মিশরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজার দীর্ঘায়ুই পরিণত হয়েছিলো তার বেদনার কারণে। প্রথম সেটির মৃত্যুর আগেই দ্বিতীয় রামেসিসকে ফারাও হিসেবে প্রস্তুত করবার প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েহিলো। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবেই বেড়ে উঠতে থাকেন রামেসিস। বাবার সাথে সিরিয়ার অভিযানে যেতেও তাকে দেখা গিয়েছে। মিশরে তার বাবার পাশে চ্যারিয়ট বা রথ চালানো অবস্থায়ও রামেসিসের ছবি পাওয়া গিয়েছে। এমনকি হিট্টিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তার বাবা তাকেই সঙ্গী হিসেবে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। একেবারে প্রথম থেকেই তাকে সামরিক অভিজ্ঞতায় দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছিলো। কূটনৈতিক যোগ্যতাসম্পন্ন জনসংযোগে দক্ষ এক ব্যক্তি হিসেবেই ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ হচ্ছিলো রামেসিসের।
বহুবিবাহের চল ছিলো মিশরীয়দের মধ্যে এবং রামেসিসও এই নিয়মের বাইরে যান নি। কিন্তু তার একাধিক স্ত্রী থাকলেও প্রধান স্ত্রী ছিলেন নেফারতারি। নেফারতারি ছিলেন তার ভীষণ ভালোবাসার পাত্রী। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে রামেসিসের রাজত্বের ২৪ তম বছরে নেফারতারি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন রামেসিসের প্রথম ও প্রধান স্ত্রী।
অন্য যে কোনো মিশরীয় ফারাও এর তুলনায় দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকাল ছিলো অনেক বেশি। তিনি প্রায় ৬৬ বছর পর্যন্ত মিশরে রাজত্ব করেছেন এবং তার যোগ্য শাসনের মাধ্যমে মিশর অত্যন্ত শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। তার হাতে যেমন বহু স্থাপত্য, অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ ও মূর্তি গড়ে উঠেছিলো; ঠিক তেমনি বহু সন্তানের জন্মদাতা হিসেবেও তিনি রেকর্ড গড়েছিলেন।
বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ১৪ বছর বয়সে দ্বিতীয় রামেসিস সিংহাসনে বসেন। সে সময় হিট্টাইট রাজা এই তরুণ ফারাও এর বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন এবং আধুনিক সিরিয়ার কাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহরটিকেও তারা দখল করে নেন। ফলে এ নিয়ে দুই দলে লেগে যায় প্রচন্ড যুদ্ধ। একটা পর্যায়ে যখন এই দুই পক্ষই বুঝতে পারলো যে, এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়, তখন আলোচনার মাধ্যমে রামেসিস অবশেষে হিট্টাইটদের সাথে একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই ছিলো প্রাচীনতম এক শান্তিচুক্তি, যা আজ অবধি টিকে রয়েছে। এই চুক্তিটির অনুলিপিও হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে কর্ণাটক মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করে রাখা হয়েছিলো। ১৯০৬ সালে তুরস্কে আক্কাদীয় ভাষার আরও একটি মাটির ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হয়, যেখানে এই চুক্তিটি লেখা ছিলো। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সম্মানিত চুক্তি হওয়ায় এর একটি প্রতিরূপ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের দেয়ালেও টাঙানো রয়েছে। এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর সম্পর্কটিকে আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় রামেসিস হিট্টাইট রাজার বড় মেয়েকে বিয়েও করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তখনও নেফারতারিই ছিলেন রামেসিসের প্রধান রাণী।
রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দূরদর্শিতার কারণে বিপুল সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস। বিশাল বিশাল স্থাপত্যগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। কর্ণাটকের মন্দির, আবু সিম্বলের মন্দির আজও পৃথিবীর মানুষের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য তৈরী মন্দিরটিতে ১০ হাজার প্যাপিরাস সম্বলিত এক বিশাল লাইব্রেরি ছিলো। আবিদোসেও তিনি তার বাবা এবং নিজের জন্য একটি মন্দির তৈরী করেছিলেন।
তিনি সব সময় চাইতেন, পৃথিবী যেনো কোনো ভাবেই তাকে ভুলে যেতে না পারে। তার সেই আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ হয়তো জীবিত অবস্থায় তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পর পরবর্তী নয় জন রাজাই তার নামে নিজেদেরকে মিশরের ফারাও হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
আবু সিম্বেলের মন্দিরটিকে তিনি দেখার মতো করে তৈরী করেছিলেন। মন্দিরের প্রবেশপথে প্রায় ৬০ ফুট উঁচু দুটি উপবিষ্ট মূর্তি রয়েছে। এরা ছিলেন মন্দিরের পাহারাদার। সূর্য দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার উদ্দেশ্যে তৈরী এই মন্দিরটি পাহাড়ের গা কেটে প্রায় ১৮৫ ফুট পর্যন্ত ভিতরের দিকে নির্মিত হয়েছিলো। সেই মন্দিরের মধ্যেও খোদাই করে আঁকা হয়েছিলো কাদেশের যুদ্ধের ছবি। সেই সাথে রামেসিসের প্রধান স্ত্রী নেফারতারি ছবিও অঙ্কিত ছিলো, যেখানে নেফারতারি সূর্য দেবতাকে নৈবদ্য উপহার দিচ্ছেন।
স্ত্রী নেফারতারি ছিলেন রামেসিসের প্রেয়সী। দ্বিতীয় আরেকটি মন্দির তিনি নেফারতারির জন্য তৈরী করেছিলেন, যদিও সেটি অপেক্ষাকৃত ছোট ছিলো। ১৮১৩ সাল পর্যন্ত এই মন্দিরগুলো লোকচক্ষুর আড়ালেই পড়ে ছিলো। আসোয়ান বাঁধ তৈরীর সময় মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছিলো বলে ছোট ছোট টুকরো করে মন্দিরটিকে নতুন একটি জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়।
অত্যন্ত কঠোর ও একরোখা রামেসিস একট পর্যায়ে হয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধবিমুখ। তার মনও বেশ নরম হয়ে গিয়েছিলো। এর কারণ জানতে হলে তার ব্যক্তিজীবনে একটু উঁকি দেয়াই যথেষ্ট। বিধাতার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন লম্বা আয়ু। মিশরীয়দের গড় আয়ু ততো বেশি ছিলো না। আর তাই নিজের জীবদ্দশাতেই অসংখ্য প্রিয়জনের মৃত্যুর শোক তাকে সহ্য করতে হয়েছিলো। একাধিক স্ত্রীর গর্ভে তার প্রায় ১০০ জনের মতো সন্তান ছিলেন। প্রতি বছরই সন্তান বা স্ত্রীদের মধ্যে কেউ না কেউ তার চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতেন। প্রিয়জন বিয়োগের এই ব্যথা তাকে আমৃত্যু সহ্য করতে হয়েছিলো। তবে বলাই বাহুল্য, সবচেয়ে বেশি আঘাত তিনি সেদিনই পেয়েছিলেন, যে দিন তার প্রিয়তমা স্ত্রী নেফারতারি পরলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন।