১৭৮৭ সালের ৯ এপ্রিল। কোলকাতার সেইন্ট জন্স চার্চ। আজকেই সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। কোলকাতার মানুষেরা অধীর আগ্রহে এই দিনের জন্য অপেক্ষা করে ছিলো। বেশ ভোরেই সবাই আজ ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। দ্রুত চার্চের ঐখানে যেতে হবে যে! বিখ্যাত শিল্পীর হাতে আঁকা চিত্রটি কতোই না মোহনীয় হবে! প্রত্যেকেই এই ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে। এই তো শিল্পী চার্চ কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে দিচ্ছেন ছবিটি। উপস্থিত সবাই নিঃশ্বাস আটকে ছবিটির সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য অপেক্ষা করছে। খুলে ফেলা হলো ছবির উপরের আবরণ। অবশেষে সবার সামনে প্রদর্শিত হলো ছবিটি। কিন্তু এ কি! এ কেমন চিত্র! দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলো উত্তেজনাপূর্ণ মুখগুলো। আর ক্ষমতাসীন লোকগুলোর মুখ হয়ে গেলো ফ্যাকাশে। শুধু একজনের মুখেই ছিলো চাপা হাসি ও বিদ্রুপের ছাপ। তিনি হলেন অতিকাঙ্ক্ষিত সেই চিত্রকর্মের রচয়িতা, জোহান জোফেনি।

জোহান জোফেনি

ভারতবর্ষ তখন সবে গিয়েছে ইংরেজদের দখলে। ইংরেজরা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলো, অপার সম্ভাবনার দেশ এই ভারতবর্ষ। তাই ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে ব্রিটিশরা আসতে শুরু করলো এখানে। ভারতবর্ষ যেনো এক আয়ের মেশিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো তাদের জন্য। কোনো রকমে কষ্ট করে বিরূপ জলবায়ুর এই দেশে দুটো মৌসুম কাটিয়ে দিতে পারলেই আর চিন্তা নেই। মৃত্যুকে কোনোরকম ঠেকিয়ে রাখা গেলেই এই উপমহাদেশে একটা শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়। ধনী হতে চাইলে ভারতবর্ষে আসার বিকল্প কিছুই ছিলো না তখন ইংল্যান্ডবাসীর কাছে।

ভারতবর্ষে এসে ব্রিটিশরা যে যার মতো করে নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলো এবং একটা সময় তারা অনুভব করলো, ভারতবর্ষে যেহেতু থাকতেই হবে, সুতরাং একটা চার্চ খুবই প্রয়োজন। সেই সময় ব্রিটিশদের নিজেদের মধ্যেও ছিলো এক দুর্বোধ্য প্রতিযোগিতা। তারা এমন একটা চার্চ গড়ার চিন্তা করলো, যেটি লন্ডনের সৌন্দর্যকেও হার মানায়। ব্যস, শুরু হয়ে গেলো চার্চের কাজ। শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ বাহাদুর এই চার্চের জন্য নিজের জমি দিয়েছিলেন। অবশেষে ১৭৮৭ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম চার্চ, সেইন্ট জন্স চার্চ।

লাস্ট সাপার

সেইন্ট জন্স চার্চ শুধু একটি চার্চই নয়, প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনে ভরপুর এক ধরনের জাদুঘরও এই চার্চ। এইতো সেদিন আমি গিয়েছিলাম বিখ্যাত এই চার্চটি একটু ঘুরে দেখবার জন্য। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি সমাধিসৌধ, যাতে শায়িত আছেন অসংখ্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ ব্যক্তি ও তাদের পরিবার। আর গীর্জার ভেতরের দিকে রয়েছে বিখ্যাত শিল্পীদের কিছু চিত্রকর্ম। দেখতে দেখতে হঠাৎ একটি ছবিতে চোখ আটকে গেলো আমার। গীর্জার মূল অল্টারের বাম দিকে রাখা ছবিটি। দেখার সাথে সাথেই চিনে ফেললাম আমি। এটি তো সেই বিখ্যাত ‘লাস্ট সাপার’, যেটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘লাস্ট সাপার’ চিত্রের আদলে আঁকা হয়েছিলো। কিন্তু চার্চের এই ছবিটি কিন্তু ভিঞ্চির ছবিটির কপি নয়, বরং এই ছবিটিতে রয়েছে কিঞ্চিৎ দুষ্টুমির ছোঁয়া। ছবিটিতে প্রত্যেকের মুখাবয়ব আঁকা হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন লোকদের মুখাবয়বের অনুকরণে। এ যেনো শিল্পীর তুলিতে ঝাল মরিচের লাল! এমন স্পর্ধা তখন একজন শিল্পীরই ছিলো। তিনি হলেন জোহান জোফেনি। হ্যাঁ, সেইন্ট জন্স চার্চের এই অন্যরকম লাস্ট সাপারের রচয়িতা হলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জোহান জোফেনি।

জোহান জোফেনির বাবা ছিলেন জার্মানি। ইংল্যান্ডেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তিনি শিল্পী হসেবে। একটা সময় বেশ ভালো উপার্জন করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার বোহেমিয়ান ধাঁচের জীবনধারা এবং অতিরিক্ত বেখেয়ালি খরচ তাকে আবারো দারিদ্র্যের মাঝে ঠেলে দিয়েছিলো। এদিকে তার সমসাময়িক শিল্পীরা ততোদিনে ভারতবর্ষে গিয়ে একেবারে টইটুম্বুর। জোফেনি লক্ষ করলেন, ভারতবর্ষে গেলেই তো সফলতা নিজে নিজে চলে আসে। তাহলে তারও তো সেখানে যাওয়া উচিৎ। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ভারতবর্ষে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলেন জোফেনি। কোম্পানি জানালো, কোম্পানির জাহাজে করে জোফেনি যেতে পারবেন না। সে সময় ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। সুতরাং, কোম্পানির জাহাজ ছাড়া যাবার অন্য কোনো উপায় নেই। জোফেনি বুঝলেন, কোম্পানি চায় না জোফেনি ভারতবর্ষে যাক। কোম্পানি কখনোই তাদের নিজস্ব বলয়ের বাইরে অন্য কাউকে ভারতবর্ষে ঢুকতে দিতে নারাজ ছিলো। কিন্তু নাছোড়বান্দা জোফেনি ভারতবর্ষে যাবার জন্য বুদ্ধি আঁটলেন। ১৭৮৩ সালে সবার অগোচরে নিজেকে লুকিয়ে চড়ে বসলেন কোম্পানির জাহাজে এবং ধরা যেনো না পড়তে হয়, সে জন্য ডায়মন্ডহারবার থেকেও বিশ মাইল দূরে খেজুরিতে লাফিয়ে নেমে পড়লেন তিনি।

সেন্ট জনস চার্চ, কলকাতা

কোলকাতায় পৌঁছাবার পর কিন্তু একদমই পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি জোফেনিকে। তার কারণ অবশ্যই তার অভাবনীয় প্রতিভা ও যোগ্যতা। সবাই ভুলেই গেলো তার বিনা অনুমতিতে বেনামে ভারতবর্ষে প্রবেশের কাহিনী। রীতিমতো লুফে নিলো তাকে সবাই। আর জোফেনিও এঁকে চললেন একের পর এক আকর্ষণীয় সব চিত্রকর্ম। ‘রয়্যাল অ্যাকাডেমী অফ আর্টস’ এর ৩৬ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের তালিকায় রাজা তৃতীয় জর্জ নিজে যুক্ত করলেন জোফেনির নাম।

কোলকাতায় সেইন্ট জন্স চার্চের উদ্বোধনের কিছুদিন আগে জোফেনিকে অনুরোধ করা হলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘লাস্ট সাপার’ এর মতো করে একটি ছবি এঁকে দেয়ার জন্য। জোফেনি শুরু করলেন ছবি আঁকা। খবরের কাগজে ছাপা হলো, জোফেনির আঁকা ছবি দিয়ে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে সেইন্ট জন্স চার্চ। হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেলো চতুর্দিকে। একে তো কোলকাতায় গড়ে উঠছে প্রথম চার্চ, তার ওপর জোফেনির হাতে আঁকা ছবি, প্রবল উত্তেজনায় দিন পার করতে লাগলো সবাই।

