাধ্য, বিশ্বাসঘাতক এবং বিদ্রোহীকে দমন। নিজামতের সঙ্গে জুড়ে থাকা জায়গির এবং ব্যক্তিগত মনসব ব্যতীত রাজস্ব আদায়ে নাজিমের কোনও ভূমিকা ছিল না। সুবায় নাজিম, দেওয়ান এবং অন্যান্য শীর্ষ আমলার প্রশাসনিক কাজকর্মের নীতি এবং দায়িত্ব ইত্যাদি নির্ণীত হত সম্রাট কর্তৃক বছরের পর বছর দস্তুরউলআমল নির্ভর করে এবং এই নীতি উল্লঙ্ঘন করা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না।

বাংলায় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ অবদি বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ চলেছে – তার একটা বড় কারন মুঘলদের কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ ঢিলে হওয়া, মারাঠা সহ অন্যান্য শক্তির উত্থান। এসব এবং এরকম হাজারো চলক আমাদের বাংলার নিজামত এবং জমিদারির ওপর প্রভূত প্রভাব ফেলেছিল। শুরুতে জমিদারদের ভূমিকা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তারা ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রের হয়ে রাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু যত সময় যেতে থাকে, রাজনীতি যত জটিল হতে থাকে, তাদের ভূমিকাও সেই মত পরিবর্তিত হতে থাকে। নতুন দায়, নতুন কাজের শর্তও পরিবর্তিত রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে থাকে। বহু শক্তিশালী জমিদার কিছুটা হলেও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের নানান কার্যকর হাতিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হন। ক্ষুব্ধ এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জমিদারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনতে খেলাত দেওয়ার মত নানান রকম মুঘল সম্মানের হাতিয়ার ব্যবহার করতে থাকে বাংলা নিজামত রাষ্ট্র। বহু জমিদার নবাবের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। পলাশীর পর ক্ষমতার দিকে অগ্রসর হওয়া এবং পরে ক্ষমতা পাওয়া ইংরেজদেরও চ্যালেঞ্জ জানায়। কিন্তু কোনওভাবেই জমিদারেরা সার্বিকভাবে বাংলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। মুর্শিদকুলি খানের সময় রাজস্ব আনাদায় এবং বকেয়া ফেলার অভিযোগে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়।

মুর্শিদকুলি খান 

তা সত্ত্বেও উপনিবেশপূর্ব বাংলার বিকাশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপূর্ব সময়ে জমিদারদের সক্রিয় ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। গ্রাম বাংলার প্রশাসনিক, আর্থিক এবং সামাজিক জীবনে ছিয়াত্তরের আগের সময়ের জমিদারেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলার গানে, গল্পে, ছড়ায় এমন কী মন্দিরের গায়ে খোদাই করা নানান ভাষ্কর্যে জমিদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমরা দেখতে পাই। তবে বাংলার ইতিহাস চর্চায় কয়েকটি হতে গোনা কাজ বাদ দিলে জমিদারদের নিয়ে খুব বেশি কাজ দেখি না। শিরিন আখতারের ‘সুবে বাংলার জমিদার ও জমিদারি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি আমাদের বাংলার জমিদারির বহু অনালোচ্য বিষয় এবং তথ্যের দিকে নজর ফেরাতে সাহায্য করে।

জমিদারদের থেকে রাজস্ব আদায় খুব পুরোনো ধরণের পদ্ধতি ছিল বলছেন জন শোর তার মিনিটে। একই কথা পাই ফারমিঙ্গারের ফিফথ রিপোর্টে। ভুইয়াঁ, ভূমি, চৌধুরী, মণ্ডল যা পরে মুকদ্দম হয়েছে, তারা রাষ্ট্র নির্ধারিত রাজস্ব তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করত।

আমরা বড় জমিদার এবং তাদের বিভাগ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছি। কিন্তু ছোট জমিদারদের চরিত্র না বুঝলে বাংলার পলাশীপূর্ব রাজনীতি এবং সমাজ বিশ্লেষণ অধিকাংশই অধরা থেকে যাবে। বাংলা জুড়ে অসংখ্য ছোট জমিদার ছড়িয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেউ তরফ, তাপ্পা বা শুধু একটা গ্রামের অধিকারী ছিলেন। আরও ছোট হিসেবে ধরলে নিজের জমি চাষ করা ক্ষুদ্র রায়তও এক অর্থে জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ফারুখশিয়রের সময় মধ্যসত্ত্বভোগী জমিদার মার্ফত রাজস্ব আদায় করা স্থায়ী নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। পতিত জমি উদ্ধার করে আরও বেশি চাষের এলাকা বাড়ানো হয়। রাজস্ববিহীন মদদইমাশ জমি অবলম্বন করে বিশাল সংখ্যক জমিদারের উদ্ভব ঘটে। যদিও ছোট জমিদারের আদতে রাজস্বদায়ী রায়ত হিসেবেই চিহ্নিত হতেন। হান্টার ‘মিসলেনিয়াস রেকর্ডস’এ বলছেন দুই বা তিন প্রজন্ম ধরে যারা নির্দিষ্ট জমি থেকে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে তাদের তিনি ছোট জমিদার আখ্যা দিচ্ছেন। তাদের অধিকার এবং অবস্থান নির্ভর করে কীভাবে তারা রাজস্ব চুক্তি প্রতিপালন করছে তার ওপর। এই জমিদারিগুলির অধিকার মূলত বংশানুক্রমিকতা হিসেবে স্বীকৃত হত। বড় বা মাঝারি জমিদারদের মত ছোট জমিদারেরা সরকারী সনদ নির্ভর ছিল না। তাই সুবার প্রশাসন এবং সমাজেও ছোট জমিদারদের ভূমিকা খুবই নগণ্য ছিল। এরা মূলত স্থানীয় জমিদারাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।

বাংলায় তালুকদেরা দুধরণের হত হুজুরি এবং মাজকুড়ি বা শিকাকামি – হুজুরিরা সরাসরি সরকারকে রাজস্ব দিত, আর মাজকুড়িরা দিত জমিদার মার্ফত। ছোট জমিদারেরা তালুকদারদের থেকে আলাদা গণ্য হত। অন্যভাবে বললে বহু তালুকদার এক সময় জমিদারে রূপান্তরিত হয়েছে। যখন রায়রায়াঁ বা কানুনগো লক্ষ্মীনারায়্ণ বলেন জমিদারদের অধিকার অনেকটা তালুদারের সঙ্গে তুলনীয় তখন জমিদার বলতে আমরা অবশ্যই ছোট জমিদারদের কথা বুঝব।

জমিদারি এবং গোষ্ঠীবদ্ধতা

জমিদারি এবং স্বাভাবিকভাবে পরগণার উদ্ভব ঘটত জাতি এবং গোষ্ঠী নির্ভরতায়। ভারতের কৃষি এবং কারিগরি পেশাদারদের বসতির ইতিহাস হল গোষ্ঠীবদ্ধতা। এই বসতিকে পরে প্রশাসনিক ভাষায় গ্রাম, মৌজা বা ডিহি হিসেবে চিহ্নিত হয়। পাঞ্জাবে এবং উত্তরপ্রদেশে গোষ্ঠীবদ্ধভাবেই ভাইচারা নির্ভর করে মানুষ চাষ জমি নির্ধারণ করে বসবাস করত। পরগণা যেহেতু কয়েকটি গ্রাম সমষ্টি, তাই সম্ভবত গ্রামগুলিতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আধিপত্য বজায় থেকেছে। বাডেন-পাওয়েল এই ধারণাটা বাংলার জন্যেও সত্য বলেছেন। ‘আ শর্ট একাউন্ট অব দ্য ল্যন্ড রেভিনিউ এন্ড ইট এডমিনিস্ট্রেশন ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’য় দিনাজপু্র জেলা সম্বন্ধে তিনি বলছেন, এই জেলার উদ্ভবের কোনও কারনই তিনি খুঁজে পান নি। শিরিন আখতার বলছেন এই জেলার কিছু কিছু এলাকা নির্দিষ্ট আদিবাসী বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছিল (৯৬ পাত)। ভারতে যেখানে সমাজ ধর্মীয়, গোষ্ঠী বা জাতির নিরিখে চিহ্নিত হত, সেখানে পরগণা নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী বা জনসমষ্টিকে নিয়ে গড়ে উঠবে, এটা তো বলাই বাহুল্য। গ্রামে আমরা জাতি গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন বসত পাড়া স্বাভাবিকভাবে দেখে থকি। শহরেও এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কলকাতা গড়ে উঠেছিল নানান পেশাদার কারিগরের পাড়া নিয়ে, যে নামগুলো আজও টিকে আছে শহর কলকাতার দেহে।

একই সূত্রে জমিদারেরাও এক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জাতি বা গোষ্ঠী থেকে উদ্ভুত হত। বীরভূমের রাজা ছিলেন পাঠান গোষ্ঠীর। তাদের নেতৃত্বে বিশাল চাষী গোষ্ঠী খারিজি বাহিনীর অংশ হয়ে ওঠে। রাজশাহীতে ছিল ব্রাহ্মণ জমিদার। বাখরগঞ্জে কায়স্থ এবং নমশূদ্ররা গুরুত্বপূর্ণ জাতি ছিল। চন্দ্রদ্বীপের জমিদার বা রাজা ছিলেন কায়স্থ। মেদিনীপুরে সদগোপেরা বিশাল সংখ্যায় ছিল। বাংলায় একমাত্র সদগোপ জমিদারি ছিল মেদিনীপু্রেই। বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজারা ছিলেন স্থনীয় আদিবাসী গোষ্ঠীর। এ নিয়ে বিশদে বর্তমান খণ্ডে কাজ করার সুযোগ নেই। উল্লেখ করে গেলাম। ভবিষ্যতে বিশদে কাজ করার ইচ্ছে আছে।

(চলবে)