ঐ তো, চলে এসেছে ছেলেটা। জানতাম, সে আসবেই। প্রতি বছরই তো আসে। প্রতি বছর আরবী মহররম মাসের ১০ তারিখে গলায় ছোট কাঁটা চিহ্নের ছেলেটিকে দেখা যায় তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু অদ্ভূতভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ছেলেটির মাথা মুন্ডিত ও লম্বা টিকিযুক্ত এবং গলায়ও রয়েছে উপবীত। ঠিক যেনো একজন ব্রাহ্মণ হিন্দু। হিসেব মেলানো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ছে। কেনোই বা একজন ব্রাহ্মণ আসবে শিয়া মুসলমানদের শোক অনুষ্ঠান তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে? কেনোই বা তার চোখ-মুখও কারবালার প্রান্তরে ঘটে যাওয়া নির্মমতার শোকে হবে মূহ্যমান? কি-ই বা তার গলার কাঁটা চিহ্নের রহস্য?
৬৮০ খ্রিস্টপরবর্তী সাল। ১০ মহররম, ৬১ হিজরি সাল। কারবালার প্রান্তর। বিষমাখানো তীরের আঘাতে রক্তাক্ত ইমাম হোসেনের বুকের উপর বসে প্রাণপণে তার মাথা কেটে নেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত অত্যাচারী এজিদের পাঠানো ঘাতক শিমার বিন যিল জিশান। পিপাসা, আঘাতের ব্যথা ও প্রিয়জন হারানোর শোক সহ্য করতে না পারা ইমাম হোসেন শিমারের কাজকে সহজ করে দেয়ার জন্য বললেন, “ভাই, অনর্থক কষ্ট দিও না। এই জায়গায় আমার মাতামহ চুমু দিতেন। তার স্পর্শের জায়গায় আঘাত করে তুমি আমায় মারতে পারবে না, অন্য জায়গায় আঘাত করো”। অবশেষে বুকের ওপর থেকে নেমে ইমাম হোসেনের পিঠের ওপর চড়ে বসে তীরবিদ্ধ জায়গায় আঘাত করতে লাগলো ঘাতক শিমার। লুটিয়ে পড়লেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসেন। নির্মমতার লাল রঙে রঞ্জিত হলো কারবালার প্রান্তর। ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ রবে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। অশ্রুর বন্যা বয়ে গেলো হোসেনের প্রিয়জনদের চোখে। আর এই প্রিয়জনদের মাঝে কয়েকজন ছিলেন মুন্ডিত মাথায় লম্বা টিকিযুক্ত ও গলায় উপবীত পরিহিত। অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, বিস্ময়কর হলেও সত্যি, সেই আকাশ-বাতাস ভারী করা ‘হায় হোসেন’ ধ্বনি কয়েকজন ব্রাহ্মণের কন্ঠেও উচ্চারিত হয়েছিলো। নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী সেই কারবালার প্রান্তরে হোসেনের জন্য তাদের চোখ থেকেও অশ্রু ঝরেছিলো, ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য।
হিন্দু ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় হচ্ছে ‘মোহেল ব্রাহ্মণ’ বা ‘মুহিয়াল ব্রাহ্মণ’। এই ‘মুহিয়াল’ সম্প্রদায়ের মধ্যে আবার রয়েছে সাতটি গোত্র, যার মধ্যে একটি গোত্র হলো ‘দত্ত’। ‘দত্ত’-রা সাধারণত যোদ্ধা হয়ে থাকে। সাধারণত পাঞ্জাব ও লাহোরেই এরা আগে বাস করতো। এমনই একজন ‘দত্ত ব্রাহ্মণ’ হলেন পাঞ্জাবের রাহাব সিং দত্ত। ব্যবসার কাজে আরবের সাথে তার সবসময়ই যোগাযোগ ছিলো। থাকবেই বা না কেনো? সিল্ক রোডের মাধ্যমে তো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিলো তখন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, যার সূত্রপাত হয়েছিলো প্রথম দারিয়ুসের রয়্যাল রোডের মাধ্যমে। গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষে প্রবেশই এই রয়্যাল রোডের সীমাকে বিভিন্ন পথে বিস্তৃত করে নিয়ে এসেছিলো এই উপমহাদেশ পর্যন্ত। যতো সময় গিয়েছে ততোই বিস্তৃত এই রয়্যাল রোড আরো বিস্তৃত হয়ে কালের পরিক্রমায় সিল্ক রোডের রূপ নিয়েছিলো। সুতরাং সিল্ক রোডের কল্যাণে ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বাণিজ্যের জন্য তো যেতোই, এমনকি বাণিজ্যের সুবাদে শুধু যাওয়া-আসাতেই এই সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিলো না, অনেকে বাণিজ্য করতে গিয়ে সে সব জায়গায় স্থায়ীভাবে থেকেও যেতো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সৈন্যও বিনিময় হতো প্রচুর। তা ছাড়া মক্কা তো ছিলো একই সাথে একটি তীর্থস্থান ও ব্যবসাকেন্দ্র। সুতরাং পৃথিবীর বহু প্রান্ত থেকে এখানে মানুষের আসা-যাওয়া ছিলো। এমন অনেক সাহাবীর কথা জানা যায়, যারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে প্রায়ই দূর-দূরান্ত থেকে দেখা করতে যেতেন।
রাহাব সিং দত্তের মনে ছিলো ভীষণ কষ্ট, নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। সন্তানহীনতা তাকে পাগলপ্রায় করে তুলেছিলো। আরবের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে একদিন এক পয়গম্বরের কথা জানতে পারেন তিনি, যিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে সবার মনের আশা পূরণ হয়। সেই পয়গম্বর ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। রাহাব সিং দত্ত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে দেখা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার সাথে দেখা করতে পারার আগেই মৃত্যুবরণ করেন মুহাম্মদ (সাঃ)। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে বিমর্ষ হয়ে পড়েন রাহাব সিং দত্ত। অবশেষে এক দিন একজন সাহাবী তাকে নবীজি (সাঃ) এর ছোট নাতি ইমাম হোসেন (রাঃ) এর সাথে দেখা করবার পরামর্শ দেন। ইমাম হোসেনের সাথে দেখা করার পর তার বিনয়ী আচরণ ও ন্যায়পরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে যান রাহাব সিং দত্ত। কিন্তু হোসেন তাকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে জানান যে, তার ভাগ্যে কোনো সন্তান নেই। এই কথা শুনে কষ্টে পাগলপ্রায় রাহাব দত্ত বার বার হোসেনকে অনুরোধ করেন আল্লাহর কাছে তার জন্য প্রার্থনা করতে। এরপর হোসেন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং রাহাব সিং দত্তকে সাত জন ছেলে সন্তানের সুখবর দেন। ১৯১১ সালে টি.পি. রাসেল স্ট্র্যাসির লেখা ‘হিস্টোরি অফ দ্য মুহিয়ালসঃ দ্য মিলিট্যান্ট ব্রাহ্মণ ক্ল্যান অফ ইন্ডিয়া’ বইটি থেকে রাহাব সিং দত্তের সাত জন ছেলের নামও জানা গিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে রাহাব সিং দত্তের মনে সচ্চরিত্রবান ইমাম হোসেনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার জন্ম নেয়।
এদিকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর থেকেই ইসলামী সাম্রাজ্যের ক্ষমতা নিয়ে শুরু হয় নানান বিশৃঙ্খলা। মুহাম্মদ (সাঃ) এর মূল লক্ষ্য ছিলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সাম্যের দিকেই ছিলো তার সর্বোচ্চ মনোযোগ। অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন যেনো কারো অতিরিক্ত সম্পদও না থাকে, আবার কেউ যেনো নিঃস্বও না হয়। তিনি কোনো উত্তরাধিকারী তৈরীর পক্ষপাতি ছিলেন না, যোগ্যতাবলে যে কেউ যেনো নিজের আসন অর্জন করে নিতে পারে সেই ব্যবস্থাই করে গিয়েছিলেন তিনি। আর এ জন্যই এক শ্রেণীর মানুষের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তার বংশের কাউকে প্রথম খলিফা নির্বাচন করেন নি তিনি। প্রথম তিন খলিফাই ছিলেন ভিন্ন বংশীয়। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর মানুষের বহুমতের বিশৃঙ্খলার সুযোগে তার বিরোধীদের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে থাকে গভীর ষড়যন্ত্র, মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগে ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো মদীনার মোনাওয়ারা। প্রথম তিন খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত ওসমান (রাঃ) এর আমলেও এই রাজধানীর পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর সময় রাজধানী ইরাকের কুফায় স্থানান্তরিত হয়। তৃতীয় খলিফা ওসমান (রাঃ) এর বংশধর মুয়াবিয়া (রাঃ) উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন সিরিয়ার দামেস্কে। মুয়াবিয়া (রাঃ) প্রথমে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরোধী ছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে সুসম্পর্ক রেখেছিলেন। আলী (রাঃ) এর মৃত্যুর পর খিলাফত নিয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) এর বড় ছেলে ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর বড় নাতি ইমাম হাসান (রাঃ) এর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। কারণ মুসলমানদের একটি অংশ মনে করতো, কেবলমাত্র হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কোনো বংশধরই খলিফা হওয়ার যোগ্য। তবে ইমাম হাসান এক পর্যায়ে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সাথে একটি সন্ধিতে আসেন এই শর্তে যে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ছোট ভাই হোসেনের কাছে যেনো ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। অন্য দিকে মুয়াবিয়ার ছেলে এজিদ ছিলো ভীষণ অত্যাচারী ও একরোখা চরিত্রের অধিকারী। বাবার মৃত্যুর পর তার কথার কোনো সম্মান না রেখে নিজেই ক্ষমতা হাতে নেয় সে (মদীনা, সিরিয়া ও কুফার) এবং নবীজি (সাঃ) এর বংশকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কৌশলে ইমাম হাসানকে বিষপানে মেরে ফেলার জন্য লেলিয়ে দেয় হাসানেরই এক স্ত্রীকে। এরপর ইমাম হোসেনের চাচাতো ভাই ইমাম মুসলিম ইবনে আকিল কুফার পরিস্থিতি বুঝতে গেলে তাকেও হত্যা করা হয়। আর মুসলিম ইবনে আকিলের প্রাথমিক অবস্থায় পাঠানো চিঠি থেকে ইমাম হোসেন যখন জানতে পারলেন যে কুফার জনগণ তার অনুগত হতে চায়, তখন সপরিবারে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু তিনি তখন জানতেন না যে, পথে কারবালার প্রান্তরে এজিদের সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
ইমাম হোসেন যাত্রাপথে দূত মারফত যখন জানতে পারলেন যে, তার চাচাতো ভাইকে হত্যা করা হয়েছে, তখন তার সঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই সেখান থেকে ফিরে গেলেন। অবশেষে কারবালার প্রান্তরে শুরু হলো নিষ্ঠুর এক যুদ্ধ। যুদ্ধ না বলে একে গণহত্যা বললেও তেমন ভুল হবে না। কারণ হোসেনরা তো ছিলেন নিরস্ত্র, পিপাসার্ত ও ক্ষুধায় কাতর। এমন অবস্থায় হোসেনের বিপদের খবর শুনে সুদূর পাঞ্জাব থেকে ছুটে এলেন রাহাব সিং দত্ত, সঙ্গে নিয়ে এলেন নিজের সাত ছেলেকে। একের পর এক হোসেনের সব সাথীরা প্রাণ দিতে লাগলেন এজিদের সেনাবাহিনীর হাতে। অবশেষে এক পর্যায়ে আশুরার দিন (আশুরা মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, কারণ এই দিনে ইসলামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে) অর্থাৎ মহররম মাসের ১০ তারিখ ইমাম হোসেনকেও গলা কেটে হত্যা করা হলো। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না রাহাব দত্তসহ ইমাম হোসেনের সব সঙ্গীরা। প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তারা শত্রুর ওপর। কিন্তু হায়! একে একে রাহাব দত্তের সাত ছেলেও প্রাণ হারালেন এজিদ সেনার হাতে।
নিজের সব সন্তানদের হারিয়ে শোকে আচ্ছন্ন রাহাব সিং দত্ত কিন্তু তবুও ইমাম হোসেনের মৃত্যুর বেদনা ভুলে যান নি। ভারতবর্ষে ফিরে নিজের এলাকার মানুষদেরকে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেনের নির্মম পরিণতির কাহিনী শোনান তিনি এবং তা শুনে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তাদের দু চোখ। তাদের মনে হতে থাকে যেনো বহু দিনের চেনা আপন কাউকে হারিয়েছেন তারা। অধিকাংশরাই গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন হোসেনের প্রতি। সেই থেকে গড়ে ওঠে এক নতুন সম্প্রদায়, হোসেনের স্মৃতি ধরে রাখবার জন্য তারা নিজেদের নাম দেন ‘হুসেইনি ব্রাহ্মণ’। এদেরকে অনেকে ‘দত্ত ব্রাহ্মণ’ বলেও জানে। যুগ যুগ ধরে এই হুসেইনি ব্রাহ্মণরা আশুরার দিন শিয়া মুসলমানদের পাশাপাশি ইমাম হোসেনের জন্য শোক পালন করে আসছেন। হিন্দু কবি চুন্নুলাল দিলজির কবিতায় ইমাম হোসেনকে নিয়ে ৭০ হাজার পঙক্তি লেখা হয়েছে এবং তাতে হিন্দুদের মহররম পালনের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
কথিত আছে, রাহাব সিং দত্ত কারবালা থেকে ইমাম হোসেনের একটি চুল সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন যেটি কাশ্মীরের হযরত বাল মাজারে রয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর নাতি ইমাম হোসেনের প্রতি হুসেইনি ব্রাহ্মণদের কি পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে, তা প্রমাণিত হয় তাদের একটি অবশ্য পালনীয় প্রথার মাধ্যমে। তারা নিজেদের সন্তান জন্মের পর পরই তাদের গলায় একটি ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতো, যা ইমাম হোসেনের নির্মম মৃত্যুর স্মৃতি বহন করে। এমনকি সন্তান জন্মের পর প্রথম অনুষ্ঠানটিও তারা ইমাম হোসেনের নামে পালন করতো। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক নোনিকা দত্ত, যিনি নিজেও একজন হুসেইনি ব্রাহ্মণ, তার কাছ থেকেই এসব তথ্য জানা গিয়েছে।
হুসেইনি ব্রাহ্মণরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও নিজেদের ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে তারা ইসলাম ধর্মের কিছু নিয়ম পালন করে থাকেন। এ যেনো বর্তমানের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের দূষণে এক অদ্ভূত সম্প্রীতিরই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। অথচ এমন সম্প্রীতির পরিচয় বহনকারী হুসেইনি ব্রাহ্মণরা কিন্তু সবকালেই হয়েছে ঘৃণিত ও নিগৃহীত। হিন্দুদের কাছে মুসলমান এবং মুসলমানদের কাছে কাফের ও অমুসলিম বলেই বিবেচিত তারা।
শুরুতে অবশ্য দত্তদের এমন দুর্দশা ছিলো না। ব্রাহ্মণ হলেও হুসেইনি ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হলো মহররম। দেশভাগের আগ পর্যন্ত পাঞ্জাবের অমৃতসরসহ অনেক জায়গায় হুসেইনি ব্রাহ্মণদের কাঁধ না পেলে কখনোই শুরু হতো না তাজিয়া মিছিল। এখনো সেই নিরবচ্ছিন্নতা বজায় আছে কিছু জায়গায়। অন্যান্য অনুষ্ঠানেও তারা পূজা শুরু করতো ইমাম হোসেনের নাম স্মরণ করে। বৈদিক রীতিনীতির সাথে খুব সহজেই এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা গ্রহণ করে নিয়েছিলো ইসলামিক রীতিনীতিকে। আর এই যৌথতায় মিশে গিয়েছিলো ইমাম হোসেনের নাম।
এক সময় এলো ১৯৪৭ সাল। হলো দেশভাগ। দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেলো কাঁটাতারের বেড়া। ব্রিটিশদের প্ররোচনায় সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হলো সমগ্র ভারতবর্ষ। কিন্তু হুসেইনি ব্রাহ্মণরা এর মধ্যেও ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলমান’ বলে সনাক্ত হয় নি। ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে তারা সে সময়। বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অনেক জায়গায় রয়েছে এই হুসেইনি ব্রাহ্মণদের বসবাস।
বহুল পরিচিত ভারতীয় অভিনেতা সুনীল দত্ত ও তার ছেলে সঞ্জয় দত্ত; এ ছাড়াও উর্দু লেখক কাশ্মীরী লাল জাকির, সাবির দত্ত এবং নন্দ কিশোর বিক্রমও কিন্তু হুসেইনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
নাসিরউদ্দীন শাহ এর একটি ডকুমেন্টারিতে তিনি বলেছেন, “সকলের এক সুরে শোকগাঁথা বলার অভ্যাস আমাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এক ভাষায় কবিতা পড়ার ইচ্ছা হারিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানদের জন্য ত্যাগ স্বীকার তো হিন্দুরাও করেছে। ইমাম হোসেনের উপর হওয়া অত্যাচার হিন্দু-মুসলমান সবার মনেই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিলো এবং তারা সবাই-ই এই বেদনায় একত্রে অংশগ্রহণ করতো”।
ধর্মপরিচয় যা-ই হোক, হুসেইনি ব্রাহ্মণরা ছিলেন কিন্তু এই উপমহাদেশেরই। আর উপমহাদেশের চিরাচরিত বহুত্ববাদের সংস্কৃতিকে কিন্তু পরম যত্নে শুধু তারাই আগলে রেখেছেন। না, হিন্দু বা মুসলমানদের ঘৃণা ও কটু কথায় তার লজ্জিত নয়, বরং তারা এখনও গর্ব করে নিজেদেরকে ‘হুসেইনি ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচয় দেয়।
ভীষণ কষ্ট হয়, যখন এমন অদ্ভূত সম্প্রীতিগুলোর হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে হয়। ভীষণ কষ্ট হয়, যখন বর্তমানের সাম্প্রদায়িক দূষণ দেখে এটা নিশ্চিত হতে হয় যে সাদা চামড়ার অহংকারে আচ্ছন্ন ব্রিটিশরা সারা জীবন কালো চামড়ার ভারতীয়দের দাবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে প্রচন্ডভাবে সফল। ভীষণ কষ্ট হয়, যখন মাঠে নেমে সরাসরি কাজ করার বদলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নামমাত্র প্রতিবাদমুখর মানুষগুলোকে প্রশ্ন করতে শুনি, “মন্দির কেনো ভেঙেছো?”, “মসজিদ কেনো ভেঙেছো?” একমাত্র শেকড়ে পৌঁছেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। ইসলামের মূলধারার সাম্য ও গণতন্ত্র হারিয়ে যাচ্ছে এজিদদের মতো স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্যই। সুতরাং ইসলাম ধর্মকে সরাসরি দোষারোপ করে কোনো সমস্যার সমধানে পৌঁছানো যাবে না। সমাধান পেতে হলে সনাক্ত করতে হবে তাদেরকে, যাদের জন্য আজকের এই অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ঢালের মতো সামনে দাঁড়িয়ে রক্ষা করতে হবে একে অপরকে, ফিরিয়ে আনতে হবে মূল আদর্শকে।