১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকাতে এক আইনত জাতিগত বিভাজন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ব্রিটিশ শাসিত সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয়, বর্ণসংকর এই চার বর্ণে ভাগ করে। যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল দেশের মোট জনসংখ্যার ২০% এর কম শ্বেতাঙ্গ। স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন জীবিকা, শিক্ষা, বাসস্থানের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা ছিল না। এই ঘৃণ্য জাতিগত বিভাজন ‘আপার্টহাইট’ বা ‘বর্ণবাদী’ শব্দের উৎপত্তি হয় ১৯৩০ সালে এবং ১৯৪০-এর শুরু থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক স্লোগানে এই শব্দটি ব্যবহার শুরু করে। যদিও শব্দটির সাথে জড়িত বর্ণ বিভাজন নীতির উদ্ভব আরও আগে, ১৬৫২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতে শ্বেতাঙ্গ মানুষের বসতি স্থাপন শুরুর সাথে সাথে এই নীতির প্রচলন শুরু হয়।
রিপাব্লিক অফ সাউথ আফ্রিকা বা দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকা মহাদেশের একদম দক্ষিণে অবস্থিত বহু ভাষা, বহু জাতির একটি দেশ। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশটি থেকে প্রাপ্ত বহু প্রচীন জীবাশ্ম ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষের উৎপত্তি এই দেশ থেকেই। ‘খৈস্যান’ ভাষায় কথা বলা ‘স্যান’ ও ‘খৈখৈ’ প্রজাতির মানুষরা এখানে প্রথম বসতি তৈরী করে। পরবর্তীতে উত্তর থেকে আসা যাযাবর ‘বান্তু’রা খৈস্যানদের আরও দক্ষিণে ঠেলে দিয়ে ঐ জায়গা দখল করতে থাকে। ১৪০০ শতাব্দীতে সমুদ্রযাত্রা শুরু হলে, পর্তুগীজরা এই দেশ আবিষ্কারের প্রায় ১৫০ বছর পর ১৬৫২ সালে খাদ্যশস্য, মসলা, নানা খনিজ সম্পদের লোভে প্রথমে ডাচদের আগমন ঘটে, সাথে সাথে অনান্য ইউরোপীয় দেশ এখানে বসতি গড়ে, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেপটাউন শহর প্রতিষ্ঠা করে। তখন স্থানীয় জোনা, জুলু সম্প্রদায়ের স্থায়ী বাস ছিল এই কেপটাউনে।
খনিজ সম্পদ ও দাস ব্যবসার উদ্দেশ্যে ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশরা কেপটাউন দখল করে এবং স্থায়ীভাবে উপনিবেশ স্থাপন করে। পরবর্তী কয়েক দশকে ব্রিটিশরা পুরো এলাকায় দখল প্রতিষ্ঠা করে এবং আরো পাঁচ হাজার বসতি স্থাপন করে। প্রায় ১২ হাজার ডাচ সহ ইউরোপের অন্য বাসিন্দাদের তারা আফ্রিকার উত্তর ও পূর্ব দিকে বিতাড়িত করে। বিতাড়িত ডাচ ও ইউরোপীয়রা সেখানে গিয়ে ট্রান্সভাল ও অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট প্রতিষ্ঠা করে। স্থানীয় বুয়র’রাও কেপ কলোনি থেকে ব্রিটিশদের চাপে আরো উত্তরাঞ্চলের দিকে চলে যায়। ১৮৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে হীরে ও ১৮৮৪ সালে সোনার হদিস মিলতেই খনিজ সম্পদ দখলে নেওয়ার জন্য স্থানীয়দের সাথে ব্রিটিশদের সংঘাত শুরু হয়। ১৯০২ সালে দ্বিতীয় বুয়ার যুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ব্রিটিশদের কাছে তুমুলভাবে পরাজিত হয়। দ্বিতীয় বুয়ার যুদ্ধের আট বছর পর ১৯১০ সালে ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেয় এবং গঠিত হয় ‘ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকা’।
১৯১২ সাল নাগাদ কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের মধ্যে সংগঠিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। যদিও কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার তখনও ছিল না। শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বারাই এই সংগঠন তৈরী হয়। ১৯১৯ সালে তারা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কিছু সুযোগ সুবিধার দাবীতে ইংল্যাণ্ডে এক ডেপুটেশান পাঠায় কিন্তু তা নাকচ হয়। ১৯১৩-র ‘নেটিভস ল্যান্ড অ্যাক্ট’ আনুযায়ী কৃষ্ণাঙ্গদের জমির মালিকানার উপর অধিকার সঙ্কুচিত হয়, দেশের মাত্র ৭% এলাকায় তার জমির মালিকানা পেত, নতুন জমি ক্রয়-বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা লাগু হয়। অতীতে পাসপত্র আইন চালু ছিল, ওই আইন মোতাবেক, কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় তাদের সাথে পরিচয়সংক্রান্ত নথিপত্র রাখা বাধ্যতামুলক ছিল।
১৯৩০ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় পার্টি আপার্টহাইট বা বর্ণবাদীতার পক্ষে বহুবার সাওয়াল করে। শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় পার্টির আপার্টহাইট বা বর্ণবাদীতার পক্ষে কাগজে কলমে যুক্তি ছিল বিভিন্ন বর্ণগোষ্ঠীর সামগ্রিক ও সাংস্কৃতিক সমউন্নয়ন, কিন্তু আদতে গল্প ছিল ভিন্ন। সামজিকভাবে আপার্টহাইট বা বর্ণবাদীতার জন্য সমস্ত বর্ণের মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপনে বাধ্য হত তাদের উন্নয়নের ধরণও ভিন্ন ছিল। মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মূলনিবাসী কৃষ্ণাঙ্গদের জমির মালিকানার অধিকার খর্ব হওয়ায় তারা গ্রামের দিকেই সরে গেল। শিক্ষার অধিকার এবং ব্যবস্থা খর্ব হল। অন্তঃবর্ণের সমস্ত রকম মেলামেশা ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন বন্ধ হল, উল্টোটা হলে তা রীতিমত সন্দেহের চোখে দেখা হত। ১৯৪৮-এ শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সামজিক আপার্টহাইট বা বর্ণবাদীতাকে নানা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুদৃঢ় করে। ১৯৫০-এর ‘পপুলেশান রেজিস্ট্রেশান অ্যাক্ট’ অনুযায়ী সমস্ত নাগরিকদের তাদের বর্ণ অনুযায়ী নাম নথিভুক্ত করা বাধ্যতামূলক হয়। প্রাথমিক বৈষম্যের সূত্রপাত তৈরীর জন্য এই আইন যথেষ্ট ছিল। ‘গ্রুপ এরিয়া অ্যাক্ট’ অনুযায়ী প্রতি বর্ণের মানুষের জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা হয় মূলত শহরাঞ্চলের জন্য। প্রায় একই রকম আইন ৫৯-এর ‘Promotion of Bantu Self-Government Act’, এই আইন অনুযায়ী আলাদা বর্ণ বা রেসের মানুষদের আলাদা বাসস্থান বাধ্যতামূলক হল। আসলে এটা ছিল ‘কালো খেদাও নীতি’। দেশের খুব অল্প জায়গা বরাদ্দ হল কৃষ্ণাঙ্গদের থাকার জন্য। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হল। ডিসট্রিক্ট ৬, সোফিয়াটাউন, লেডী সেলবোর্ন এর মত অঞ্চলগুলো গায়ের জোরেই পুরোপুরি কৃষ্ণাঙ্গমুক্ত করা হয়। শহরাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের জমি কেনার অধিকার থাকলো না, এখানে তারা বড়জোর বাসস্থান ভাড়া নিতে পারত, আসলে মূলনিবাসী হয়েও তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব পেল। এই আইনের সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক ছিল এটা যে নিজেদের জমির, বাসস্থানের অধিকার হারাতে বাধ্য হল মূলনিবাসী কৃষ্ণাঙ্গরা এবং আরও অনুন্নত এলাকা যেখানে শিক্ষা, পরিবহণ, স্বাস্থ্যের সুবিধাটুকুও নেই সেখানে; প্রায় কর্মহীন অবস্থায় থাকতে বাধ্য করল রাষ্ট্র। এছাড়াও ‘প্রহিবিয়েশান অফ মিক্সড ম্যারেজ অ্যাক্ট’, ‘ইমমর্যালিটি অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’, ‘সেপারেট রিপ্রেজেন্টেশান অফ ভোটার অ্যাক্ট’-এর মত আরও নানা জনবিরোধী, বর্ণবিরোধী আইন লাগু হয়। এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের শিকার হওয়া মানুষ ছাড়াও বহু মানবাধিকার সংগঠন ও অন্যান্য দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার আপার্টহাইট বা বর্ণবাদীতার বিরুদ্ধে সরব হয়।
১৯৪৩-৪৪ সালে নেলসন ম্যাণ্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগদান করেন। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বর্ণবাদবিরোধী চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে বৈষম্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলাই ছিল এই দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি। ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় পার্টি জয়ী হয়, ঠিক এই সময় থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ম্যাণ্ডেলা। ১৯৫২ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ম্যাণ্ডেলা। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের পূর্ণ নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য ধর্মঘটসহ অহিংস আন্দোলন শুরু হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে আইন অমান্য করা, শ্বেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দ পরিবহণ গ্রহণ, শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় প্রবেশ, শ্বেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দ বিশ্রামাগার ব্যবহার, পাসপত্র দেখাতে অস্বীকার করা এবং স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হওয়া – এতে জেলখানা ভরে যায়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৫৫-র এক সম্মেলনে ‘কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের মুক্তির সনদ’ নামে এক ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ৫ই ডিসেম্বর রাজদ্রোহের অপবাদে ম্যাণ্ডেলা সহ ১৫৫ জন গ্রেফতার হন। পাঁচ বছর এই মামলা চলে যদিও এক জনকেও দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি আফ্রিকান সরকার। ১৯৬০-এ শার্পেভিল শহরে প্রায় বিশ হাজার আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গের এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ। ৬৯ জন নিহত হন এবং আহত হন প্রায় ১৮০ জন যা ইতিহাসে ‘শার্পেভিল গণহত্যা’ নামে পরিচিত। মুহূর্তমধ্যে ক্ষোভ, ঘৃণা, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বর্ণবাদী সরকার।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাণ্ডেলা উপলব্ধি করেন অহিংস আন্দোলন নয়, এই মুহূর্তে সশস্ত্র বিপ্লব একমাত্র পথ। ১৯৬১ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সশস্ত্র বিপ্লবের পথে এগিয়ে যায়। সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সশস্ত্র বাহিনী। এবং পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার এই সশস্ত্র যুদ্ধকে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো সমর্থন জানান। অবশ্য আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের এই সশস্ত্র বিপ্লবকে আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দেয়।
আমেরিকার কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাহায্যে ১৯৬২ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার গ্রেফতার করে ম্যাণ্ডেলাকে। ধর্মঘটে উসকানি ও অবৈধভাবে দেশত্যাগের অভিযোগে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এবং সাথে সাথে দেশদ্রোহিতা ও অন্তর্ঘাতের মামলা দায়ের করা হয় ম্যাণ্ডেলাসহ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্যান্য নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে; রিভোনিয়া মামলা নামে বিখ্যাত এই মামলা। আদালতে ম্যাণ্ডেলা অন্তর্ঘাতের কারণ বর্ণনার সাথে সাথে অন্তর্ঘাতের দায় স্বীকার করে নিয়ে বলেন- “আমি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। আমি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের ধারণাকে সযত্নে লালন করেছি, সেখানে সমস্ত মানুষ থাকবেন একসঙ্গে, থাকবে সম্প্রীতি-সংহতি, সমান সুযোগ-সুবিধা। এই আদর্শের জন্য প্রয়োজনে আমি আমার জীবন দিতেও প্রস্তুত।” অবশ্য ম্যাণ্ডেলা তাঁর বিরুদ্ধে আনা দেশদ্রোহিতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। বর্ণবাদী আদালতে ম্যাণ্ডেলাসহ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতাকর্মী সকলেই দোষী সাব্যস্ত হন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
১৮ বছর ধরে ম্যাণ্ডেলা রবেন দ্বীপের নিঃসঙ্গ কারাগারে কাটান, ৮ ফুট বাই ৭ ফুট-এর ঐ সেল যেকোনো মানুষকে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম, কিন্তু ম্যাণ্ডেলা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। এই সময়ই তিনি তার আত্মজীবনী লেখেন। ১৯৮২ সালে নিয়ে আসা হয় পল্সমুর জেলখানায়। ম্যাণ্ডেলাসহ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব যখন কারাবন্দি কিংবা স্বেচ্ছানির্বাসনে দেশান্তরী, তখন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা নিজেদের মতো যথাসাধ্য আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। শত শত কালো মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছে প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ জনপদ। ১৯৮০ সালে নির্বাসিত নেতা বন্ধু অলিভার তাম্বো ‘ম্যাণ্ডেলার মুক্তি চাই’ এই দাবিতে সারা বিশ্বজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৮-তে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ‘ম্যাণ্ডেলাকে মুক্ত করো’ এই গান গেয়ে উঠলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখলেন এই অভাবনীয় ঘটনা। অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক চাপ ছিল শুরু হয় অর্থনীতির চাপ। ১৮৬৭ সাল থেকেই বর্ণবৈষম্যবাদী আফ্রিকান সরকারের বিরুদ্ধে জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরও কড়া হয়ে উঠল। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান রফতানি ‘হিরে’ বয়কট করার আন্দোলন আমেরিকা সহ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। অবশেষে ১৯৯০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি-ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন এবং সাতাশ বছর কারাবন্দী থাকার পরে মুক্ত হলেন নেলসন ম্যাণ্ডেলা। শুরু হল তাঁর অভিভাবকত্বে দেশে বহুজাতিক গণতন্ত্র গড়ার প্রক্রিয়া।
মুক্তিলাভের পর নেলসন ম্যাণ্ডেলার প্রথম লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৯১ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রথম জাতীয় সম্মেলনের ডাক দেন। সেখানে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং বর্ণবৈষম্য দূর করতে আফ্রিকান সরকারে সাথে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেন। ঐবছরের ১৭ই জুন দক্ষিণ আফ্রিকার সংসদ ‘জনসংখ্যা নিবন্ধন আইন’ বাতিল করে, কেননা এই আইনের কারণে জন্মের সময় সমস্ত দক্ষিণ আফ্রিকানদের বর্ণগত শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োজন হত। কিন্তু তা দিয়ে বর্ণবৈষম্য নির্মূল করার ক্ষেত্রে খুব বেশি সুরাহা হল না।
ন্যাশনাল কংগ্রেস ও সরকারের মধ্যে দুবছর বহু আলোচনা হয়। কিন্তু সরকারের সাথে কোনো সমঝোতায় আসা সম্ভব হচ্ছিল না। ইতিমধ্যে কয়েকটি গণহত্যা এবং অবাঞ্ছিত ঘটনা শান্তিচুক্তিকে প্রবল মাত্রায় ব্যাহত করে। ফলে সারা দেশ আবার উত্তাল হয়ে ওঠে। দীর্ঘ আলোচনার পর সমঝোতায় আসা যায়। সব বর্ণ এবং সব জাতির সমানাধিকার থাকবে এই লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকার অনুযায়ী সকল সংসদীয় দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। তিন দিনের ভোট গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় দুই কোটি আফ্রিকান তাঁদের ভোট প্রদান করেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রায় ৬২% ভোট পেয়ে জয় লাভ করে। ১৯৯৪ সালের ১০ই মে দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত বর্ণের সমস্ত জাতির সমস্ত সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে নেলসন ম্যাণ্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক দীর্ঘ অবিচার বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নে এগিয়ে চলে দক্ষিণ আফ্রিকা।
লেখা ও ডিজাইন – বাপ্পাদিত্য