১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর। রাত তখন প্রায় ১২টা। চারদিক নিস্তব্ধ। ভোপালের একটি কীটনাশক কারখানার কর্মীদের হঠাৎ করেই চোখ জ্বলতে শুরু করে। যেহেতু কারখানাটিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে নানান ধরনের কীটনাশক দ্রব্যাদি তৈরী করা হতো, তাই কর্মীরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন কোনো জায়গা থেকে কোনো ধরনের গ্যাস লিক করেছে কি না।

খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেলো, ছোট একটি জায়গা থেকে হালকা হলুদ রঙের একটি গ্যাস নির্গত হচ্ছে। একজন কর্মী ছুটে গিয়ে সুপারভাইজারকে ঘটনাটি বর্ণনা করবার পরও তিনি বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে চা পানের জন্য বের হয়ে গেলেন। চা বিরতির ৪৫ মিনিট পর সবাই যখন ফেরত আসলেন, বিপদ তখন ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। কারখানার ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথে তাদের চোখ আরও প্রকটভাবে জ্বলতে শুরু করলো এবং সেই সাথে যুক্ত হলো প্রচণ্ড কাশি। কর্মীদের সবার শরীর ভীষণ খারাপ হতে শুরু করে। আর এরপরই একদম ব্ল্যাকআউট! পরবর্তী দুই ঘণ্টার মধ্যে সেই বিষাক্ত গ্যাস কারখানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায়।

ভোপালের গ্যাস বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে আচ্ছন্ন গ্রাম

বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন লেকের শহর ভোপাল, ছবি: The leaflet

ভোপালের জয়প্রকাশ অঞ্চলটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। প্রায় নয় লাখ লোকের বাস ছিলো সেখানে। মানুষগুলো মোটামুটিভাবে দরিদ্র। শিল্প কারখানা তৈরীর জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত নয় জায়গাটি। তবুও এমন জায়গাকেই নির্বাচন করা হয়েছিলো এই ধরনের শিল্প কারখানা তৈরীর জন্য। আর এরই ফলস্বরূপ, ঐ এলাকার মানুষের জীবনে রাতের আঁধারে ঘটে যায় এক বিভীষিকাময় ঘটনা। ডিসেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সেই রাতে জয়প্রকাশ অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষগুলো যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, স্বপ্ন দেখছিলো নতুন জীবনের নকশা তৈরীর, ঠিক সে সময় কারখানার আশেপাশের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত প্রতিটি ঘরে মৃত্যুর দূত হিসেবে সন্তর্পণে প্রবেশ করেছিলো সেই বিষাক্ত গ্যাস।

ভোপালের গ্যাস বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানের ট্যাঙ্ক

এই সেই ট্যাঙ্ক ই৬১০ যেখান থেকে বের হয়ে আসে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট, ছবি: Wikimedia

খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষগুলো সারাদিনের কর্ম-ক্লান্তির পর অবসন্ন শরীর নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন। তাই প্রথমে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসা মৃদু-গন্ধযুক্ত গ্যাসটির উপস্থিতি বুঝতেই পারেন নি তারা। অল্পক্ষণের মধ্যেই গন্ধের তীব্রতা বাড়লে ঘুম ভেঙ্গে যায় তাদের। গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাবে কেউ মাটিতে শুয়ে পড়েন, কারো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়, কারো শুরু হয় বমি, কারো মুখ থেকে বের হয় ফেনা। গ্যাসের তীব্রতা একটা সময় এতো বেড়ে গিয়েছিলো যে, মানুষগুলোর চোখ খুলে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছিলো। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষগুলো নিজেদের সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। সেই দিশেহারা ছোটাছুটির মধ্যেও পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এক পর্যায়ে বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে পুরো জয়প্রকাশ অঞ্চল বিষাক্ত হয়ে উঠলে মানুষগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়তে শুরু করেন।

পর দিন ভোপালের জয়প্রকাশ অঞ্চলে যখন ভোরের আলো উঁকি দিলো, তখন হাজার হাজার মানুষ মৃত লাশ হয়ে পড়ে ছিলো। আর যারা তখনও মারা যান নি, তারা কেবলই মৃত্যুপথযাত্রী। পরবর্তী ৭২ ঘন্টায় আরো আট হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এবং আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি ছাড়িয়ে যায়। বাকিদের কেউ কেউ বিকলাঙ্গতা, আবার কেউ কেউ স্থায়ী শারীরিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকেন। অনেক অন্তঃসত্ত্বা রমণীর তো গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটে যায়। আর যাদের গর্ভপাত ঘটে না, তারা পরবর্তীতে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেন। শুধু মানুষ নয়; গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তু -সমস্ত কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে।

মৃত্যুরজনীর নির্মম কাহিনী

ভোপালের দুঃস্বপ্ন, ছবি: Roar Bangla

দুর্ঘটনার পর ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে আসেন ভোপালের সেই কারখানাটির চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসন। মূলত আমেরিকার একটি কোম্পানির সাথে ভারতীয় একটি কোম্পানি যৌথভাবে এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলো। কারখানা পরিদর্শনকালেই অ্যান্ডারসনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তাকে জামিন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তিনি আর কখনোই ভারতে ফেরত আসেন নি। ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের  বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তার কোনো শাস্তিও হয় নি। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেন অ্যান্ডারসন।

ভারত সরকার পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩৩০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে কোম্পানিটির কাছে। মাত্র ৪৭ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করে ফেলেছিলো ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানিটি। ২০১০ সালে ভারতের আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত রায়ে কয়েকজন কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে জরিমানা করা হয় এবং ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ভোপালের সেই গ্যাস-ট্র্যাজেডির প্রভাব আজও ঐ অঞ্চলের মানুষ বহন করে চলেছেন। এতো বছর পর আজও ঐ এলাকার মানুষ নানা রকম অসুখ-বিসুখে ভুগছেন। আজও মানসিক ত্রুটিসম্পন্ন শিশুর জন্ম হচ্ছে সেখানে। জন্মগত পঙ্গুত্বের হার বেড়ে গিয়েছে ব্যাপক হারে। শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ তো হচ্ছেই না, সেই সাথে ঐ অঞ্চলের মানুষদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে অনেক।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিষাক্ত সেই গ্যাসটি শুধুমাত্র মাটির উপরিভাগকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে নি, ভূগর্ভস্থ মাটি এবং পানিও বিষাক্ত হয়ে আছে সেই গ্যাসের প্রভাবে।

ভোপালের গ্যাস প্লান্টের বর্তমান অবস্থা

গ্যাস লিক হওয়ার কয়েক দশক পরে ২০০৮ সালে MIC প্ল্যান্টের অংশ

এই সমস্ত হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী আমাদেরই দুর্বল ব্যবস্থাপনা। পুরনো সরঞ্জাম, কর্তৃপক্ষের অসদাচরণ, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, নিরাপত্তার ঘাটতি -সমস্ত কিছু মিলেই এই তৃতীয় বিশ্বে হরহামেশা ঘটে চলেছে প্রাণঘাতী নানান দুর্ঘটনা।

তথ্য ঋণঃপ্রথম আলো