একটু একটু করে ৪০ বছরের মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে নেন পর্তুগিজরা। পরে চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকেন। ভাগীরথী নদীর তীরে ১৫৮০ সালে পর্তুগিজরা একটি নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা বর্তমানে হুগলি নামে পরিচিত। পর্তুগিজদের সমস্ত কাজে সাহায্য করতো ভারতের মগরা। পর্তুগাল দেশটা ছোট হলেও খাবারের গুণগত মান ছিল অত্যন্ত উন্নত, আর সেই কারণেই নানা দেশের মানুষও তাদের খাবার খুব পছন্দ করতো। পর্তুগিজরা ভারতে এসে নানা ধরনের খাবার তৈরি করতেন। গমের আটা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট ও রুটি বানাতেন তারা। তবে তাদের রুটি আমাদের দেশের রুটির মতো ছিল না; দেখতে সুন্দর, খেতেও ছিল বেশ সুস্বাদু। আর সেই রুটিই পরে আমাদের এখনকার পাওরুটি হয়ে ওঠে।

১৬ শতকে পর্তুগিজ নাবিকদের বাংলায় আগমন হুগলি নদী দিয়ে
পর্তুগিজ ভাষায় পাও মানে রুটি। এছাড়া আঙ্গুরের রস দিয়ে তৈরি করতো বিভিন্ন রকমের ওয়াইন, ভিনেগার, সামুদ্রিক মাছ দিয়ে বানাতো সুপ, টু-ফ্রাই, গ্রিলসহ আরও নানা পদ। দুধ দিয়ে তারা বানাতো মাখন, চীজ, ক্রিম আর নানা রকমের মিষ্টান্ন। এখান থেকেই পর্তুগিজদের রান্না-বান্নার ধারা ও নতুন নতুন খাবার বাংলার নানাস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পর্তুগিজরা মগদের নানা রকমের নতুন রান্নাও শিখিয়েছিলেন। সেইসব খাদ্য ধীরে ধীরে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। তারা শুধু নতুন রান্নাই নয়, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল বহু নতুন জিনিসপত্রও। পর্তুগিজরা আলু, টমেটো, রাঙা আলু, ক্যাপসিকামের মতো সবজি ভারতে এনেছিল। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এনেছিল পেঁপে, পেয়ারা, আতা, আনারস, কামরাঙা, কাজুসহ বিভিন্ন ফল। এসব ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার কৌশলও তারা ভারতীয়দের শিখিয়েছিল।
মিষ্টি ডেজার্ট বানাতে তারা ছিল বিশেষ দক্ষ। দুধ দিয়ে বানাতো ক্ষীর, আর সেই ক্ষীরের সঙ্গে টক মিশিয়ে বানাত চানা। তখন থেকেই বাঙালির রান্নাঘরে চানা ব্যবহারের সূচনা হয়। এই চানাই পরে তৈরি করেছিল ব্যান্ডেল চিজ ও ঢাকাই পনির। ব্যান্ডেল চিজ আজও কলকাতার হগ মার্কেট, তারকেশ্বর, বিষ্ণুপুরের মতো জায়গায় জনপ্রিয়। পর্তুগিজরা লেবু, আম, আনারস, আদা দিয়ে নানারকম মোরব্বাও বানিয়েছিল। তারা রুটি এতটাই ভালোবাসতেন যে ধর্মীয় উপাসনায় প্রসাদ হিসেবেও রুটি ভগবানকে অর্পণ করতেন।

পর্তুগিজ বেকাররা বাংলায় প্রথম “পাও” বানাচ্ছে
ভারতে এসে খাবার তাদের রুচি মতো না হওয়ায় নিজেরাই রান্নার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু রুটি বানানোর উপকরণ ভারতে না পাওয়ায় ইস্টের বদলে তারি, আমন্ড দুধের বদলে নারিকেল দুধ, চিনির বদলে গুড়, মাখনের বদলে ঘি এবং ময়দার বদলে চালের গুঁড়া ব্যবহার করতেন। এগুলো দিয়ে পর্তুগিজ খাবার তৈরি হলেও স্বাদ ভারতীয় খাবারের দিকেই ঝুঁকে যেত। সেখান থেকেই জন্ম হয় এক নতুন ধারার খাবার—গোয়ান কুইজিন।
এছাড়াও পর্তুগিজদের কারণেই ভারতীয় খাদ্যসংস্কৃতিতে আসে বড় পরিবর্তন। ভারতীয়রা আগে মরিচ চিনতো না, রান্নায় ব্যবহার তো দূরের কথা; নামও শোনেনি তারা। পর্তুগিজদের কাছ থেকেই ভারত মরিচ ব্যবহারের নিয়ম শিখেছিল, যা এখন সমগ্র বিশ্বেই ব্যবহৃত হয়। অবশেষে জানা যায়, পর্তুগিজরা ভারতে এসেছিল তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে—এখানকার মসলা নিয়ে ইউরোপে বিক্রি করতে। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা নিজেদের সংস্কৃতির গভীর ছাপও ভারতীয় উপমহাদেশে রেখে গেছে।
