মহাশূন্যের অসংখ্য জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাগুলোর মধ্যে আজ একটি তারাকে খুবই উজ্জ্বল ও বিশেষ মনে হচ্ছে। এমন তারা তো সচরাচর কখনোই চোখে পড়ে না। অবাক বিস্ময়ে তারাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনজন। জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ জ্ঞান থাকার কারণে তারাদের প্রকৃতি তাদের অজানা নয়। কিন্তু আজকের এই তারাটি তারা আগে কখনো দেখেন নি। কি এক আকর্ষণে সেটির পথ ধরে হেঁটে চলেছেন তারা তিন জন। গন্তব্য অজানা। কিন্তু তারাটির বিশেষত্ব তাদের কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না। তাদের শুধুই মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই তাদের গন্তব্যে রয়েছে কোনো অমূল্য দর্শন, যে কোনো মূল্যে যার দেখা পেতেই হবে। প্রায় বারো দিন অবিরাম পশ্চিমের দিকে পথ চলার পর জেরুজালেমে রাজা হেরেডের রাজ্যে পৌঁছালেন তারা এবং তাদের আসার কারণ ও অদ্ভূত তারাটির বিশেষত্ব ব্যাখ্যা করলেন। সব কিছু শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হেরেড তার রাজ্যের জ্যোতির্বিদ পন্ডিত ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে তারাটির গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বেথেলহামে পাঠালেন সেই তিনজন ব্যক্তিকে। এবার গন্তব্যের দেখা পেলেন তারা। আরে, এ তো এক নবজাতক শিশু! এক পরম পবিত্রা মায়ের কোলে যার বিচরণ। তাদের বিশ্বাস, নিশ্চয়ই এ এক বিশেষ শিশু, ইহুদীদের রাজা। পরম শ্রদ্ধায় শিশুটিকে উপহার নিবেদন করলেন তারা। শিশুটির নাম রাখা হয়েছিলো ‘যীশু’।

ছেলেবেলা থেকে কম-বেশি আমরা সবাই-ই এমনই একটি গল্প শুনে বড় হয়েছি। গল্পটা যীশুর জন্মের সময়ের। এই গল্প অনুসারে যীশুর জন্মের কয়েক দিন পর তাকে দেখতে তিন জন জ্ঞানী ব্যক্তি পূর্ব দিক থেকে এক বিশেষ ও উজ্জ্বলতম তারার পথ ধরে এসেছিলেন এবং নবজাতক যীশুকে তারা তিনটি উপহার দিয়েছিলেন- সোনা, ধূপ ও গন্ধরস। কিন্তু এটি কি নিছকই কোনো গল্প, নাকি সত্যিই ঘটেছিলো এমন কোনো ঘটনা? আর যদি সত্যিই এমন ঘটনা ঘটে থাকে, তবে কারা ছিলেন সেই তিন জন ব্যক্তি? এমনই অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম কালে কালে ঘুরিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের মোড়।

যীশুকে দেখতে আসা সেই তিন জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে ‘গসপেল অফ ম্যাথিউ’ এর নতুন টেস্টামেন্টে ‘ম্যাজাই’ বলে অভিহিত করা হয়। ম্যাজাইরা নিজেদের সঙ্গে যে উপহারগুলো এনেছিলেন সেগুলোর প্রত্যেকটিই দামী ও দুর্লভ বস্তু এবং কোনো নবজাতক শিশুকে দেয়ার মতো খুব স্বাভাবিক কোনো উপহার নয়। তবে উপহারের প্রকৃতি দেখে অধিকাংশই মত দিয়েছেন যে, সেই তিন জন ম্যাজাই নিশ্চয়ই রাজা ছিলেন।

৪র্থ শতাব্দীর প্রথমার্ধে একটি সারকোফ্যাগাস পাওয়া গিয়েছে, যেখানে যীশুকে দেখতে যাওয়া এই ম্যাজাইদের গল্প চিত্রিত রূপ পেয়েছে। সারকোফ্যাগাসটিতে যীশুকে উপহার দেয়া প্রথম ব্যক্তির নির্দেশিত আঙ্গুল তারার পথের বার্তা দেয় এবং এতে তিনজন ম্যাজাই এর প্রত্যেককেই এমন পোশাক ও টুপি পরিহিত দেখা যায়, যা প্রমাণ করে যে তারা প্রাচ্য থেকেই এসেছিলো।

এই কাহিনী নতুন এক মাত্রা পায়, যখন ৫০০ সালে লিখিত একটি গ্রীক পান্ডুলিপিতে তাদের পরিচয় উল্লেখ করা হয়। পান্ডুলিপি অনুযায়ী, পারস্য থেকে ‘মেলকিয়র’, ব্যবিলন থেকে ‘ব্যালথাজার’ এবং ভারতবর্ষ থেকে ‘গ্যাসপার’ গিয়েছিলেন যীশুখ্রিস্টকে দেখতে। ‘গ্যাসপার’ নামটি আবার কোনো কোনো জায়গায় ‘ক্যাসপার’ বা ‘গ্যাথাসপা’ হিসেবেও এসেছে। তবে ‘ক্যাসপার’ নামের কোনো রাজা সত্যিই যীশুকে দেখতে ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছিলেন কি না, তা হলফ করে বলার উপায় নেই। কিন্তু যীশুখ্রিস্টের সবচেয়ে কাছের ১২ জন (মতান্তরে ১১ জন) শিষ্যের মধ্যে সেইন্ট টমাস নামের একজনের কথা জানা যায়, যিনি ৩৩ সালে যীশুখ্রিস্ট মারা যাওয়ার কিছুকাল পর ইন্দো-পার্থিয়ান রাজা ‘গন্ডোফারেস’ এর আমলে ভারতবর্ষে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আর এখানেই তৈরী হয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবলিকাল সংযোগ।

তৃতীয় শতকের সারকোফ্যাগাসে প্রাচ্যের পোশাকে তিনজন জ্ঞানী রাজার একটি অতিপ্রাচীন চিত্রায়ণঃ দ্য অ্যাডোরেশান অফ ম্যাজাই

৩য় শতাব্দীতে আর্মাইক ভাষায় লেখা বই ‘দ্য অ্যাপোক্রিফাল অ্যাক্টস অফ সেইন্ট থমাস’ থেকে পাওয়া যায়, সেইন্ট টমাস ‘গুদনাফার’ নামের এক রাজার দরবারে পৌঁছেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘গুদনাফার’ বা ‘বিন্দাফারনাহ’ এর গ্রীক রূপ হলো ‘গন্ডোফারেস’ বা ‘গন্ডোফারনেস’ এবং আর্মেনিয়ান ভাষায় ও পশ্চিমা ভাষায় এটি যথাক্রমে ‘গ্যাস্টাফার’ ও ‘ক্যাসপার’।

আবার মধ্যযুগে হিল্ডাশাইমের জনের লেখা ‘হিস্টোরিয়া ট্রিয়াম রিগাম’ বা ‘তিন রাজার ইতিহাস’ –এ রাজা ক্যাসপারের রাজ্যকে ‘এগ্রিসিলা’ বলা হয়েছে। আর এই ‘এগ্রিসিলা’ আসলে ‘তক্ষশীলা’ নামেরই একটি অপভ্রংশ। কারণ ১৪৯২ সালে জার্মান মানচিত্রকার মার্টিন বিহাইম নুরেমবার্গে যে গ্লোব বা বিশ্ব মানচিত্র তৈরী করেছিলেন, সেখানে ‘এগ্রিসিলা ব্রাগমানি’ অর্থাৎ ‘ব্রাহ্মণদের এগ্রিসিলা’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং ব্রাহ্মণদের অঞ্চল তক্ষশীলাই যে এগ্রিসিলা, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কিন্তু তক্ষশীলা তো সেইন্ট টমাসের সময়ে রাজা গন্ডোফারেসের রাজধানী ছিলো। তাহলে গন্ডোফারেস ও ক্যাসপার কি একই ব্যক্তি? আর ভারতবর্ষ থেকে শিশু যীশুকে দেখতে যাওয়া সেই জ্ঞানী রাজা কি সেইন্ট টমাসের সাহচর্যে আসা গন্ডোফারেসই ছিলো? এসব আজও যদিও রহস্যই রয়ে গেছে, কিন্তু একটু চেষ্টা করলে হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে আমরা এই রহস্যেরও একটা সমাধান বের করে ফেলতে পারবো। তবে তার আগে জানা যাক, কে এই গন্ডোফারেস এবং সেইন্ট টমাসই বা ভারতবর্ষের ইতিহাসে কেনো এতো গুরুত্বপূর্ণ।

বশিষ্ঠ, অরুন্ধতী ও কামধেনু

বাল্মীকির রামায়ণের প্রথম বই ‘বালাকান্দা’ থেকে একটি গল্প আমরা অনেকেই শুনেছি, ‘বিশ্বমিত্র ও ইচ্ছেপূরণ করা গরু’-র গল্প। এই গল্প অনুসারে, ঋষি বশিষ্টের একটি গরু ছিলো, যার একটি আশ্চর্য ক্ষমতা ছিলো। ইচ্ছেপূরণ করতে পারতো সেটি। তাই রাজা বিশ্বমিত্র তার সৈন্যদল নিয়ে ঋষির আশ্রমে যান গরুটিকে বন্দী করে নিয়ে আসতে। ঋষি বশিষ্ট দুঃখভারাক্রান্ত মনে গরুটিকে আদেশ দিলেন শত্রুপক্ষের সৈন্যদের দমন করার জন্য একটি সেনাবাহিনী তৈরী করতে। ফলে ইচ্ছেপূরণীয় গরুটি শক, পহ্লব ও যবন সৈন্যদের একটি দল তৈরী করলো। কথিত আছে, সেই শক ও পহ্লব সৈন্যরাই পরবর্তীতে সেই রাজ্য দখল করে নেয় এবং এই উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এটি হয়তো শুধুই একটি গল্পমাত্র, তবে ভারতবর্ষে প্রবেশের পর প্রথমে শক বা ইন্দো-সিথিয়ানরা সত্যিই রাজাদের সৈন্য হিসেবেই দায়িত্বরত থাকতো। পরে তারা উপমহাদেশে শাসন শুরু করে। পরবর্তীতে শকদের হারিয়ে পহ্লব বা ইন্দো-পার্থিয়ানরা এখানে রাজত্ব গড়ে তোলে।

সেন্ট টমাসের স্প্যানিশ পেইন্টিং

তরুণ যুবক আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার জীবদ্দশায় যতো রাজ্য জয় করেছিলেন, তা তার মৃত্যুর পর তার জেনারেলদের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিলো এবং ভারতবর্ষের পারস্য, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কিছু অংশ পেয়েছিলেন সেলিউকাস নিকাতোর। কিন্তু অচিরেই তা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দখলে চলে যায় এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগে ও চীনের মহাপ্রাচীর তৈরীর কারণে একের পর এক বিভিন্ন বিদেশী জাতির ভারতবর্ষে প্রবেশ ভারতবর্ষের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এর পর থেকে ক্রমে ক্রমে হাতবদল হয়ে এক পর্যায়ে ইরান থেকে আসা প্রথম গন্ডোফারেসের অধীনে এসে পড়ে সেলিউকাসের অঞ্চল।

ইন্দো পার্থিয়ান রাজা

যীশুখ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় বারো বছর আগে পার্থিয়ান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে ইরানের আর্সাসিড সাম্রাজ্যের সুরেন বংশীয় প্রথম গন্ডোফারেস এই উপমহাদেশে গড়ে তোলেন ইন্দো-পার্থিয়ান সাম্রাজ্য। সুরেন বংশের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বদানের ভূমিকা পালন ও রাজার রাজ্যাভিষেকের সময় তার মাথায় মুকুট পরানোর মতো গুরুদায়িত্ব পালন করতো। খ্রিস্টপূর্ব ১২৯ সালের দিকে চীনের ইউ-চি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর ক্রমাগত আক্রমণে অতিষ্ঠ তৎকালীন ইরানের রাজা এই সুরেন বংশীয়দেরকে ‘সিস্তান’ বা ‘শাকাস্তান’ এর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা শকদেরকে শুধু প্রতিহতই করে নি, বরং শকদের অধীনের সমস্ত অঞ্চলগুলো তারা দখল করেছিলো এবং পার্সিয়ান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে নিজেদেরকে তারা স্বতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। এমনই একজন পহ্লব বা ইন্দো-পার্থিয়ান রাজা ছিলেন প্রথম গন্ডোফারেস। ‘গন্ডোফারেস’ কোনো ব্যক্তিগত নাম ছিলো না, বরং এটি ছিলো ইরানের রাজাদের মধ্য নাম। ইন্দো-পার্থিয়ান বা পহ্লব রাজাদের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে এই নামটিই ব্যবহার করা হতো।

৩৩ বছর বয়সে যীশুখ্রিস্টকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হলো, তখন যীশুর সবচেয়ে কাছের ১২ জন (মতান্তরে ১১ জন) শিষ্য সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারা মহান যীশুখ্রিস্টের বাণী সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিবেন। আর এভাবেই তাদের মধ্যে সেইন্ট টমাস নামের একজন ভারতবর্ষে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। মেডিটেরিনিয়ান সাগর ও লোহিত সাগরের পথ ধরে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তানে এসে পৌঁছালেন সেইন্ট টমাস ৪০ সালের দিকে। পরে তিনি ভারতবর্ষের পশ্চিমের দিকে যাত্রা করেন ও কেরালায় গিয়ে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। সেইন্ট টমাস অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেখানকার মানুষদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ভীড় করে সবাই শুনতো তার কথা। এভাবে প্রথম চার্চ কেরালাতে গঠিত হয়। তখন ‘চার্চ’ বলতে কোনো বিশাল স্থাপনা নয়, বরং একদল মানুষকেই বুঝানো হতো, যারা খ্রিস্টের বাণীকে অনুসরণ করতো। আর এই দলের মানুষদেরকে বলা হয় ‘টমাস খ্রিস্টান’, যাদের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্ম প্রবেশের এটিই সবচেয়ে প্রাচীন ইতিহাস। খ্রিস্টান ধর্ম একদম তার সূচনালগ্নেই ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলো সেইন্ট টমাসের হাত ধরে। এমনকি প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে আর্মেনিয়া ৩০১ সালে খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো, যা ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবেশের প্রায় ২৫০ বছর পরের ঘটনা। সেইন্ট টমাস কয়েক বছর পর দক্ষিণের দিকে যাত্রা করেন এবং চেন্নাইয়ের মাইলাপুরে স্থায়ী হন। সেখানে তিনি ‘লিটল মাউন্ট’ নামের একটি জায়গায় থাকতেন ও সেখানেই উপাসনা করতেন। কেরালার মতো এই অঞ্চলেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান তিনি। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা তার জন্য কিছু শত্রুরও জন্ম দেয়। একদিন উপাসনারত অবস্থায় আক্রমণের শিকার হন সেইন্ট টমাস এবং সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে সেই স্থানটি ‘সেইন্ট টমাস পর্বত’ নামে পরিচিত। তাকে সেই সৈকতেই দাফন করা হয়, যেখানে তিনি প্রতিদিন যেতেন মানুষকে খ্রিস্টের বাণীর প্রতি আহ্বান করার জন্য।

তবে ‘দ্য অ্যাপোক্রিফাল অ্যাক্টস অফ সেইন্ট থমাস’ অনুসারে, দক্ষিণ ভারতবর্ষে আসার আগে সেইন্ট টমাস প্রথমে উত্তর ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন এবং তখন সেখানে রাজা গন্ডোফারেসের শাসন ছিলো। তিনি গন্ডোফারেসের দরবারে যেতেন। এমনকি এমনও কথিত আছে যে, বহুল জনপ্রিয় ও জ্ঞানী টমাসের কথা শুনতে রাজা নিজেই কখনো কখনো তার কাছে যেতেন।

রাজা গন্ডোফারেসের অস্তিত্ব সম্পর্কে সরাসরি প্রমাণ আগে মেলে নি। আর এ কারণে সেইন্ট টমাস ও গন্ডোফারেসের কাহিনী একটি মিথ হয়েই রয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সম্প্রতি ১৮৩৪ সালে রাজা গন্ডোফারেসের একটি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে, যা তার অস্তিত্বের প্রমাণ তো দেয়ই এবং একই সাথে এ-ও জানা যায় যে, সেইন্ট টমাসের সময়েই রাজা গন্ডোফারেসের শাসন ছিলো এই উপমহাদেশে।

ইন্দো-পার্থিয়ানদের যুগের জরথুষ্ট্রীয় অগ্নি মন্দিরের অবশিষ্টাংশ

রাজা গন্ডোফারেস জ্ঞান ও সমৃদ্ধির নগরী তক্ষশীলাকেই নিজের রাজধানী করেছিলেন এবং তার সময়ের বেশ কিছু জোরোস্ট্রিয়ান অগ্নিউপাসনা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া গিয়েছে। তারা যদিও জোরোস্ট্রিয়ানিজম বা জরাথ্রুস্টবাদের অনুসারী ছিলো, তবুও উপমহাদেশের অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি তারা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। বিশেষ করে গ্রীক সংস্কৃতি গন্ডোফারেসকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ইন্দো-পার্থিয়ান মুদ্রাগুলোতেও গ্রীক শিলালিপি ছিলো। সে সময়ের একজন গ্রীক দার্শনিক টায়ানার অ্যাপোলোনিয়াস ৪৪ সালের দিকে, অর্থাৎ সেইন্ট টমাস আসার চার বছর পরে গন্ডোফারিড রাজ্যে এসেছিলেন। তিনি লিখেছেন যে, সেখানকার রাজা অনর্গল গ্রীক ভাষায় কথা বলতেন এবং তিনি গ্রীক অঞ্চলের মতোই একটি রাজ্য দেখেছিলেন। অ্যাপোলোনিয়াস গন্ডোফারিড রাজ্যে তক্ষশীলা ও পশ্চিমা বিশ্বের এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ লক্ষ করেছিলেন।

গন্ডোফারেস মুদ্রা

গ্রীক সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কোনো সংস্কৃতি ইন্দো-পার্থিয়ানদের মধ্যে তেমন প্রভাব বিস্তার করে নি। সিরকাপের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে ইন্দো-পার্থিয়ানদের বাহ্যিক রূপের কিছুটা অনুমান পাওয়া যায়। যেমন, তাদের ছিলো ঝাঁকড়া চুল, তারা মাথায় ব্যান্ড পরতো, বেল্ট পরতো এবং তাদের জ্যাকেটে একটা ক্রস চিহ্ন থাকতো। তাদের মুদ্রাগুলোতে গ্রীক ছাপ থাকলেও বৌদ্ধদের মতো হাতি, ষাঁড় কিংবা ত্রিরত্নের চিহ্নবিশিষ্ট কোনো মুদ্রা ছিলো না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, সেই সময়ে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও তাদের জীবনধারায় বৌদ্ধ ধর্মের কোনো ছাপই ছিলো না। তবে ১ম শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে তৈরী পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়াতে ‘তখত-ই-বাহী’ নামের একটি বৌদ্ধ মঠ পাওয়া গিয়েছে, যাতে পাওয়া শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, এটি রাজা গন্ডোফারেসের সময়েরই বৌদ্ধ মঠ। আবার তার সময়ে হিন্দু দেবতা শিবেরও কয়েকটি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং, এটিও পরিষ্কার যে, গন্ডোফারেস বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের চর্চাকে উৎসাহিত করতেন।

কুষাণরা পরবর্তীতে এই পহ্লবদের পদধারা অনুসরণ করেই জরাথ্রুস্টবাদকে গ্রহণ করেছিলো। তাদের আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হলো, তারা সিল্ক রুটের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখেছিলো এবং বৌদ্ধ ধর্মকে চীনে নিয়ে যেতেও তারা সহায়তা করেছিলো।

তখত-ই-বাহী

প্রকৃতপক্ষে যীশুখ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে, এমনকি আলেকজান্ডারের সময়েরও অনেক আগে থেকে এই উপমহাদেশের সাথে বহিঃর্বিশ্বের একটা সার্বজনীন সংযোগ তৈরী হয়েছে। সম্রাট অশোক মৌর্যও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করবার জন্য সিরিয়া, গ্রীস ও শ্রীলংকায় দূত পাঠিয়েছিলেন। আবার পার্সিয়ান রাজা সাইরাসের রাজ্যও ছিলো একেবারে আফগানিস্তান থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল অঞ্চল। সুতরাং উপমহাদেশের সাথে যোগাযোগের জন্য বহু আগে থেকেই ছিলো সুবর্ণ ব্যবস্থা। এতো বিস্তৃত ও সহজ যোগাযোগের উপায় যেহেতু সে সময় ছিলো, তাহলে গন্ডোফারেসের যীশুকে দেখতে জেরুজালেমে যাওয়াটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। সুতরাং আরেকটু বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে কোনো এক দিন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যেতেও পারে, মিলতেও পারে এই বিবলিকাল সংযোগের সত্যতা, খুলতেও পারে অমীমাংসিত কিছু রহস্যের জট।