আমেরিকার তৃতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ইয়েল ইউনিভার্সিটির নাম কে না শুনেছে? অত্যন্ত প্রাচীন ও বিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয়েছে ব্রিটিশ-আমেরিকান ঔপনিবেশিক এলিহু ইয়েলের নাম অনুসারে। এলিহু ইয়েল সম্পর্কে আমরা কতোটুকু জানি? তার জন্ম ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে। এক পর্যায়ে তার পরিবার ইংল্যান্ডে চলে যায় এবং তিনি লন্ডনে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ইয়েল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন, যা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দেয়। ভারতবর্ষের সাথে বাণিজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার ছিলো। ইয়েল ১৬৮৭ সালে মাদ্রাজের প্রথম গর্ভনর হন। আমেরিকাতে একজন দানশীল ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত ইয়েল। তিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অঢেল দান করেছেন। তবে এই দানের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করলে ইয়েলের মুখে কালশিটে পড়বে না তো? জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দাস-ব্যবসা ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে যান ইয়েল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, সেই এলিহু ইয়েলের কথাই বলছি, যিনি দানশীলতার জন্য বিখ্যাত এবং শিক্ষা ও আদর্শের প্রতীক। দাসদের প্রতি তার চরম নিষ্ঠুরতার বর্ণনাও মিলেছে। শিশুশ্রমের মতো জঘন্য অপরাধ হতো তার নিজের বাড়িতেই।
দাস ব্যবসা নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দাস বাণিজ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলেন ইয়েল। তিনি সেইন্ট জর্জ ফোর্টের প্রধান বিচারক থাকা অবস্থায়ও ঘুষ নিয়েছিলেন। ১৬৮০ এর দশকে মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই সে সময় অসংখ্য বেকার যুবক কাজ খুঁজতে শুরু করেন । সে সব বেকার যুবকদেরকে ধরে ধরে ক্রীতদাস বানিয়ে অন্যান্য উপনিবেশে পাঠানো হয় ইয়েলের নির্দেশেই। প্রথম দিকে শুধুমাত্র কোনো অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীকেই শাস্তিস্বরূপ দাস হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো। কিন্তু যখন দাসের চাহিদা বেড়ে গেলো, তখন অল্পবয়সী শিশুদেরকেও অনেক দূরে দূরে নির্বাসিত করা হলো। তারা আর কখনোই ফিরে আসে নি। এলিহু ইয়েল মাদ্রাজের গভর্নর হবার পরও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিলো। ইয়েলের নির্দেশ ছিলো, মাদ্রাজ ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি পণ্যবাহী জাহাজে কমপক্ষে দশ জন ক্রীতদাস রপ্তানি করতেই হবে। এই দাস ব্যবসা ইয়েলকে প্রচন্ড লাভবান বানিয়েছিলো। এক সময় অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইয়েলের গড়ে তোলা বিশাল অর্থের কথা লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তরে পৌঁছায় এবং তারা তাকে গভর্নর পদ থেকে অপসারণ করে ব্রিটেনে ফিরে যেতে বলেন। এই সিদ্ধান্তে ইয়েলের তেমন কোনো ক্ষতিই হয় নি। কেননা ততোদিনে তিনি বিত্তের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছিলেন। ১৬৯৯ সালে লন্ডনে ফিরে গিয়ে বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে রাজকীয় জীবনযাপন শুরু করেন এলিহু ইয়েল।
লন্ডনে ইয়েলের বাসভবনে ১৭১৯ সালে ইয়েল ও তার পরিবারকে অমর করে রাখবার উদ্দেশ্যে একটি পেইন্টিং আঁকা হয়েছিলো। ছবিটির মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন স্বয়ং ইয়েল, দু পাশে পরিবারের আরো কয়েকজন সদস্য এবং এক কোণায় একটি শিশু। শিশুটির গায়ের রং কালো, চেহারার গঠন আফ্রিকান, গায়ে কম দামী ছাইরঙা জামা, গলায় তালাযুক্ত কলার, হাতে ওয়াইনের বোতল এবং দামী পোশাকে সজ্জিত ইয়েল পরিবারের সদস্যদের সেবায় হাজির ভঙ্গিমা দেখে সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকে না যে, শিশুটি একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস। সেই একই ছবিতে পেছনের দিকে খোলা মাঠের মতো জায়গায় দামী পোশাক পরা শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাদেরকে (খুব সম্ভবত ইয়েল পরিবারের শিশু) খেলাধুলা করতেও দেখা যায়।
ইয়েল ও তার পরিবারের মোট সাতটি গ্রুপ পোর্ট্রেইট এর মধ্যে এই বিশেষ পেইন্টিংটি সবার নজর কেড়েছিলো। কারণ ছবিটি এক নীরব নিষ্ঠুরতাকে আলো দিচ্ছিলো। চিত্রকর কি ভাবছিলেন ছবিটি আঁকার সময়, কে জানে? হয়তো তিনিও আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে শিক্ষিতের আড়ালে ঘৃণাযোগ্য ব্যক্তিদের অমানবিক বাস্তবতা। ছবিটিতে শিশুটির গলার তালাযুক্ত কলার প্রমাণ করে যে, সে যেনো পালিয়ে যেতে না পারে, এ জন্যই এমন ব্যবস্থা। যেখানে অসংখ্য শ্বেতাঙ্গ শিশু হেসেখেলে প্রাণ জুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে একই ফ্রেমে ধরা পড়েছে এই শিশুটি, যে নিজের শৈশবকে মাটিচাপা দিয়ে অবিরাম মনিবের সেবা করে যাচ্ছে, যার চোখের দৃষ্টি নীরবেই যেনো অনেক কিছু বলে দেয়।
পশ্চিমের মানুষের তখন অঢেল সম্পদ। ধূমপান, সুরায় চুমুক দিয়ে বেলা পার করে দিতো তারা। তাদের বিত্তের পাহাড় সন্তান-সন্ততিকে দিতো নিরাপত্তা। অবকাশযাপন ও বিরাট প্রাসাদের মাঠে খেলাধুলা-আমোদ-উৎসবই ছিলো তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাদের এই সম্পদের প্রধান উৎস হচ্ছে, ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা। আমাদের উপমহাদেশের সম্পদ লুট করে করে পশ্চিমারা টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিলো। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন মাত্রায় যে পরিমাণ শোষণ ও লুট ব্রিটিশরা করে গেছে, তা থেকেই এক অর্থে শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সর্বোচ্চ বিকাশের সুবিধা ভোগ করছে আজকের উন্নত বিশ্ব। এই একটি পোর্ট্রেইটের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে চার-চারটে মহাদেশ –এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকা। এশিয়া এবং আফ্রিকাকে তো রীতিমতো দাস-বাণিজ্যের চারণভূমিতে পরিণত করেছিলো শ্বেতাঙ্গরা। এশিয়ার প্রত্যেক উপমহাদেশ থেকে কাজের খোঁজে আসা দরিদ্র অসহায় মানুষদেরকে দাসে পরিণত হতে বাধ্য করেছে বিশ্বের এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরা, বাধ্য করেছে মানুষগুলোকে নিজেদের পরিচয় হারাতে। সেই বর্বরতার কথা ভাবতে বসলে এক অদ্ভূত হতাশায় ভার হয়ে যায় মন।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর পর প্রদর্শন করা এই ছবিটি যেনো শ্বেতাঙ্গদের এই নির্লজ্জতাকেই আবারো তুলে ধরেছিলো সবার সামনে। তবে আজকের বিশ্ব এটিকে সহজভাবে দেখে নি। মানুষ এবার প্রশ্ন তুলেছে। ২০১৬ সালে আরেকটি ছবি আঁকা হয়। আঁকিয়ে হলেন আমেরিকান চিত্রশিল্পী টাইটাস কাফার। ছবিটির নাম তিনি দেন ‘এনাফ অ্যাবাউট ইউ’। এলিহু ইয়েলের ক্রীতদাস শিশুটিকে তিনি একটি স্পষ্ট রূপ দেন তার আঁকা ছবিতে এবং সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন তার মুখশ্রী। তার ছবিতে শ্বেতাঙ্গদেরকে তিনি চূর্ণ-বিচূর্ণ ও অস্পষ্ট করে দেন এবং শিশুটিকে একটি প্রতিবাদী ভূমিকায় উত্তীর্ণ করেন, যার গলায় নেই কোনো সিলভার কলার, যার দৃষ্টি সরাসরি দর্শকের দিকে। হয়তো এমন ধ্যান-ধারণার উত্থানই একদিন বদলে দিবে পৃথিবীকে, ঘুচিয়ে দিবে সমস্ত অতীত হতাশার অন্ধকারকে।