বেদুঈনদের বাড়ি থেকে সকলের অলক্ষ্যে তাকে চুরি করে নিয়ে এসেছিল একজন দুর্বৃত্ত। তারপর দাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয় তাকে। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদের খলিফা মনসুর হজের সফরে ছিলেন । মক্কার কাছাকাছি তিনি এক বাজার থেকে তাকে কিনে নিয়ে আসে এবং নিজের ছেলে মাহদির সেবায় তাকে নিয়োজিত করে। আমরা জানি সে সময় বাগদাদ ছিল একটি প্রাণবন্ত মহানগর। আব্বাসীয়দের অধীনে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানীর মধ্যে সবচাইতে বড় ও প্রধান শহর। অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করছে এখানে কার কথা হচ্ছে? হ্যা, গল্প বলছি কিংবদন্তি খলিফা হারুনুর রশীদের মায়ের সম্পর্কে।
কিছু কিছু মানুষকে সৃষ্টিকর্তা আলাদা ভাবে মেধাবী ও অত্যন্ত যোগ্য করে তৈরি করেন। খাইজুরান তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। শক্তিশালী, প্রতিভাবান সেই সাথে ছিলেন অসামান্য সুন্দরী।
সেই সময় হারেমে অবস্থানরত সকল দাসীদেরই সংগীত, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও ধর্মতত্ত্ব শেখাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এ গুলোর সবই তার নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন খাইজুরান। সেই সাথে সাথে বিখ্যাত সমস্ত আইন বিশেষজ্ঞ বিচারকের কাছে আইন শাস্ত্রেরও উচ্চতর পাঠ তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
শুধু ধর্মের উপরই তার দক্ষতা ছিল না। আরবের ইতিহাস, নবী , রাজা-বাদশাহদের জীবনী, আরবি ভাষা, সাহিত্য এবং আরবি কবিতার উপরে ছিল তার অসামান্য জ্ঞান। নিজেও কবিতা লিখতেন, অসংখ্য কবিতা তার মুখস্থ ছিল। প্রাচীন আরবি কবিতা সংকলনগুলোতে তার লেখা কবিতা পাওয়া যায়। এমন একজন যোগ্য মহিলার প্রতি খলিফা মাহদির আকৃষ্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার মেধা প্রতিভা বিচক্ষণতা, জ্ঞান চর্চায় তার আগ্রহ সমস্ত কিছুই তাকে মুগ্ধ করেছিল। এক পর্যায়ে নিজে যখন খলিফা হলেন তখন খাইজুরানকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে বিয়ে করেন।
ইতিহাসে বাঁদী থেকে বেগম হবার ঘটনার উদাহরণ বহু রয়েছে। এটি তারই মধ্যে একটি l বোঝাই যাচ্ছে রাজ পরিবারে দাসী হিসেবে প্রবেশ করলেও সম্রাট খলিফার স্ত্রী হয়ে ক্ষমতার প্রাণ কেন্দ্রে তিনি পৌঁছে যান। স্বামী বা সন্তানেরা যখন রাজ্য শাসন করছিল সেই সময় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। ইসলামের ইতিহাসে সম্ভবত তিনি প্রথম নারী যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল এবং তার নামে প্রথম স্বর্ণ মুদ্রা চালু করা হয়েছিল। স্বামী যখন বেচেঁ ছিলেন তখন খলিফার সাথে তিনি রাজদরবারে উপস্থিত থাকতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তিনি খলিফাকে মতামত দিয়ে সাহায্য করতেন।
তিনিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নারী যার নিজস্ব প্রশাসনিক দপ্তর এবং আদালত ছিল। যেখানে সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে রাজকর্মচারীরা সকলেই তাদের অনুযোগ অভিযোগ জানাতে পারতেন। যেহেতু রাষ্ট্রের কোষাগার বা আমলা এবং প্রশাসকদের উপরে তার যথেষ্ট কর্তৃত্ব ছিল তাই দেখা গেছে তার প্রজাহিতকর কাজের ক্ষেত্রে টাকা পয়সার কোন অভাব হয়নি। জনগণের কল্যাণে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে পেরেছিলেন। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও স্থিতি বজায় রাখতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । খলিফা অনেক সময় শিকার এবং বিনোদনের জন্য রাজধানীর বাইরে থাকলে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতেন । পরবর্তীতে খলিফার মৃত্যু হলে প্রথমে তিনি তার পুত্র আল হাদির ক্ষমতা নিশ্চিত করেন।
সেই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ দুই বছর বেতন দিয়ে তাদেরকে তিনি তার অনুসারী করে ফেলেন। পরবর্তীতে আল হাদির মৃত্যুর পর তিনি হারুনুুর রশিদকে খলিফা হতে সাহায্য করেন। হারুনুর রশিদ যখন সিংহাসনে বসেন তখন বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করেন তার মায়েরই কাছে। তিনি সন্তানের পাশে থেকে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন। সেচ্ছায় হারুনুর রশিদ তার মায়ের সাথে দায়িত্ব এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেন। যার ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে হারুনুর রশিদ প্রচন্ড দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।
হারুনুর রশিদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি আন্তরিকতাপূর্ন।৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলে খলিফা সব নিয়ম ভেঙে মায়ের জন্য প্রকাশ্যে শোক প্রকাশ করেন এবং তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। এই ব্যাতিক্রমধর্মী কাজ অনেককে বিস্মিত করেছিল। অনেকেই মনে করেন প্রাচীন আরবি সাহিত্য, শেহেরজাদি ও আলিফ-লায়লা এ গল্প গুলোতে খাইজুরানের জীবন নানাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। বাঁদী থেকে বেগম, যে কিনা সকলের কল্যাণে তার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন ,কিন্তু নিজ সন্তানের উত্তরাধিকার সুদৃঢ় করতে গিয়ে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের তিনি কিছুটা ঠকিয়েও ছিলেন। পরিশেষে বলা যায় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। তিনি দান ধ্যানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যোগ্যতা দেখিয়েছেন।
প্রজাদের ভালোর জন্য নিজের সম্পদ থেকে প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন। কূপ খনন করা, শহরে পানিসরবরাহ করা নিশ্চিত, অসহায় মানুষের প্রতিপালন, চিকিৎসা ইত্যাদিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করেন। তবে মাহদির প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানদের রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার এবং সূযোগ সুবিধা থেকে তিনি বঞ্চিত করেছিলেন বলে এই জন্য ঐতিহাসিকেরা তার ভীষণ সমালোচনা করেন।