বর্তমান পাকিস্তানের
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াট উপত্যকায় অবস্থিত বারিকোট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। প্রাচীনকালে এই নগরীর নাম ছিল বাজিরা (Bazira)। গ্রিক ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর আগেই বারিকোট ইন্দো-গ্রীক রাজা মিলিন্দ বা মিনান্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। মিলিন্দ ছিলেন ইন্দো-গ্রীক শাসকদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী রাজা এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি গভীর আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়।

সোয়াতের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া একটি ভাস্কর্য। © wikimedia
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে বারিকোটে ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্য পরিচালিত হয়। এই খননে ইন্দো-গ্রীক যুগের একটি সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থার চিহ্ন পাওয়া যায়। শহরের প্রাচীর, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং সামরিক কাঠামোর পাশাপাশি প্রচুর অস্ত্র, মুদ্রা, শিল্পকর্ম ও মূল্যবান ভাস্কর্য উদ্ধার করা হয়। এসব আবিষ্কার থেকে স্পষ্ট হয় যে বারিকোট শুধু একটি সামরিক ঘাঁটি নয়, বরং একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও ছিল।
এরপর ২০১১ সালে বারিকোটে পুনরায় খনন কাজ শুরু হলে আরও গভীর স্তর থেকে নতুন তথ্য উঠে আসে। এই খননে তৃতীয় শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দের মৌর্য কালের স্থাপত্য ও বসতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে ইন্দো-গ্রীক শাসনের অনেক আগেই মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়েও বারিকোট একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে সম্রাট অশোকের সময়ে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে ধারণা করা হয়।

পুরাতাত্ত্বিকরা সোয়াতের বাজিরা স্থানে ইন্দো-গ্রিক ও শক-পার্থীয় স্থাপনা উৎখনন করেছেন © wikimedia
বারিকোট খননের সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সিদ্ধার্থ গৌতমের গৃহত্যাগ বা রাজগৃহ পরিত্যাগের দৃশ্যের ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যে রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে সংসার ত্যাগ করে তপস্যার পথে যাত্রা করার মুহূর্তটি শিল্পসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই ভাস্কর্য গান্ধার শিল্পরীতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ এবং বৌদ্ধ ইতিহাসের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও খননকালে সিদ্ধার্থ গৌতমের পাথরের ভাস্কর্য উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি দুটি সিংহ স্তম্ভসহ একটি স্তুপের ভাস্কর্যও পাওয়া গেছে, যা মৌর্য যুগের শিল্পরীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সিংহ স্তম্ভের উপস্থিতি সম্রাট অশোকের প্রতীকী শিল্পধারার স্মৃতি বহন করে এবং বৌদ্ধ ধর্মের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ইঙ্গিত দেয়।
বারিকোট খননস্থল থেকে উদ্ধার করা দুটি সিংহ স্তম্ভসহ স্তুপের মোট চারটি ভাস্কর্য এবং সিদ্ধার্থ গৌতমের গৃহত্যাগ ভাস্কর্য বর্তমানে পাকিস্তানের সোয়াট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। এই নিদর্শনগুলো আজও গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাছে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সোয়াত জাদুঘরে প্রদর্শিত গৌতম বুদ্ধের মহাপ্রস্থান চিত্রিত একটি রিলিফ ভাস্কর্য। © Dawn
সব মিলিয়ে বারিকোট এমন একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যেখানে মৌর্য, ইন্দো-গ্রীক ও বৌদ্ধ সভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাস একসূত্রে মিলেছে। এখানকার খননকার্য প্রমাণ করে যে উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতীয়, গ্রিক ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলনে এক সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, যার নীরব সাক্ষী হয়ে আজও বারিকোটের ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে।