অখন্ড ভারতবর্ষ। এক শান্তির ভূমি, সম্প্রীতির ভূমি। এতো বৈচিত্র্য, এতো সংস্কৃতি, এতো সম্প্রদায় মনে হয় না পৃথিবীর আর কোথাও আছে। এখানে মানুষে মানুষে অদ্ভূত মৈত্রী, প্রগাঢ় বন্ধন। কখনো নিজেদের শক্তিতে, আবার কখনো অন্যের অধীনে শাসিত হয়েছে এই ভারতবর্ষ। হয়তো দানা বেঁধে উঠেছে ভয়, আশঙ্কা কিংবা বিদ্রোহ। হয়তো আগুনও জ্বলেছে ঘরে ঘরে। এর পরেও কোনো কালেই এই ভারতবর্ষের মানুষ অসহায়ত্বকে এতো কাছ থেকে অনুভব করে নি। তবে এক দিন সব বদলে গেলো, পাল্টে গেলো মানুষের জীবনের অর্থ, প্রচন্ড বিষধর সাপের মতোন মানুষের নিয়তিকে ছোবল মেরে চলে গেলো দিনটি। এবার অসহায়ত্বকে টের পেলো মানুষ, কিছুটা জোর করেই তাদেরকে আলিঙ্গন করে নিলো অসহায়ত্ব। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জীবনে প্রাণগ্রাসী ঘূর্ণিঝড়ের মতো এলো ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস।
বোঝা যায় নি এপ্রিল মাসেও, যে, ভাগ হতে চলেছে মানুষের স্বপ্নগুলোও। হ্যাঁ, দেশভাগের কথা বলছি। আসলে তো শুধু দেশ ভাগ হয় নি, দেশের সাথে জুড়ে থাকা সমস্ত কিছুই তো ভাগ হয়েছিলো। মানুষের অনুভূতিগুলোও তো তার বাইরে নয়। সে এক অস্থির অসহনীয় পরিস্থিতি! খুলনা, মুর্শিদাবাদ, সিলেটসহ বহু অঞ্চলের মানুষ হয়েছিলো বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারছিলো না কোন পতাকা উড়বে তাদের মাথার ওপর –ভারতের, নাকি পাকিস্তানের।
উপমহাদেশকে ভাগ করার মতো জটিল কাজটিও ন্যস্ত করা হয়েছিলো এমন একজনের ওপর, যার না ছিলো এখানকার মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে কোনো ধারণা, আর না ছিলো কার্টোগ্রাফির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিচারক সিরিল র্যাডক্লিফ। তার আঁকা বাউন্ডারিগুলো কোটি কোটি মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো। কতোশত শিশু, বৃদ্ধ যে নিঃসঙ্গ হয়েছিলো, কতো মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছিলো, কতো মানুষ যে হারিয়েছিলো তাদের প্রিয়জনকে, তার হিসেব করা সম্ভব নয়। চিরচেনা পথ-প্রান্তর ছেড়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো জায়গায় নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়া তো আর সামান্য কোনো ব্যাপার নয়, আর মানসিক পরিস্থিতির কথা আমলে নেয়ার কথা তো কেউ ভাবেই নি কখনো। দুঃখী মানুষগুলোর পেছনে পড়ে রইলো শুধুমাত্র ধূসর স্মৃতি।
তবে এই দেশভাগ কিন্তু মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার ছিলো না। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো উপমহাদেশের সম্পদ বন্টন। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্র যে গঠিত হবে, সেই পরিকল্পনাটি কার্যকর করা হয় ১৯৪৭ সালের ৩ জুন। প্রতিটি ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে গিয়েছে যে দুই পক্ষের নেতা-কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করারও খুব একটা সময় পান নি। ‘চট মাংনি পট বিয়ে’-র মতো ঘোষণা পাওয়ার সাথে সাথেই আভ্যন্তরীণ সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারার কাজে লেগে যেতে হয়েছিলো সবাইকে।
প্রথমে ভৌগোলিক অংশ ভাগ করা হলো এবং জাতীয় সীমানা নির্ধারণের সাথে সাথে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা দিলেন যে, খুব দ্রুতই পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হতে যাচ্ছে। কিন্তু এ তো শুধু ভূ-খন্ড ভাগ নয়, আরো অনেক কিছু ভাগ হতে হবে তার সাথে। ঘোষণা হলো, আভ্যন্তরীণ সম্পদগুলোকে দুটো দেশের জনগণের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হবে যে, কোনটা কোন দেশ পাবে এবং কে কতোটুকু পাবে। সিদ্ধান্ত হলো, চার ভাগ পাবে ভারত, আর এক ভাগ পাবে পাকিস্তান। অর্থাৎ, ভারতের জন্য ৮০ ভাগ, আর পাকিস্তানের জন্য ২০ ভাগ বরাদ্দ রেখে আভ্যন্তরীণ সম্পদগুলো ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
নগদ অর্থ, ঋণ এবং আর্থিক মজুদগুলো, যেমন, সোনার বার ভাগ করা সহজ ছিলো। প্রতি পাঁচটি সোনার বারের ভেতর চারটি ভারতকে এবং একটি পাকিস্তানকে দেয়া যাবে। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জটা এসে দাড়াঁলো তখন; যখন আসবাবপত্র, বই, অফিসের জিনিসপত্র প্রভৃতি সবই ভাগ করতে হবে। কোনটা কোন দিকে যাবে, কয়টা করে এবং কিভাবে যাবে সেটা নিয়ে দেখা দিলো ভীষণ সমস্যা। এই সম্পদগুলো ভাগ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। শুরু হয়ে গেলো তুমুল বাক-বিতন্ডা। সরকারি অফিসের ক্ষেত্রে দেখা গেলো, ভারত থেকে পাকিস্তানে শুধু টেবিল পাঠানো হয়েছে, কিন্তু বসার জন্য কোনো চেয়ার দেয়া হয় নি। পুলিশের বাদ্য যন্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে ঘটেছিলো হাস্যকর ঘটনা। দেখা গিয়েছে যে, ড্রাম রয়ে গেছে ভারতে, আর বাশিঁ পাকিস্তানে চলে গেছে। ব্যাপারটা এমন যেনো পাকিস্তান থেকে বাশিঁ বাজলে ভারতে ড্রাম বাজিয়ে সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করবে।
মদ ভাগের ক্ষেত্রে ভারতের বেশ সুবিধা হয়েছিলো। যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম দেশ এবং অ্যালকোহল সেবনের বিরুদ্ধে অবস্থান করছিলো, তাই মদের ভাগটা ভারতই পেয়েছিলো। আর পাকিস্তানকে অ্যালকোহলের পরিবর্তে নগদ ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
এখন আসা যাক বই এর কথায়। অখণ্ড ভারতবর্ষে তো রয়েছে বিপুল সংখ্যক বই। এগুলোও তো ভাগ করতে হবে। কিন্তু বই ভাগ করতে গিয়ে দেখা গেলো, লাইব্রেরিয়ানরা কেমন যেনো আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন হলো যে, সবাই নিজের দেশেই বেশি ভালো বইগুলো রেখে দিতে চায়। এজন্য ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’, ‘ব্রিটানিকা’ এর মতো বইগুলো দুটো দেশের মধ্যে ভাগ করতে যেয়ে সেটগুলোকে একদম ভেঙ্গে ফেলা হলো। A থেকে K এন্ট্রিগুলো এক দেশকে এবং বাকিগুলো আরেক দেশকে দেয়া হলো। ফলে কোনো দেশই আর বইটি আরাম করে ব্যবহার করতে পারলো না। কোনো কোনো বই এর তো শুধু একটি মাত্র কপি ছিলো। সেটা কোন দেশ নিবে, এই প্রশ্নেও হয়েছিলো তুমুল বিতর্ক। ধর্মীয় বইগুলো ভাগ করা সহজ ছিলো। যেমন, ইসলাম ধর্মের বইগুলো দেয়া হলো পাকিস্তানকে, আর হিন্দু ধর্মের বইগুলো রেখে দেয়া হলো ভারতে। কিন্তু দেখা গেলো ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বইয়ের ভাগ করতে গিয়ে চুলাচুলির অবস্থায় চলে যাচ্ছে মানুষ। দুই দল কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ঝগড়াঝাটিতে।
কেউ কেউ তো তাজমহলকেও ভেঙ্গে কিছু অংশ পাকিস্তানে পাঠানোর দাবি করেছিলো। এর পেছনে তাদের যুক্তি ছিলো, এটা মুসলমান শাসকের তৈরী বলে পাকিস্তানেই হওয়া উচিত এর অবস্থান। নোটের ক্ষেত্রে ব্যাপার ছিলো ভিন্ন। যেহেতু পাকিস্তানের ছাপাখানা ছিলো না, তাই পাকিস্তান কিছু দিন ঐ অবিভক্ত ভারতের মুদ্রাকেই পাকিস্তান সরকারের স্ট্যাম্প দিয়ে চিহ্নিত করে ব্যবহার করেছিলো, যতো দিন না তাদের নিজেদের প্রেস তৈরী হয়।
বহু জিনিসপত্র ভাগের ক্ষেত্রে যখন দুই দলের কেউই কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলো না এবং অনেক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হচ্ছিলো, তখন তারা কয়েন টেস্ট করে ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। এভাবে কয়েন টেস্টের মাধ্যমে ঘোড়ার টানা গাড়ি, সরকারি যানবাহনসহ বেশ কিছু সম্পদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিলো। নানা রকম কৌশল অবলম্বনে দুই দেশের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করার ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু তারপরেও তর্কাতর্কি, এমনকি ভয়ঙ্কর মারামারির অবস্থাও সৃষ্টি হয়েছিলো। এমনও ঘটেছে যে, কেউ কিছু জিনিস লুকিয়ে রেখে দিয়েছে, নিজেদের পক্ষে একটু বেশি রাখবার জন্য। দেশ ভাগের জন্য এমন পাগলামি মনে হয় না পৃথিবীতে আর কোথাও হয়েছে। তাই তো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল বিবাহ বিচ্ছেদ এই উপমহাদেশ ভাগকেই বলা হয়।