সেন্ট জনস চার্চ এর ভিতরে লেডি ক্যানিংয়ের সমাধির সামনে আমি এবং আমার পুত্রবধু

১৭৮৭ সালের জুন মাসে উদ্বোধন হবার কথা চার্চের। তাই এপ্রিলের ৯ তারিখেই জোফেনি উপহার দিলেন তার হাতে আঁকা লাস্ট সাপারের ছবিটি। কিন্তু যেই ছবি নিয়ে এতো উত্তেজনা, এতো আয়োজন সেই ছবি দেখতে ভ্রু কুঁচকে গেলো সবার। আর মনে মনে মুচকি হাসতে লাগলেন জোফেনি। সবাইকে বোকা বানিয়ে বেশ মজা পেয়েছেন বেখেয়ালি এই শিল্পী। আসলে লাস্ট সাপারের ছবি তিনি ঠিকই এঁকেছেন। কিন্তু ছবির মানুষগুলোর চেহারা দিয়েছেন নিজের মতো করে। এক ধরনের প্রতিশোধ নিয়েছেন জোফেনি। যীশুর জায়গায় তিনি বসিয়েছেন ফাদার পার্থেনিওকে এবং কুখ্যাত জুডাসের জায়গায় বসিয়েছেন কোলকাতার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী টুলাকে। ছবির অন্য মুখপাত্রগুলোও সবার চেনা-পরিচিত ক্ষমতাসীন ব্যক্তির। টুলা তো জোফেনির উপর এতোটাই ক্ষেপেছিলেন যে, মানহানির মামলা পর্যন্ত দিয়েছিলেন তার নামে। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের চেহারাও ছিলো জোফেনির ছবিতে। ম্যাজিস্ট্রেট তো রেগেমেগে তলোয়াড়ের আচড় পর্যন্ত বসিয়ে দিয়েছিলেন চিত্রটিতে। আজও একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে তলোয়াড়ের সেই আড়াআড়ি দাগটি বোঝা যায়। যেই ছবির পেছনে এতো অর্থ খরচ করা হলো, তাতে নিজেদেরই এমন অপমান সহ্য করতে পারলো না কেউই।

এই ঘটনার পরও বহু উল্লেখযোগ্য ছবি এঁকে গিয়েছেন জোফেনি। কোলকাতা ছেড়ে লখনৌতে গিয়েছিলেন তিনি। একরকম রাজার হালে দিন পার করেছেন সেখানে। অবশেষে ১৭৯০ সালে নিজের দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তিনি। ততোদিনে তিনি বহু অর্থ জমিয়েছেন। মাত্র সাত বছর ভারতবর্ষে অবস্থানকালে প্রায় দশ হাজার পাউন্ড জমিয়েছিলেন জোফেনি।

দেশে ফেরার পথে নাকি আন্দামানে জাহাজডুবি হয়েছিলো। জোফেনির ভাষ্য অনুযায়ী, তারা এতো খারাপ পরিস্থিতিতে ছিলেন যে, মৃতদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছিলো তাদেরকে। কিন্তু জোফেনি এতোটাই গল্পবাজ ছিলেন যে, তার মুখের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করা কঠিন। তা ছাড়া সত্যিই এমন পরিস্থিতিতে পড়লে এতো এতো ছবি নিয়ে লন্ডনে না পৌঁছাতে পারারই কথা ছিলো।

জোহান জোফেনির আঁকা লালবাগ কেল্লা (১৭৮৭)

১৭৯৮ সাল। ৬৫ বছরের বৃদ্ধ এখন জোহান জোফেনি। প্রথমবার তো ভারতবর্ষে চলে গিয়েছিলেন অনুমতি ছাড়াই, কিন্তু এবার কোম্পানির অনুমতি পেয়েও আর যেতে পারলেন না। বয়সের ভারে অচল হয়ে পড়েছিলো তার শরীর। অবশেষে ১৮১০ সালে মারা যান বিখ্যাত এই শিল্পী। জোফেনি তো চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু ভারতবর্ষে রেখে গেলেন তার অজস্র চিত্রকর্ম। আজও সেইন্ট জন্স চার্চে রাখা তার লাস্ট সাপারের ছবিটি মনে করিয়ে দেয় তার জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া প্রত্যকটি দুর্দান্ত ঘটনা।

 

রেফারেন্সঃ