একটি প্রবেশপথ। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুটো কুকুর দাঁড়িয়ে আছে প্রবেশপথটির সামনে। শেকল দিয়ে ভালো করে বাঁধা হচ্ছে তাদেরকে। শেকলের একটি প্রান্ত রেখে দেয়া হচ্ছে বাইরে, যেনো হারিয়ে যাবার আগেই বের করে ফেলা যায় তাদেরকে। শেকলবাঁধা কুকুরগুলোকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ভেতরের দিকে। আস্তে আস্তে তারা মিলিয়ে গেলো ভেতরের অন্ধকারে। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন কোনো নড়াচড়া কিংবা শব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না, তখন বাইরে থাকা শেকলের প্রান্ত টেনে নেয়া হলো আস্তে আস্তে। টানতে টানতে শেকলের অপর প্রান্ত ঠিকই বের হলো, কিন্তু তাতে বেঁধে রাখা কুকুর দুটোর কোনো হদিসই মিললো না। কে জানে, কোথায়, কিভাবে হারিয়ে গেলো তারা! সেই অন্ধকার প্রবেশপথের অস্তিত্ব আজও আছে, যেখানে গেলে কেউ নাকি আর ফিরে আসে না। আজ একটি লোহার গেইট আছে সেখানে। তালা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অন্ধকার জগতের রহস্যময় সেই পথটি। এটিই পুরনো ঢাকার লালবাগ কেল্লার সবচেয়ে রহস্যময় সুড়ঙ্গপথ।
খুবই অল্প সময় ঢাকায় অবস্থানকালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় ছেলে আজম শাহ ১৬৭৮ সালে একটি অত্যন্ত জটিল নকশার ভিত্তিতে নির্মাণ শুরু করেন ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’। এটিই পরবর্তীতে ‘লালবাগ কেল্লা’ নামে পরিচিত হয়। কাকতালীয়ভাবে এই কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু হলেই ঘটে যায় কোনো না কোনো দুর্ঘটনা। আর এ কারণেই কখনো ইচ্ছে করে, কখনো অনিচ্ছায় বন্ধ হয়ে যায় এর কাজ। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, এই কেল্লা নিশ্চয়ই অশুভ।
বাংলাদেশে মুঘল স্থাপত্যকলার একমাত্র নিদর্শন এই লালবাগ কেল্লার নিচে রয়েছে অসংখ্য সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব। তবে এর মাঝে একটি সুড়ঙ্গপথ নিয়েই প্রচলিত হয়েছে নানান রকম কল্পকথা ও লোকবিশ্বাস। এই সুড়ঙ্গের ভেতরে প্রবেশ করার পর কোনো জীব আর ফিরে আসে নি –এমন ধারণাই বহুকাল ধরে স্থায়ী হয়েছে মানুষের মনে। বিপজ্জনক হবার কারণে আজ পর্যন্ত এর প্রত্নতাত্ত্বিক খননও হয় নি।
অধিকাংশ স্থাপত্যবিদ মনে করেন, এই সুড়ঙ্গটি প্রায় আঠারো কিলোমিটার দূরে টঙ্গী নদীর সাথে যুক্ত। কেউ কেউ আবার এ-ও ভাবেন, এটি আসলে কোনো জলাধারের মুখ। এই সুড়ঙ্গকে ঘিরে সবচেয়ে অবান্তর কল্পনাটি হলো, এই পথ দিয়ে নাকি দিল্লীতে পৌঁছানো যায়। তবে যৌক্তিকতার বিচারে বলা যায়, যেহেতু লালবাগ দুর্গটির নকশা নদীর ধারের দুর্গের নকশার অনুরূপ ছিলো, সেহেতু বিপদের সময় এই দুর্গের মাধ্যমে দ্রুত নৌপথ ব্যবহার করে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে। সুতরাং প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সুড়ঙ্গটির শেষ মাথা কোনো নদীর দিকেই পৌঁছে দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডঃ এ. কে. এম. শাহনাওয়াজের বলেন, রহস্যে ঘেরা এই সুড়ঙ্গটির শেষ প্রান্ত বুড়িগঙ্গা নদী।
সুড়ঙ্গ নিয়ে গড়ে ওঠা রহস্যের যদি এতোই সহজ সমাধান হয়, তবে কেনো এর ভেতর কোনো জীব ঢুকলে আর ফিরে আসে না? এক দল বিদেশী গবেষক এক বার এই পথ দিয়ে দুটি কুকুর পাঠিয়েছিলেন, যারা আর ফিরে আসে নি। এরপর আরও এক বার শেকল পরিয়ে দুটো কুকুরকে পাঠানো হয়েছিলো এই সুড়ঙ্গে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেবারও শুধু শেকল ফিরে আসে, কুকুরগুলো আর ফিরে আসে নি। অনেক গবেষকদের মতে, হয়তো এই সুড়ঙ্গের ভেতরে এমন কোনো গ্যাসীয় পদার্থের অস্তিত্ব আছে, যেটি প্রাণীদেহের হাড়-মাংস গলিয়ে দেয়। কিংবা কে জানে, হয়তো এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব সেখানে আছে, যা আমাদের ভাবনার জগতের ঊর্ধ্বে!